উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
[1] উদারনৈতিক রাষ্ট্র তত্ত্ব রাষ্ট্রকে শ্রেণিশােষণের হাতিয়ার হিসেবে দেখে না। উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাষ্ট্র হল সমষ্টিগত উন্নয়নের প্রতীক।
[2] উদারনীতিবিদরা শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
[3] উদারনীতিবাদরা রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের কথা উল্লেখ করেননি। উদারনীতিবাদীরা সংবিধানগত পদ্ধতির মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের নীতিতে বিশ্বাসী।
[4] উদারনৈতিক মতবাদ মুক্ত অর্থনীতি বা অবাধ বাণিজ্য নীতি অনুসরণের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। উদারনীতির অন্যতম প্রবক্তা অ্যাডাম স্মিথ অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রয়ােগের কথা বলেছেন।
[5] উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি কি সীমিত করার কথা বলেছে। উদারনীতিবাদের রাষ্ট্রকে নিরাপত্তামূলক ভূমিকায় রাখতে চান, তারা রাষ্ট্রকে একটি Protective Agency’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। উদারনীতিবাদীদের মতে, নিরাপত্তা রক্ষা, দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থেই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
[6] উদারনৈতিক তত্ত্ব কখনােই রাষ্ট্রের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলেনি। এই তত্ত্বে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বজায় রেখে নাগরিকের অধিকার-এর উপর কম হস্তক্ষেপের কথা বলা হয়েছে।
[7] উদারনীতিবাদীদের মতে, চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এর মূল কারণ হল স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকারের মতাে ব্যক্তির প্রাকৃতিক অধিকারগুলিকে রক্ষা করা। উদারনীতিবাদের সমর্থক রবার্ট নজিকের মতে, নাগরিকের অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভােগের অধিকার ও তাদের চুক্তিভিত্তিক স্বাধীনতায় কোনােভাবেই হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উদারনীতিবাদীরা বিত্তশালী ব্যক্তিদের উপর রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া করের সমালােচনা করেছেন।
[8] উদারনীতিবাদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ব্যক্তিস্বাধীনতা। উদারনীতিবাদের মতে, রাষ্ট্রের জন্য ব্যক্তি নয়, ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্র, অর্থাৎ ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সম্মানরক্ষা, ব্যক্তির সুখ-শান্তির ব্যবস্থা করা। এইসবের জন্যই রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র অপেক্ষা ব্যক্তির প্রাধান্য সবসময় বেশি।
মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি
[1] মার্কসীয় তত্ত্বে রাষ্ট্রকে শ্রেণিশােষণের যন্ত্রস্বূপ বিবেচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ শ্রেণিগত দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ অনুযায়ী মার্কসবাদ রাষ্ট্রের প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করেছে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সাহায্যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দেখানাে হয়েছে যে, দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র কীভাবে দাস-মালিক এবং সামন্তপ্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে।
[2] মার্কসবাদীরা বলপ্রয়োগ বা শ্রেণিসংগ্রাম অর্থাৎ বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
[3] মার্কসবাদে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য বিপ্লবকে প্রধান মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই মতবাদ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের ক্ষেত্রে বিপ্লবকে অনিবার্য ঘটনা বলে মনে করেছে। এখানে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের বদলে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
[4] মার্কসবাদে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ এই ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে উৎপাদন ব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বাধীনতা বা অবাধ বাণিজ্য নীতির অবসান ঘটবে এবং তার পরিবর্তে সেখানে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মার্কসবাদীদের মতে, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরােপুরি রাষ্ট্রের আওতায় থাকবে।
[5] মার্কসীয় তত্ত্বে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি কি সংকুচিত করা হয়নি। আদি সাম্যবাদী সমাজ ছাড়া সমস্ত সমাজেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার জন্য রাষ্ট্র অবশ্যম্ভাবী বলে তারা মনে করেন। মার্কসবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, পুঁজিবাদী সমাজের পতনের পর সমাজতান্ত্রিক সমাজের উত্তরণের সােপানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে।
[6] রাষ্ট্রের বিলােপ সংক্রান্ত ধারণা মার্কসীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মার্কসবাদীদের মতে, সমাজ বিবর্তনের ধারায় সমাজতান্ত্রিক সমাজ সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হলে সমাজস্থ সকল শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটবে। এর ফলে রাষ্ট্রের আর কোনাে প্রয়ােজনীয়তা থাকবে না, ফলে রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটবে।
[7] মার্কসীয় তত্ত্বে প্রাকৃতিক অধিকারের কোনাে স্থান নেই। মার্কসীয় তত্ত্বে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে শ্রেণিশােষণের অবসান ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
[8] মার্কসীয় তত্ত্বে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্নটি এত গুরুত্ব পায়নি। মার্কসীয় তত্ত্বে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির উপর অধিকতর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে।