ভূমিকা: ভারতের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির প্রকৃত ভূমিকা ও পদমর্যাদা সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা নেই। তাই রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্ককেন্দ্রিক প্রশ্নগুলি হল ভারতের শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি কি প্রকৃত শাসক? নাকি তিনি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান? তিনি কি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য? মূলত সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পর থেকে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এইসব প্রশ্ন নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়। যাইহােক, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সম্পর্ক আলােচনা করলে রাষ্ট্রপতির প্রকৃত শাসনতান্ত্রিক ভূমিকা ও পদমর্যাদার পরিচয় পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ও পদমর্যাদা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দুটি ধারা বা গােষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যেমনㅡ
- (A) বাস্তববাদী সংবিধান বিশেষজ্ঞ গােষ্ঠী (Political School) এবং
- (B) তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী বিশেষজ্ঞ গােষ্ঠী (Legal School)।
(A) বাস্তববাদী বিশেষজ্ঞ গােষ্ঠী
বাস্তববাদী সংবিধান বিশেষজ্ঞ গােষ্ঠী মনে করে ভারতের রাষ্ট্রপতি গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির মতাে একজন নিয়মতান্ত্রিক নামসর্বস্ব শাসক প্রধান মাত্র। এই গােষ্ঠীর মতগুলি হলㅡ
(1) মন্ত্রীসভার দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করে: শাসনতন্ত্রের বিধিবদ্ধ নিয়মকানুনের সঙ্গে প্রচলিত প্রথা রীতিনীতিকে যুক্ত করে বিচারবিশ্লেষণ করা উচিত। তাহলে শাসনব্যবস্থার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যাবে। ব্রিটেনের মতাে ভারতবর্ষের সংবিধানের ৭৫ (৩) নং ধারায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা শাসনকার্য পরিচালনার জন্য লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। লোকসভার কাছে এই দায়িত্বশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে,সংবিধানে মন্ত্রিসভা কে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। অধ্যাপক ভি শান্তানম বলেছেন, সংবিধানে মন্ত্রিসভা কি প্রকৃত কর্ণধার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
(2) রাষ্ট্রপতির হাতে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অনুপস্থিতি: সংবিধানের ৫৩ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি তাঁর শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুসারে প্রয়ােগ করতে বাধ্য। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের গভর্নর জেনারেল পদকে অনুসরণ করে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা স্থির করা হয়েছে, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে গভর্নর জেনারেলের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়নি।
(3) সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: সংবিধানের ৭৪নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি একটি মন্ত্রীসভা গঠন করতে বাধ্য। রাষ্ট্রপতি খুশিমতো যে-কোনাে মন্ত্রীসভা গঠন করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারেন না। কারণ, মন্ত্রীসভার সদস্যদের সংসদের সদস্য হতে হয় এবং লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। আবার পার্লামেন্টের বিশেষত লোকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করতে হয়। তা না হলে শাসনতান্ত্রিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে।
(4) রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান: সংবিধানের ৪২তম এবং ৪৪তম সংশােধন আইন অনুসারে বর্তমানে তার নিজস্ব বিচার বিবেচনা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনার সুযােগ নেই। সংশোধিত ৭৪(১) নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করতে বাধ্য। আবার যদি সংসদে পাঠানাে কোনাে বিলে রাষ্ট্রপতি সম্মতি না দিয়ে বিলটিকে পুনরায় বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠান তাহলে সেই বিলটি সংসদের উভয় কক্ষে যথা রাজ্যসভা ও লােকসভায় পুনরায় গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি সেই বিলে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য থাকেন। রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকলেও রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতা নেই।
(5) মন্ত্রীসভা গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: ড. বি আর আম্বেদকরের মতে, রাষ্ট্রপতি লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট মন্ত্রীসভার পরামর্শ অগ্রাহ্য করতে কার্যত পারেন না। পরামর্শ অগ্রাহ্য করলে মন্ত্রীসভা পদত্যাগ করবে। তখন রাষ্ট্রপতিকে আরও একটি মন্ত্রীসভা গঠন করতে হবে কিন্তু আগের মন্ত্রীসভার পিছনে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন ছিল তাই সংবিধান-সম্মতভাবে আরও একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া পরিস্থিতি অনুকূল হলে ইমপিচমেন্টের সাহায্যে মন্ত্রীসভা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে তার পদত্যাগের ব্যবস্থা করতে পারে।
(6) সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নামসর্বস্ব: সংবিধান অনুসারে শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত মন্ত্রীসভার সকল সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেন। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মন্ত্রীসভা, রাষ্ট্রপতি নন।
(7) মন্ত্রীসভার সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির জরুরি ক্ষমতা সীমিত: অধ্যাপক এম পি শর্মা মতানুসারে জরুরি অবস্থাতেও রাষ্ট্রপতিকে মন্ত্রীসভার পরামর্শক্রমে কাজ করতে হয়। মন্ত্রীসভার লিখিত প্রস্তাব ছাড়া জরুরি অবস্থা জারি করা যায় না [ ৩৫২ (৩) নং ধারা ]। রাষ্ট্রপতির যে-কোনাে ধরনের জরুরি অবস্থা ঘোষণা এক মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে উপস্থিত করতে হয়। এরজন্যই ভােটদানকারী দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের অনুমোদন প্রয়ােজন হয়। তা যদি না হয় তাহলে ঘোষণা বাতিল বলে বিবেচিত হয়।
(8) পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন: জনগণের ভোটে রাষ্ট্রপতি সরাসরি নির্বাচিত হন না বলেই রাষ্ট্রপতি জনপ্রতিনিধিত্বের দাবি উত্থাপন করতে পারেন না। এই কারণেই রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নামসর্বস্ব, অপরদিকে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভার ভূমিকা এখানে প্রকৃত বলে বিবেচিত হয়।
(B) তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী সংবিধান বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠী
তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসী সংবিধান বিশেষজ্ঞ গােষ্ঠী মনে করে যে, রাষ্ট্রপতি দেশের প্রকৃত শাসক। তিনি ইচ্ছা করলে সকল ক্ষমতা নিজে প্রত্যক্ষভাবে প্রয়ােগ করতে পারেন। এরজন্যই গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতির তুলনা চলে না। তাদের যুক্তিগুলি নিম্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হল –
(1) শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতার অধিকারী রাষ্ট্রপতি: সংবিধানের ৫৩ (১) নং ধারা অনুসারে শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত। তিনি প্রত্যক্ষভাবে বা অধস্তন কর্মচারীদের মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন। আবার ৭৪ (১) নং ধারা অনুসারে, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভা রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কার্য পরিচালনায় পরামর্শ দেরে ও সাহায্য করবে।
(2) সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: ভারতের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীসভার সম্পর্কের বিষয়টি পুরােপুরি গ্রেট ব্রিটেনের সংসদীয় ব্যবস্থার অনুগামী নয়, ব্রিটেনে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় মন্ত্রীর স্বাক্ষর ছাড়া রাজা বা রানির নির্দেশ বিধিসম্মত হয় না। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীদের সম্মতি ছাড়াই শুধুমাত্র বিভাগীয় সচিবের স্বাক্ষরের সাহায্যে তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পারেন, এক্ষেত্রে মন্ত্রীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য নয়।
(3) অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে এই জারি করা অর্ডিন্যান্সটিকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে পার্লামেন্টে পেশ করতে হয়। পার্লামেন্টের দ্বারা অনুমােদিত না হলে এই অধ্যাদেশ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।
(4) মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: ব্রিটেনে মন্ত্রীদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতবর্ষের সংবিধান অনুসারে এই ক্ষমতা ভােগ করেন রাষ্ট্রপতি। এক্ষেত্রে ব্রিটেনের রাজা-রানির সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রপতির তুলনা চলে না।
(5) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: ব্রিটেনের শাসনতান্ত্রিক প্রধান রাজা-রানির পদ হল বংশানুক্রমিক, অন্যদিকে ভারতের রাষ্ট্রপতির পদ বংশানুক্রমিক নয়। তিনি কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভার প্রতিনিধিদের দ্বারা পাঁচ বছরের জন্য সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত হন। যে কারণে ভারতের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে নামসর্বস্ব শাসক বলে অভিহিত করা সঠিক নয়।
(6) সংবিধানকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: সংবিধানের ৬০ নং ধারানুসারে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধান রক্ষার জন্য শপথ গ্রহণ করতে হয়। এখন মন্ত্রীসভা যদি সংবিধান লঙ্ঘিত হতে পারে বলে এমন কোনাে পরামর্শ রাষ্ট্রপতিকে দেয় তাহলে সেই পরামর্শ তাে রাষ্ট্রপতি অগ্রাহ্য করতেই পারেন। যেমন ১৯৯৭ এবং ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে ৩৫৬ নং ধারা জারির জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সুপারিশ এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য ঘটনা বলে বিবেচিত হয়। বাস্তববাদী ধারণায় বিশ্বাসীরা সংবিধানের বিভিন্ন ধারা বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। তাদের মতে, রাষ্ট্রপতি হলেন নিয়মতান্ত্রিক শাসকপ্রধান, অপরদিকে তাত্ত্বিক ধারণায় বিশ্বাসীরা মনে করেন রাষ্ট্রপতি হলেন দেশের প্রকৃত শাসকপ্রধান।
(7) রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসকপ্রধান: পার্লামেন্টের আস্থা হারালে মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করা, লোকসভায় সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী মনােনয়ন, তদারকি মন্ত্রীসভা গঠন, লোকসভা ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা, প্রতিরক্ষাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন প্রভৃতি রাষ্ট্রপতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার পরিচায়ক। অধ্যাপক কে এম মুন্সী প্রমুখ তাই রাষ্ট্রপতিকে স্বাধীন ক্ষমতা ও স্বাধীন কর্তৃত্ব-সহ একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যক্ত করেছেন।
উপসংহার: তবে ভারতের রাষ্ট্রপতি কে কেবলমাত্র নামসর্বস্ব সাক্ষীগােপাল হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। রাষ্ট্রপতি হলেন সংবিধানের রক্ষাকর্তা এবং জাতির প্রতীক। রাষ্ট্রপতির প্রভাব-প্রতিপত্তি ও পদমর্যাদা অনেকাংশে নির্ভর করে পদাধিকারীর জ্ঞান, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ব্যক্তিত্বের উপর এবং যা সংকটকালীন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভিত্তি উপর নির্ভরশীল। পরিশেষে ড. রাধাকৃয়াণের বক্তব্য উল্লেখ করে বলা যায়, রাষ্ট্রপতি জাতীয় উদ্দেশ্য এবং জাতীয় একতা প্রতিকায়িত করেন এবং সংহতি ও বিকাশের জন্য তিনি প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেন (“The President symbolises national purpose and national unity and can be a great influence for stability and progress.”)। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের সংবিধানের ৪২তম সংশােধনের ফলে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভার পরামর্শমতাে চলতে বাধ্য। তবে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা বা অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে বা অবস্থাভেদে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ বা লােকসভা ভেঙে দেওয়ার মতাে দু-একটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্ববিবেচনা প্রয়ােগের সুযােগ এখনও ভােগ করে থাকেন।