ভূমিকা: দেশের সংকটপূর্ণ অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য সরকারের হাতে বিশেষ ক্ষমতা থাকা দরকার। তাই সকল দেশেই জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের হাতে বিশেষ কতকগুলি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই ধরনের ক্ষমতার আরও বেশি প্রয়ােজন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত থাকে। বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দ্বারা দেশের আপৎকালীন অবস্থা বা সংকটজনক অবস্থার মােকাবিলা করা সম্ভব হয়। ভারতের সংবিধান-প্রণেতাগণ এ বিষয়ে অবহিত ছিলেন বলেই তারা মাননীয় রাষ্ট্রপতির হাতে আপকালীন অবস্থা মােকাবিলা করার জন্য সংবিধানের ৩৫২, ৩৫৬ এবং ৩৬০ নং ধারানুযায়ী তিন ধরনের জরুরি ক্ষমতা তার হাতে অর্পণ করেছেন।
জরুরি অবস্থার সংজ্ঞা: জরুরি অবস্থার সংজ্ঞা সম্পর্কে ভারতের সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয়নি। এ বিষয়ে ড. ঠাকুরদাস ভার্গব বলেছিলেন, জরুরি অবস্থার সঠিক সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভব নয়। গণপরিষদেও এ বিষয়ে মতৈক্য গড়ে ওঠেনি। তবে কে ভী রাও তার ‘Parliamentary Democracy of India’ গ্রন্থে জরুরি অবস্থা বলতে কী বােঝায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তার মতে, জরুরি অবস্থা বলতে এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতিকে বােঝায়, যখন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ অনিবার্য বলে বিবেচিত হয়। ভারতীয় সংবিধানের অষ্টাদশ অধ্যায়ে (৩৫২, ৩৫৬ এবং ৩৬০ নং ধারা) এই সম্পর্কে বিশদ আলােচনা করা হয়েছে।
জরুরি অবস্থার শ্রেণিবিভাগ
(A) জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘােষণা :
[1] সংজ্ঞা: জরুরি অবস্থা বা আপৎকালীন অবস্থার ঘােষণা বলতে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সশস্ত্র বিদ্রোহজনিত কারণে জারি করা অবস্থাকে বােঝায়। সংবিধানে ৩৫২ (১) নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিদ্রোহ ঘটলে বা ঘটার আশঙ্কা দেখা দিলে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। মূল সংবিধানে বলা আছে যে, যে-কোনাে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি এই ঘােষণা জারি করতে পারেন। ৪৪তম সংবিধান-সংশােধনী আইনে বলা হয়েছে যে, কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার লিখিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারেন তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তার এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আদালতে কোনাে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না।
[2] তিনবার জাতীয় জরুরি অবস্থা প্রায়াগ: এখনও পর্যন্ত তিনবার জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। প্রথমবার ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে চিনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিয়ে বিরােধের সময়, দ্বিতীয়বার ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান কর্তৃক আক্রমণের সময় এবং তৃতীয়বার ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে অভ্যন্তরীণ গােলযােগের কারণে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এখনও পর্যন্ত ভারতের কোনাে অংশে আংশিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি।
[3] জাতীয় জরুরি অবস্থার অনুমোদন: জরুরি অবস্থা ঘােষণা সংসদের উভয় কক্ষে পৃথকভাবে এক মাসের মধ্যে অনুমোদন করা প্রয়ােজন। এরজন্য প্রতিটি কক্ষে মােট সদস্যের অর্ধেক ও উপস্থিত সদস্যের ২/৩ অংশের সমর্থন লাগে। এই ঘােষণাটি অনুমােদিত না হলে এক মাস পরে ঘােষণাটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়। জরুরি অবস্থা ঘােষণার সময় যদি লোকসভা গঠিত থাকে তাহলে ঘােষণাটিকে রাজ্যসভায় এক মাসের মধ্যে অনুমােদিত হতে হয়।
[4] জাতীয় জরুরি অবস্থার মেয়াদ: জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘােষণার ১ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের মােট সদস্যের অর্ধেক এবং উপস্থিত ও ভোট দানের সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের দ্বারা অনুমােদিত হতে হয়, না হলে ঘােষণাটি বাতিল হয়ে যায়। অনুমোদিত হওয়ার পর ঘোষণা ৬ মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকে। সংসদ প্রয়ােজন মনে করলে ৬ মাস – ৬ মাস করে ঘােষণার মেয়াদ বাড়াতে পারে। তবে এক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা সর্বাধিক কত দিন পর্যন্ত বলবৎ রাখা যাবে, সে বিষয়ে সংবিধানে কিছু উল্লেখ করা নেই।
[5] জাতীয় জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার: রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা হলে একটি পৃথক ঘোষণার মাধ্যমে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে পারেন [৩৫২ (২) নং ধারা ]। তা ছাড়া লােকসভা জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার সম্পর্কিত কোনাে প্রস্তাব পাস করলে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে হয় [ ৩৫২ (৭) ধারা ]।
[6] জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘােষণার ফলাফল:
- রাজ্যের শাসনব্যবস্থার পরিচালনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকার গুলির নির্দেশ দিতে পারে। এই সময় ভারতের শাসনব্যবস্থা কার্যত এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
- কেন্দ্রীয় আইনসভা প্রয়ােজনে রাজ্যতালিকাভুক্ত বিষয়ে আইন প্রণয়ণ করতে পারে এবং রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করতে পারেন।
- সংবিধানের ১৯নং ধারায় উল্লিখিত স্বাধীনতার অধিকার গুলি স্থগিত থাকে বা সাময়িকভাবে অকার্যকর থাকে।
- নাগরিকের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হলে আদালতে যাওয়ার অধিকারকে (৩২ ও ২২৬নং ধারা) রাষ্ট্রপতি একটি ঘোষণার দ্বারা স্থগিত রাখতে পারেন। এর ফলে নাগরিকের সব মৌলিক অধিকার স্থগিত হয়ে যায়। তবে কোন ভাবে ২০ ও ২১ নং ধারায় উল্লিখিত ব্যক্তিস্বাধীনতা ও জীবনের অধিকারকে স্থগিত রাখা যাবে না (১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৪৪ তম সংবিধান-সংশােধন অনুযায়ী)।
- পার্লামেন্ট আইন করে রাজ্য বিধানসভার মেয়াদও এক বছর বৃদ্ধি করতে পারে।
[7] জাতীয় জরুরি অবস্থার সমালােচনা:
- জাতীয় জরুরি অবস্থার ঘােষণা সম্পূর্ণরূপে ত্রুটিমুক্ত নয়, কারণ এই ব্যবস্থা গণতন্ত্রসম্মত নয়। জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে কি না তা দেখার অধিকার আদালতের থাকে না।
- এই ব্যবস্থা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধী, কারণ এই ব্যবস্থায় আইন, শাসন ও আর্থিক ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্য গুলির উপর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাধান্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(B) রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা শান্তি ঘোষণা:
সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারায় রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংক্রান্ত ঘােষণা ও তার ফলাফল সম্পর্কে উল্লেখ আছে। এই ঘােষণাকে রাজ্যভিত্তিক জরুরি অবস্থা বা রাষ্ট্রপতির শাসন (President’s Rule) I
[1] সংজ্ঞা: কোনাে রাজ্যের রাজ্যপাল যদি এই মর্মে নিজে অথবা অন্য কোনাে সূত্রে প্রাপ্ত রিপাের্টের ভিত্তিতে সন্তুষ্ট হন যে, সেই রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সংবিধান অনুসারে পরিচালিত হচ্ছে না বা পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছে না, তাহলে তিনি উক্ত রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বা জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারেন। রাষ্ট্রপতি মূলত প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতেই এই ধরনের ঘােষণা করেন। অনেক সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৩৫৬ নং ধারায় উল্লিখিত আছে যে, কোনাে রাজ্য সরকার যদি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ না মানে কিংবা মানতে ব্যর্থ বা অক্ষম হয় তাহলে রাষ্ট্রপতি সেইসকল রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা বলবৎ করতে পারেন। তবে ৪৪তম সংবিধান-সংশােধনী আইনে এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়েছে।
[2] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা গ্রায়াগ: শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘােষণা এযাবৎ বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অনেকবার প্রয়ােগ করা হয়েছে।
[3] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা সংসদ অনুদান: শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘােষণার ২ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অর্থাৎ লোকসভা ও রাজ্যসভায় পৃথকভাবে এই ঘোষণা অনুমােদন করাতে হয়। যদি ঘােষণাটি অনুমােদিত না হয় তাহলে ২ মাস পরে তা অকার্যকর বলে বিবেচিত হয়। এই ঘােষণার সময় লোকসভা গঠিত বা ডিসলভড অবস্থায় থাকলে বা দু-মাসের মধ্যে বিগঠিত হলে সেই ঘােষণাটি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ অর্থাৎ রাজ্যসভায় অনুমােদন করিয়ে নিতে হয়। নবগঠিত পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভার ৩০ দিনের মধ্যে ঘােষণাটি অনুমােদিত না হলে ঘােষণাটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়।
[4] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার মেয়াদ: শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ঘােষণাটি অনুমােদিত হলে এই জরুরি অবস্থা প্রথমে ছ-মাস এবং সংসদ পুনরায় অনুমােদন করলে আরও ছয়-মাস অর্থাৎ সর্বাধিক ১ বছর বলবৎ থাকে।
[5] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ব্যতিক্রম: দেশে যদি নির্বাচন করার মতাে পরিস্থিতি না থাকে বা দেশে যদি জরুরি অবস্থা জারি থাকে তাহলে এই ধরনের জরুরি অবস্থার মেয়াদ ১ বছরের বেশি হতে পারে। তবে তা কোনােভাবেই ৩ বছরের বেশি হবে না।
[6] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার ফলাফল:
- সংশ্লিষ্ট রাজ্যের যাবতীয় সরকারি কাজ রাষ্ট্রপতি নিজে পালন করতে পারেন কিংবা রাজ্যপাল বা দায়িত্বশীল কোনাে ব্যক্তির হাতে দায়িত্বভার অর্পণ করতে পারেন।
- সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদকে বরখাস্ত করা হলে, সেই ঘােষণা সংসদে অনুমােদিত না হওয়া পর্যন্ত বিধানসভা ভেঙে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের অনুমােদনের সাপেক্ষে লোকসভার অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে সঞ্চিত তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের জন্য অর্থবরাদ্দের নির্দেশ পর্যন্ত দিয়ে থাকেন।
- শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা ঘােষণা করার ফলে রাজ্যের হাইকোর্টের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি যেমন নিজের হাতে নিতে পারেন না, তেমনি হাইকোর্টের ক্ষমতার কোনাে পরিবর্তনও তিনি করতে পারেন না।
[7] শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার সমালােচনা:
- কোনাে রাজ্যে সত্যই শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে কি না সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকেই চুড়ান্ত বলে বিবেচনা করা হয়, তার ফলে রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ক্ষুন্ন হয়।
- অনেক সমালােচকগণ এই ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিবিরােধী বলে বর্ণনা করেছেন।
- রাষ্ট্রপতি ৩৫৬ নং ধারানুযায়ী শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি করলে কেন্দ্রের শাসকগণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য রাজ্য সরকারকে অন্যায়ভাবে উৎখাত করার চেষ্টা করে। এই কারণেই এইরূপ শাসনব্যবস্থাকে গ্রহণ করা সম্ভবপর নয়।
- সংবিধানের ৩৫৬ নং ধারা রাজ্যগুলির স্বাধিকারের বিরােধী। এই ধারার ভিত্তিতে কেন্দ্র কোনাে রাজ্য সরকারকে ভাঙার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট রাজ্যকে এমন নির্দেশ দান করতে পারে, যা সেই রাজ্যের পক্ষে সম্ভব নয়। এই কেন্দ্রীয় নির্দেশ না মানার কারণে সেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়।
(C) আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা:
সংবিধানের ৩৬০ নং ধারায় রাষ্ট্রপতিকে অর্থনৈতিক কারণে আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘােষণার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
[1] সংজ্ঞা: সংবিধানের ৩৬০নং ধারায় আর্থিক জরুরি অবস্থার কথা বলা হয়েছে। দেশের সমস্ত অংশে বা কোন অংশে আর্থিক স্থায়িত্ব বিপন্ন হলে বা অর্থ সংক্রান্ত কোনাে সুনাম নষ্ট হলে, রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘােষণা করতে পারেন। আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হয়।
[2] আর্থিক জরুরি অবস্থার প্রয়াগ: আর্থিক জরুরি অবস্থা ঘােষণার নিয়মকানুন সংবিধানের ৩৬০ (২) নং ধারায় বিশদে উল্লিখিত আছে। তবে ভারতে এখনও পর্যন্ত একবারও আর্থিক জরুরি অবস্থা জারি করা হয়নি।
[3] আর্থিক জরুরি অবস্থার অনুমোদন: দু-মাসের মধ্যে এই ঘােষণা পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে অনুমােদিত হওয়া দরকার। তা যদি না হয় তাহলে এই ঘােষণা বাতিল বলে গণ্য হয়।
[4] আর্থিক জরুরি অবস্থার মেয়াদ: এক্ষেত্রেও এই ঘােষণার মেয়াদ সাধারণত দুই মাস। তবে এই দুই মাসের মধ্যে সংসদ দ্বারা অনুমােদিত এই ঘােষণা ছয় মাস পর্যন্ত কার্যকরী থাকে। সংসদ চাইলে ছয় মাস করে মেয়াদ বৃদ্ধি করা যায়।
[5] আর্থিক জরুরি তার ফলাফল:
- আর্থিক জরুরি অবস্থা বলবৎ থাকাকালীন সময়ে কেন্দ্র রাজ্যগুলিকে নির্দিষ্ট আর্থিক নীতি পালনের নির্দেশ দিতে পারে।
- রাজ্য আইনসভা কর্তৃক গৃহীত সকল অর্থবিল রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য কেন্দ্র সরকার সংরক্ষণের নির্দেশ দিতে পারে। এর ফলে রাষ্ট্রপতি সমস্ত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা হ্রাস করার নির্দেশ দিতে পারেন।
- রাষ্ট্রপতি সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের বেতন ও ভাতা সাময়িকভাবে হ্রাস করার নির্দেশ দিতে পারেন।
[6] আর্থিক জরুরি অবস্থার সমালােচনা:
- আর্থিক জরুরি অবস্থা কতদিন পর্যন্ত চালু থাকবে সেই ব্যাপারে শাসনতন্ত্রে কিছু উল্লেখ করা নেই।
- কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি আর্থিক জরুরি অবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারেন, যার ফলে রাজ্যে আর্থিক স্বাতন্ত্র বিরােধিতার সম্মুখীন হয়।
পর্যালােচনা: সমালােচকদের মতে, ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামােতে রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘােষণা আদৌ কাম্য নয়। কেননা এর ফলে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাচার এবং এককেন্দ্রিক শাসন কায়েম হয়। এর ফলে রাজ্যের স্বাতন্ত্র্য ক্ষুগ্ন হয় এবং কেন্দ্রীয় সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এই ক্ষমতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা লিখিতভাবে সুপারিশ করলে তবেই রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায় যে, দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী অশুভ শক্তিসমূহের মােকাবিলা, জাতীয় সংহতি ও ঐক্য সংরক্ষণ, পরিকল্পিত পথে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং দেশের শাসনব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য জরুরি অবস্থা সম্পর্কিত বিধিব্যবস্থার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। অধ্যাপক আইভর জেনিংসের ভাষায় বলা যায়, ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, জরুরি অবস্থার সময় কোনাে কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা একমাত্র স্বাধীন জনগণের হাতেই থাকে (“It is the lesson of history that the only effective control during emergency is in the hands of a free people.”)