ভূমিকা: মহাত্মা গান্ধীর জীবনাদর্শ সর্বোদয় এবং রাষ্ট্র প্রসঙ্গে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। গান্ধিজি সর্বোদয়ের ধারণাটি পেয়েছিলেন জন রাস্কিনের লেখা ‘Unto This Last’ গ্রন্থ থেকে এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটেছিল তার ‘হিন্দ স্বরাজ নামক গ্রন্থে। নিম্নে তার এই দুটি ধারণাই বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হল―
সর্বোদয় প্রসঙ্গে গান্ধি: সর্বোদয় হল গান্ধীর জীবন বেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গান্ধীর রাজনৈতিক চিন্তা দর্শনের আঙিনায় সর্বোদয় বিশেষ গুরুত্ব দাবি করতে পারে।
রাস্কিনের তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গান্ধীজীর সর্বোদয় তত্ত্বের উদ্ভব ঘটান। সর্বোদয় শব্দটি দুটি শব্দের সমাহার সর্ব এবং উদয়। এই শব্দযুগলের আক্ষরিক অর্থ হল সকলের কল্যাণ (uplift of all)। রাস্কিনের এই গ্রন্থ থেকে গান্ধি মানুষের জীবনে কায়িক পরিশ্রমের মর্যাদা (dignity of Labour) সম্পর্ক সচেতন হন এবং সকলের কল্যাণের মধ্যেই ব্যক্তির কল্যাণ নিহিত- এই সত্যে উপনীত হন।
সর্বোদয়ের সংজ্ঞা: গান্ধিজির ভাষায় সকলের কল্যাণ ও হিতই হল সর্বোদয়ের মূল ভিত্তি। মানবতার জন্য কাজ করেই মানুষের আত্মোপলব্ধি আসে এবং ওই আত্মোপলব্ধি অর্থ হল সর্বসাধারণের কল্যাণ বা হিত। সর্বোদয় হল সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি যার অভাব হলে মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার অপমৃত্যু। সর্বোদয়ের ভিত্তি হল সর্বব্যাপী ভালোবাসা, গান্ধীজীর সর্বোদয় সমাজ হল শ্রেণীহীন সমাজ, এখানে সকলেই সমান। ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ,অভিজাত-অন্ত্যজ প্রকৃতির ভিত্তিতে কোনাে কারণবশত কোনাে শ্রেণির সঙ্গে পার্থক্য করা যায় না।
গান্ধির সর্বোদয় চিন্তা দর্শন কি বেন্থামের হিতবাদের সমার্থক: গান্ধির সর্বোদয় ধারণার নির্যাস হল সকলের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ (Greatest good for all) আর বেন্থামের হিতবাদের মূল বক্তব্য হল সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ (Greatest happiness for the greatest number)। গান্ধী সকলের কল্যাণের পরিবর্তে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের কল্যাণকে যথেষ্ট এবং সন্তোষজনক মনে করেননি। বেন্থামের সূত্র অনুযায়ী ৫১ শতাংশ মানুষের কল্যাণ হলে বাকি ৪৯ শতাংশ মানুষের কল্যাণ ব্যাহত বা উপেক্ষিত হবে, যা গান্ধি মানতে পারেননি। গান্ধি নিজেই বলেছেন যে সর্বোচ্চ নয়, সকলের কল্যাণের জন্য তিনি প্রয়াসী হবেন, তা না হলে মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত। তাই গান্ধির সর্বোদয় তত্ত্বকে বেন্থামের হিতবাদের পুরােপুরি সমার্থক বা উত্তরসাধক বলা যায় না।
গান্ধির সর্বোদয়ের লক্ষ্য
সর্বোদয়ের মূল মন্ত্র হল প্রেম-প্রীতি ও ভালােবাসা যার লক্ষ্য সমগ্র ভারত রাষ্ট্রের এক উন্নত নৈতিক পরিবেশ গড়ে তােলা। গান্ধীজীর মতে, সত্য, অহিংসা ও সৎ পথের দ্বারা এই শ্রেণির পরিবেশ গড়ে উঠবে। বলাবাহুল্য, গান্ধীজীর কাছে এই অহিংসা ছিল প্রাণবায়ুর মতাে। গান্ধিজি মৌলিক নীতি ও আদর্শ হিসেবে সত্যের উপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার নিজের কথায় সর্বোদয়ের সিদ্ধান্ত হল মূলত তিনটিㅡ
- সকলের মঙ্গলের মধ্যে নিজের মঙ্গল নিহিত।
- একজন আইনজীবী ও ক্ষৌরকারের পরিশ্রমের মূল্য সমান, কারণ জীবিকা অর্জনে উভয়ের সমান অধিকার এবং
- একজন সাধারণ শ্রমিক ও কৃষকের জীবন হল আদর্শ জীবন।
সর্বোদয় জীবনদর্শনের কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য
(১) আত্মত্যাগ: আত্মত্যাগ হল গান্ধীজীর সর্বোদয় চিন্তাদর্শনের ভিত্তিভূমি। প্রত্যেকে আত্মসুখের পরিবর্তে অপরের সুখের প্রতি নজর রাখবে। বলা যেতে পারে যে, প্রত্যেকে নিজের জীবনকে অপরের স্বার্থরক্ষায় উৎসর্গ করবে। এর ফলস্বরূপ সমাজে কোনাে দ্বন্দ্ব বা বিদ্বেষ থাকবে না।
(২) গ্রামীণ সভ্যতার বিকাশ: গান্ধীজীর মতে, ভারত রাষ্ট্রের সমাজ জীবন ছিল মূলত গ্রামকেন্দ্রিক অর্থাৎ গ্রামই ছিল এই সমাজের প্রাণকেন্দ্র। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, সর্বোদয় সমাজ গঠনের মধ্য দিয়েই গ্রামীণ মানুষদের প্রতি শােষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটবে।
(৩) দলহীন গণতন্ত্র: গান্ধীজীর সর্বোদয় চিন্তা দর্শন দলহীন গণতন্ত্রে (Partyless Democracy) বিশ্বাসী। কারণ তার মতে, দলীয় নীতি তথা দলীয় গণতন্ত্রের ফলে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ও ভােটজনিত দ্বন্দ্ব দেখা দেবে এবং সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সমাজ হয়ে উঠবে দুর্নীতিগ্রস্ত।
(৪) আধুনিক শিল্প সভ্যতার বিরােধী: গান্ধীজীর সর্বোদয় চিন্তা চেতনা কৃষি ও শিল্পের আধুনিকীকরণ ও উন্নত উৎপাদন ব্যবস্থাকে সমর্থন করে না। কারণ, আধুনিক যন্ত্রচালিত সভ্যতা ও কৃষিব্যবস্থা মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলির বিনাশ ঘটায়।
(৫) সকলের শাসন: গান্ধীর সর্বোদয় চিন্তা দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত সেখানে শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, সর্বজনীন অর্থাৎ সকলের জন্য শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। তার মতে, একমাত্র গ্রাম পায়েতের মাধ্যমেই এই ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যেখানে কেবলমাত্র গ্রামীণ মানুষদের দ্বারাই পঞ্চায়েত সদস্য নির্বাচিত হবে। এই নির্বাচন সকল প্রকার দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থাকবে।
গান্ধীর সর্বোদয় তত্ত্বের মূল বক্তব্য
[1] ব্যক্তির কল্যাণ সকল মানুষের কল্যাণের মধ্যে নিহিত। অর্থাৎ সবার ভালােতে নিজের ভালাে।
[2] জীবিকা অর্জনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে একজন উকিলের কাজ এবং একজন নাপিতের কাজের মূল্য সমান।
[3] একজন চাষী বা হস্তশিল্পীর মতাে একজন শ্রমজীবী মানুষের জীবন হল আদর্শ বা শ্রমভিত্তিক জীবনই হল সার্থক জীবন। অর্থাৎ শ্রমের মর্যাদা এবং সকলের হিত বা কল্যাণ হল সর্বোদয়ের মূল কথা।
সমালােচনা : গান্ধীর সর্বোদয়ের যে আদর্শ তুলে ধরেছেন তা হল সকলের জন্য কল্যাণ সুনিশ্চিত করা, শ্রমের মর্যাদারক্ষা, জাতি ধর্ম-বর্ণ-অস্পৃশ্য, সাদা-কালাে, গরিব-বড়লোক, পাপী-পুণ্যবান সকলের হিত বা কল্যাণ। সর্বোদয় তত্ত্ব মনে করে বুদ্ধিমত্তার তুলনায় শ্রম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির তুলনায় নৈতিকতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, রাজনৈতিক সংস্কারের চেয়ে নৈতিক পুনরুজ্জীবন অনেক বেশি কাম্য। তবে সমালােচকরা মনে করেন, সর্বোদয়ের আদর্শ শিল্পায়নবিরােধী, সর্বোদয়ের আদর্শ শ্রেণিসংগ্রামকেও সমর্থন করে না। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তির স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং ব্যক্তির মধ্যে নিহিত সততা ও প্রেমকে হত্যা করে। এই প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত জীবনধারা মানুষকে মনুষ্যত্বহীন এক জীবে পরিণত করে।
এই তত্ত্ব আদর্শ হিসেবে নিখুঁত হলেও, বাস্তবে এই নীতি কার্যকর করা কখনােই সম্ভব নয়। মানুষ সম্পর্কে এই তত্ত্বে যা কল্পনা করা হয়েছে। যুক্তি, বুদ্ধি দ্বারা তা সমর্থনযােগ্য নয়। ঐকমত্যের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হলেও চিন্তার ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের যে মূল্য আছে এই তত্ত্ব তা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়নি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের উপর গুরুত্ব আরােপ করা হলেও এর মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সর্বোদয় তত্ত্ব শ্রেণিদ্বন্দ্ব পরিবর্তে শ্রেণি সমবায়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মার্কসবাদীদের মতে, বৈষম্যমূলক সমাজে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক সত্য, এর জন্যই সর্বোদয় তত্ত্ব অনৈতিহাসিক তত্ত্ব বলে বিবেচিত হয়।
পরিশেষে উল্লেখ্য যে, বস্তুত গান্ধীজীর সর্বোদয় যে আদর্শ ও দর্শনের কথা বলে তা বাস্তবতা থেকে অনেক দূরের এক স্বপ্নময় জীবন এবং জগতের কথা বলে, যাকে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার যুগে একান্তভাবেই কাল্পনিক (Utopia) এবং নৈরাজ্যবাদী বলে মনে হয়। তবে সর্বোদয় তত্ত্ব একেবারে গুরুত্বহীন নয়, এই তত্ত্ব বর্তমান দুনিয়ায় ভােগসর্বস্ব জীবনের পরিবর্তে এক আদর্শ জীবন গড়ে তােলার ব্যাপারে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তা মােটেই অবহেলার নয়।