ভূমিকা: ভারতের রাষ্ট্রপতি হলেন কেন্দ্রের শাসন বিভাগের প্রধান। তবে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির মতাে নির্বাচিত ক্ষমতাশালী শাসক নন। ভারতের সংবিধানের মুখ্যপ্রণেতা ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতে, ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতি শব্দটি যুক্ত করা হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তার ক্ষমতা ও ভূমিকার তুলনা চলে না। তিনি গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির মতো রাষ্ট্রপ্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যােগ্যতা
সংবিধানের ৫৮নং ধারায় রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর যােগ্যতার উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে গেলে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে নিম্নলিখিত যােগ্যতার অধিকারী হতে হয়। যেমন—
- ভারতের নাগরিক হতে হবে।
- কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।
- লোকসভার সদস্য (এমপি) হওয়ার যােগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে।
- কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভার কোনাে সদস্যপদে থাকতে পারবেন না।
- তিনি কোনােরকম সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না।
- রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নাম ৫০ জন নির্বাচক দ্বারা প্রস্তাবিত এবং ৫০ জন নির্বাচক কর্তৃক সমর্থিত হতে হবে।
- প্রত্যেক প্রার্থীর মনােনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় ১৫,০০০ টাকা ফি-বাবদ জামানত হিসেবে দিতে হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই যে, সংবিধানের ৫৯নং ধারানুযায়ী লোকসভা, রাজ্যসভা অথবা বিধানসভা কিংবা বিধান পরিষদ ইত্যাদি কোনাে কক্ষের সদস্য যদি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন তাহলে নির্বাচনের দিন তিনি শপথ গ্রহণ করবেন আর সেদিনই তিনি ওই সদস্যপদ ত্যাগ করেছেন বলে গণ্য করা হবে।
নির্বাচক সংস্থা: ভারতের রাষ্ট্রপতি পরােক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির সাহায্যে বিশেষ নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুসারে ভারতের প্রথম নাগরিক হলেন মাননীয় রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৫৪নং ধারানুসারে তিনি একটি পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী (Electoral College) দ্বারা গঠিত নির্বাচক সংস্থা কর্তৃক একক হস্তান্তরযোগ্য সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতির ভিত্তিতে (Proportional Representation by means of a single Transferable vote) নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনী সংস্থায় উপস্থিত থাকেন―
- (১) কেন্দ্রীয় আইনসভা অর্থাৎ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের (রাজ্যসভা এবং লোকসভা) নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ।
- (২) প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত (বিধায়ক) সদস্যবৃন্দ।
- (৩) ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৭০তম সংবিধান-সংশােধনী আইনের সাহায্যে ৫৪ নং এবং ৫৫ নং ধারা সংশােধন করে জাতীয় রাজধানী ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত দিল্লি ও পুদুচেরির বিধানসভার নির্বাচিত (বিধায়কগণ) সদস্যবৃন্দ উপস্থিত থাকে। যদিও এই আইনটি কার্যকরী হয়ে ওঠে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন থেকে।
নির্বাচনী সংস্থায় উপস্থিত প্রত্যেক সদস্যরা একটি করে ভোট প্রদান করে থাকেন, তার ভোটের মূল্য সবক্ষেত্রে সমান নয়। বিভিন্ন রাজ্যে যে ভোট মূল্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যদের ভোটে মূল্য রাজ্য আইনসভার সদস্যদের ভোটের মূল্যের সঙ্গে সমান নাও হতে পারে।
নির্বাচনে অনুসৃত নীতি: নির্বাচনের ব্যাপারে দুটি নীতি অনুসৃত হয়ে থাকে―
- রাজ্য আইনসভা গুলির ভোটের ব্যাপারে সমতা যাতে রক্ষিত হয়, এই ব্যাপারটা প্রথমেই দেখা হয়।
- পার্লামেন্টের বা সংসদের মোট ভোট সংখ্যার সঙ্গে রাজ্য আইনসভা গুলির মােট মােট সংখ্যার সমতা যাতে নির্বাচন পদ্ধতির ক্ষেত্রে বজায় থাকে। এ ছাড়াও মােট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকের বেশি যদি কোনাে প্রার্থী না পান তাহলে সেই প্রার্থী রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হতে পারেন না।
আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধানের অনুকরণে গৃহীত উপরােক্ত পদ্ধতিগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য ৫৪ ও ৫৫ নং ধারায় নির্বাচনের জন্য কতকগুলি পর্যায়ের উল্লেখ আছে। সেগুলি নিম্নে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হল।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রথম পর্যায়
বিধানসভার সদস্যদের ভোটমূল্য নির্ধারণ : প্রত্যেক সদস্যের একটি করে ভোট থাকে। তবে ভােটমূল্য সবক্ষেত্রে সমান হয় না। বিভিন্ন রাজ্যে এই মূল্য বিভিন্ন হতে পারে। নিম্নলিখিত পদ্ধতি অনুসারে রাজ্য আইনসভার সদস্যদের ভোটে মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। সর্বশেষ জনগণনা থেকে প্রাপ্ত ওই রাজ্যের মােট জনসংখ্যাকে ওই রাজ্যের আইনসভার নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যা দ্বারা ভাগ করার পর ভাগফলকে পুনরায় ১০০০ দিয়ে ভাগ করার পর ভাগফল যা হবে, তাই হবে ওই রাজ্যের একজন বিধায়ক বা আইনসভার একজন নির্বাচিত সদস্যের ভারতের মূল্য।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়
পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোট মূল্য নির্ধারণ : দ্বিতীয় পর্যায়ে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের (সাংসদ) ভোট সংখ্যা নির্ধারণ করার জন্য সকল রাজ্য আইনসভার সদস্যদের ভোটে মােট মূল্যকে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের নির্বাচিত সদস্যদের মােট সংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে যে ভাগফল পাওয়া যায়, তাই হল পার্লামেন্টের এক-একজন সদস্যের ভোটের মূল্য।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার তৃতীয় পর্যায়
ভােটগ্রহণ পদ্ধতি : রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তৃতীয় পদ্ধতি হল ভোটদান পদ্ধতি। গােপন ব্যালটের মাধ্যমে সদস্যগণ তাদের পছন্দ মতো প্রার্থীর সপক্ষে ভােট দেন। এই পদ্ধতিকে বলা হয় একক হস্তান্তরযােগ্য সমানুপাতিক ভোট দানের পদ্ধতি (Proportional Representation by means of a single Transferable vote)
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যতজন প্রার্থী থাকেন, একজন ভোটার ততগুলি ভোট দিতে পারেন। ভোটদানের নির্বাচন পত্র বা ব্যালটে প্রার্থীদের নামের পাশে তার পছন্দ অনুসারে ১,২,৩,৪ ইত্যাদি সংখ্যা লিখে ভােট দেন। মনে রাখতে হবে ভােটদাতাকে তার ১ম পছন্দ জানাতেই হয়, তা না করলে ভােটপত্র বাতিল বলে ঘােষিত হয়। ভােটদাতা ২ পছন্দ, ৩ পছন্দ নাও জানাতে পারেন। এইভাবে নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর ভোট গণনা শুরু হয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ার চতুর্থ পর্যায়
ভোট গণনা পদ্ধতি: এক্ষেত্রে সকল নির্বাচন প্রার্থীর প্রথম পছন্দের বৈধ ভােটগুলি গণনা করা হয়। এরপর প্রথম পছন্দের মােট বৈধ ভােট সংখ্যাকে ২ দিয়ে ভাগ করে ভাগফলের সঙ্গে ১ যােগ করতে হয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া পঞ্চম পর্যায়
ভোট হস্তান্তর: প্রথম গণনাতেই যদি কোনাে প্রার্থী অন্ততপক্ষে কোটা সংখ্যক ভোট পেয়ে যান তবে তাকে বিজয়ী বলে ঘােষণা করা হয়। তা না হলে দ্বিতীয় পছন্দের ভোটে গণনা শুরু হয়। এই পর্যায়ে যিনি সবচেয়ে কমসংখ্যক প্রথম পছন্দের ভোট পেয়েছেন তাকে নির্বাচন থেকে বাদ দিয়ে তার প্রাপ্ত ভােটগুলি দ্বিতীয় পছন্দ অনুসারে অবশিষ্ট প্রার্থীদের মধ্যে হস্তান্তর করে দেওয়া হয়। এর ফলে যদি কেউ কোটা পেয়ে যান তবে তাকে নির্বাচিত বলে ঘােষণা করা হয়। না হলে একই পদ্ধতিতে তৃতীয় পর্যায়ের গণনা শুরু হয় এবং কোনাে প্রার্থী কোটা না পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। এইভাবে এক জটিল পদ্ধতি অনুসারে পরােক্ষভাবে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে কোনাে বিরোধ তৈরি হলে সুপ্রিমকোর্ট তার মীমাংসা করতে পারে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতির ত্রূটি
(১) রাষ্ট্রচিন্তাবিদদের মতানুসারে, ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতিকে কখনােই সমানুপাতিক বলা চলে না কারণ, কমপক্ষে দুটি আসন ছাড়া সমানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রয়ােগ করা সম্ভব নয়। এরজন্যই এম পি শৰ্মা তাঁর ‘The Government of the Indian Republic‘ গ্রন্থে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন যে, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি সমানুপাতিক না বলে নির্বাচন পদ্ধতিকে বিকল্প বা পছন্দমাফিক’ ভাট ব্যবস্থা বলাই ভালাে।
(২) এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটির আর-একটি ত্রুটি হল এই প্রক্রিয়াটি অতিমাত্রায় জটিল, কারণ পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে কোনাে দল যদি একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় এবং বহুদলীয় ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বহু প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়, তাহলে এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন জটিল হয়ে যায়।
মূল্যায়ন: রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে কোনাে আইনি প্রশ্ন তােলা যায় না, তাঁর কাজের জন্য আদালতে জবাবদিহি করতে হয় না। তাই এককথায় বলা যেতে পারে যে, কার্যত ভারতের রাষ্ট্রপতি কি আইনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়েছে।