ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রী হলেন ভারতের প্রকৃত শাসকপ্রধান। ইংল্যান্ডের সংসদীয় শাসনব্যবস্থার অনুকরণে ভারতেও সংসদীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতীয় শাসনব্যবস্থা তথা রাজনীতির ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিপত্তির বর্তমান অবস্থা অধ্যাপক জোহারি প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতি করা (Presidential Nisation of the Prime Minister) বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেট ও মন্ত্রীপরিষদের মূল ভিত্তি। তিনি পার্লামেন্টের নেতা। ভারতীয় সংবিধানের ৭৪ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতিকে তাঁর কার্যাবলি সম্পাদনের ক্ষেত্রে সাহায্য ও পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে। তার শীর্ষে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী। (“There shall be a Council of Ministers at the head to aid and advise the President.”)।
প্রধানমন্ত্রীর গুরুত্ব: প্রধানমন্ত্রীর উপরই মন্ত্রীদের রাজনৈতিক ভাগ্য অনেকাংশে নির্ভরশীল। তিনি ক্যাবিনেটের প্রধান হিসেবে ক্যাবিনেট সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীই হলেন সরকার ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে প্রধান সংযােগসূত্রকারক। ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রকৃতই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। অনেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে তাই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী, এমনকি মার্কিন রাষ্ট্রপতির থেকেও অধিক ক্ষমতাশালী বলে মনে করেন।
প্রধানমন্ত্রীর নিয়ােগ, যােগ্যতা ও কার্যকাল
সংবিধানের ৭৫ (১) নং ধারানুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে অন্যান্য মন্ত্রীদের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করেন। বলাবাহুল্য, পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নেতা হিসেবে যাকে নির্বাচিত করে, রাষ্ট্রপতি তাঁকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। আবার পার্লামেন্টের সদস্য নন এমন কে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হলে তাকে ৬ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কোনাে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের নেতা বা নেত্রী কে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানাতে পারেন।
সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর যােগ্যতার ব্যাপারে কোনাে কিছু তেমনভাবে উল্লেখ করা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই পার্লামেন্টের যে-কোনাে কক্ষের সদস্য হতে হবে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী তার পদে ৫ বছর বহাল থাকতে পারেন। কিন্তু জরুরি অবস্থার সময় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভার মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যকালও বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর মাসিক বেতন ১,৬৫,০০০ টাকা এবং সরকারি সুযােগসুবিধা ভােগ করে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি
সংবিধানের ৭৪নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রপতির পরামর্শদাতা এবং মন্ত্রীপরিষদের নেতা হলেন প্রধানমন্ত্রী। এর বাইরে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে কিছু বলা নেই। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলির প্রকৃতি ও পরিধি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকাকে অনুসরণ করেই নির্ধারিত হয়। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলির প্রকৃত পরিচয় জানার জন্য রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভা, পার্লামেন্ট তাঁর নিজের দল এবং জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক আলােচনা করা দরকার।
(১) রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের মাধ্যমূপে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের ক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রী হলেন সংযােগসাধনের প্রধান মাধ্যম। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার সমস্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে জানান। রাষ্ট্রপতিকে মন্ত্রীদের নিয়ােগ এবং অপসারণ সংক্রান্ত পরামর্শ প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকে। লোকসভার অধিবেশন আহ্বান করা, স্থগিত রাখা বা ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত কাজকর্মগুলি রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমেই করে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য হল সরকারের সমস্ত খবরাখবর রাষ্ট্রপতিকে নিয়মিত জানানাে। মন্ত্রীসভার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, আইনের বিভিন্ন প্রস্তাব ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি যা জানতে চান সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে জানান। এইভাবেই প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সরকারের সংযােগ সাধনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে কাজ করে থাকেন।
(২) মন্ত্রীসভার অন্যান্য মন্ত্রীদের মনােনীত করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: প্রথাগত বিচারে সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্য বলে অভিহিত করা হলেও প্রধানমন্ত্রী হলেন মন্ত্রীসভার নেতা। মন্ত্রীসভার উপর তাঁর প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি বিরােধ-বিতর্কের উর্ধ্বে। ৭৫ নং ধারা অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য মন্ত্রীদের মনােনীত করেন এবং তাদের মধ্যে দপ্তর বণ্টন করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুগ্রহভাজন হলে রাজনৈতিক প্রভাব ছাড়াও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার ঠাই পাওয়া যায়।
মন্ত্রীসভার পুনর্গঠন, দপ্তর পুনর্গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর প্রভূত ক্ষমতা রয়েছে। তিনি যে-কোনাে মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বলতে পারেন বা রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে পদচ্যুত করাতে পারেন। আবার তিনি নিজে পদত্যাগ করে নতুন করে মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন কোনাে মন্ত্রী মন্ত্রীসভায় টিকে থাকতে পারেন না।
মন্ত্রীসভার সভাপতি এবং বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়কারী হিসেবেও প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেট তােরণের ভিত্তিস্বরূপ। বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকেই সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সরকার বলতে কার্যত এখানে প্রধানমন্ত্রীকে বােঝানাে হয়েছে। তবে মন্ত্রীসভা গঠনের সময় প্রধানমন্ত্রীকে আঞ্চলিক, ধর্মীয়, ভাষাগত, শ্রেণিগত, সম্প্রদায়গত প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের প্রতিনিধিত্বের কথা বিবেচনা করতে হয়
(৩) ক্যাবিনেটের সভায় সভাপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকে সহযােগিতা ও পরামর্শদানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্র সংগঠনটি গঠিত হয়, তা-ই ক্যাবিনেট নামে পরিচিতি লাভ করে। বলাবাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্যাবিনেটের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব, যিনি এই সভায় সভাপতিত্ব করে থাকেন। এই সভায় সরকারের যাবতীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। এ কথাও বলা যায় যে, ক্যাবিনেটে প্রধানমন্ত্রীর বিরাগভাজন কোনাে মন্ত্রী যেমন স্থিতিশীল থাকতে পারেন না, তেমনই প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কোনাে সিদ্ধান্ত এই সভায় গৃহীত হতে পারে না। বলাবাহুল্য, প্রধানমন্ত্রীকে ক্যাবিনেটের এক প্রধান স্তম্ভ বলে অভিহিত করা হয়।
(৪) রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর যা পরিচয় পাওয়া যায় তার থেকে বােঝা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং রাজনৈতিক দলের প্রতিও প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। দল যাতে প্রসারিত হয়, দলের ঐক্য এবং অখণ্ডতা যাতে অক্ষুন্ন থাকে, নির্বাচনী যুদ্ধে যাতে দলের সাফল্য ঘটে সেদিকে লক্ষ রেখেই প্রধানমন্ত্রীকে দলের নীতি ও কার্যক্রম নির্ধারণ করতে হয়। নির্বাচনের পরেও দলের নীতি ও কার্যক্রমকে যাতে জনসমর্থনের অনুকূলে রাখা যায়, তার জন্য তাঁকে বিভিন্নভাবেই যেমন— সাংবাদিক সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে, বেতার ও দূরদর্শনে বক্তৃতার মধ্য দিয়ে জনসংযোগ বজায় রাখার চেষ্টা করতে হয়। দলীয় নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর এই ভূমিকার উপরই দলের সাফল্য বহুলাংশে নির্ভরশীল।
(৫) পার্লামেন্টের নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রী শুধু দলেরই নেতা নন, তিনি হলেন পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ তথা লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। তিনি হলেন সরকারের নীতির মুখ্য প্রবক্তা। সভার সমস্ত কাজকর্ম তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আইন প্রণয়ন, নীতি নির্ধারণ, স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা রচনা ইত্যাদি সরকারের যা কিছু পার্লামেন্ট কর্তৃক সম্পন্ন হয় সেগুলো সব কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তিনি লোকসভার সদস্য হলেও রাজ্যসভার অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিভিন্ন ব্যাপারে পার্লামেন্টের বিরােধী দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি আলােচনা ও মতবিনিময় করে থাকেন, যাতে পার্লামেন্টে গৃহীত সিদ্ধান্ত দলীয় সিদ্ধান্ত না হয়ে প্রকৃতই জাতীয় সিদ্ধান্তে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন পার্লামেন্টের সরকারের মুখ্য প্রতিবেদক। যে-কোনাে কক্ষে উপস্থিত হয়ে তিনি আলােচনায় যােগ দিতে পারেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে কর্তৃত্বমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি বিরােধী সদস্যদের রক্ষক অভিভাবক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
(৬) বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর উপর থাক বা না থাক, অপরাপর রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রীয় দপ্তরের মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং নির্দেশাদি প্রদান করেন। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যােগাযােগ রাখতে হয়। বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের খবরাখবর রাখেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যােগাযােগ রক্ষা করে চলেন। বিভিন্ন দেশ সফর করেন, বিভিন্ন সম্মেলনে যােগ দেন। সার্ক, আসিয়ানের মতাে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ক্ষেত্রে ভারতের প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। এইভাবেই সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষের বৈদেশিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে গড়ে তােলার জন্য সচেষ্ট থাকেন।
(৭) প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের মধ্যে সংযােগ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ও দেশবাসীর নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিদেশে তিনিই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে মর্যাদালাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী জনগণের মধ্যে নিজের ও তার দল সম্পর্কে একটা আকর্ষণীয় ভাবমূর্তি গড়ে তােলেন। সভা-সমিতির মাধ্যমে তিনি জনগণের সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখেন। বস্তুত ব্যক্তিত্ব, গুণগত যােগ্যতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এমনকি জনগণের সংকটকালীন অবস্থায় একজন প্রশাসনিক জাতীয় নেতা হিসেবে নেতৃত্বদানের উপর প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা বহুলাংশে নির্ভরশীল থাকে।
(৮) মন্ত্রীদের পথনির্দেশক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: বিভিন্ন মন্ত্রকের বিভিন্ন সরকারি নীতির মধ্যে সংযোগ ও সমন্বয়সাধন করাই হল প্রধানমন্ত্রীর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্য। সেইজন্য তাকে বিভাগীয় মন্ত্রীদের বিভিন্নভাবে নির্দেশ দিতে হয় এবং সাধারণভাবে সমস্ত বিভাগের কাজকর্মের উপর নজর রাখতে হয়।
(৯) অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা: দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য উল্লিখিত কার্যাবলি ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর আরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। তিনিই ভারতবর্ষের পরিকল্পনা কমিশনের এবং আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান। এই সমস্ত কমিটি, কমিশন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির কথাও তিনি ভাবেন।
প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা
উপরোক্ত আলোচনার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী হলেন অধিক ক্ষমতাশালী ও প্রতিপত্তির অধিকারী। ভারতের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সুবিশাল কর্তৃত্ব ও নানাবিধ ভূমিকা গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ভারতে যে শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে, তা মন্ত্রীপরিষদচালিত বলেই পরিচিত নয়, তা প্রধানমন্ত্রী চালিত শাসন ব্যবস্থা নামেই বেশি প্রচলিত। অনেকের মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার রাষ্ট্রপতির চেয়েও অধিক ক্ষমতাশালী, কারণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির দরুন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই সীমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ভারতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রচলন ঘটেনি বলেই প্রধানমন্ত্রী শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের সর্বেসর্বা বলে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পেরেছেন। তাই সবদিক বিচার করে বলা যায় যে, বর্তমান ভারতের শাসনব্যবস্থা মূলত প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতার এই প্রবণতাকে অধ্যাপক জোহারি ‘প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বলাবাহুল্য, কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে শাসকদলের সাংগঠনিক অবস্থা প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগের পরিধিকে সম্প্রসারিত করতে পেরেছে। এর ফলস্বরূপ, ক্যাবিনেট ব্যবস্থা একটা আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। বলেই যৌথ দায়িত্বের পরিবর্তে একক দায়িত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, প্রধানমন্ত্রীর বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা, কর্মকুশলতা এমনকি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অন্যদের থেকে বেশি থাকে বলে প্রধানমন্ত্রীই হলেন অধিক ক্ষমতার অধিকারী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যেসব ব্যক্তিত্বের কৃতিত্ব ও কর্তৃত্বের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে তারা হলেন জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধী ও অটলবিহারি বাজপেয়ী।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামােদরদাস মোদি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন। অ্যাসকুইথ বলেছেন, পদাধিকারী কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর পদটিকে ব্যবহার করবেন, তার উপরই নির্ভর করবে প্রধানমন্ত্রীর পদটি কেমন হবে (The office of the Prime Minister is what its holder chooses to make it.”)।
মূল্যায়ন: ভারতীয় সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর বিপুল ক্ষমতার উৎস বলে বিবেচিত হয়। ভারতে সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও প্রভাব কার্যত তাকে একনায়ক পরিণত করেছে। বর্তমানে (২০১৮ খ্রি.) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামােদরদাস মোদি সাধারণত মন্ত্রীসভার পরিবর্তে তার নিজের আস্থাভাজন ব্যক্তি এবং নিজস্ব সচিবালয়ের পদস্থ আমলাদের সাহায্যে সরকারি নীতি নির্ধারণ ও তার প্রয়ােগের ব্যবস্থা করে থাকেন। যেমন স্বচ্ছ ভারত অভিযান, প্রধানমন্ত্রী জনধন যােজনা, ক্যাশলেস অথবা স্মার্ট সিটি প্রকল্প, বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ নীতি, দুর্নীতি রােধ ও কালাে টাকার বিরুদ্ধে বিমুদ্রাকরণ (Demonetization) এবং সর্বোপরি পণ্য ও পরিষেবা কর (Goods and Services Tax) নীতি গ্রহণ প্রভৃতি। অনেকে এই ব্যবস্থাকে প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র বলার পক্ষপাতী।