ভূমিকা: ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে স্বাধীনতা লাভের পর গৃহীত হয়। এই কারণেই কেন্দ্র ও রাজ্যে বিকেন্দ্রীভূত দ্বৈত শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ফলস্বরূপ ভারতের প্রশাসনিক ব্যবস্থা দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যথা কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাঠামােয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তথা সচিবালয় বিশেষ গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশাসন- রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়গুলি, ক্যাবিনেট, ক্যাবিনেট কমিটি ইত্যাদিকে নিয়ে গঠিত হয়।
অধ্যাপক আভাস্তি এবং মাহেশ্বরী তাদের ‘Public Administration’ গ্রন্থে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় নামে পরিচিত ছিল। পরাধীন ভারতের প্রশাসনিক প্রধান গভর্নর জেনারেলের ব্যক্তিগত সচিবের হাত থেকে কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব অবিলম্বে গ্রহণ করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের উৎপত্তি ঘটে।
প্রশাসনিক সংগঠনের ক্ষমতায় কেন্দ্রীয় সচিবালয় শীর্ষস্থানে অবস্থান করে। এই মন্ত্রণালয়ের সংগঠনের সাধারণ কাঠামােটি নিম্নে আলােচনা করা হলㅡ
- মন্ত্রী, অস্থায়ী রাজনৈতিক প্রধান এক বা একাধিক উপমন্ত্রীদের সাহায্য গ্রহণ করে বিভাগীয় সংগঠন বা মন্ত্রণালয়কে পরিচালনা করে থাকেন।
- সচিব, রাজনৈতিক প্রধান, স্থায়ী মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আমলাতন্ত্রের প্রধান এবং একজন মন্ত্রীর বিশেষ বা অতিরিক্ত সচিব থাকতে পারে, আবার প্রয়ােজনে বিষয়গত যুগ্ম-সচিবও থাকতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, উপ-সচিব এবং সহকারী সচিবদের নিয়ে গঠিত হয়।
- প্রতিটি কার্যালয়ের একজন করে শাখাপ্রধান (অধীনস্থ সচিব) থাকে। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত সহায়ক, স্টেনােগ্রাফার অফিসারদের জন্য পিওন ও শাখা কার্যালয়ের জিনিসপত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কর্মচারী প্রমুখ বহাল থাকে।
কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে বিভিন্ন ধরনের সচিব থাকেন, যথা – (1) সচিব, (2) অতিরিক্ত সচিব, (3) যুগ্ম-সচিব, (4) উপ-সচিব, (5) সহকারী সচিব, এমন ৩ জন সেক্রেটারি অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবকে নিয়ে সর্বোচ্চ পরিচালন এবং দুটি উপ-সচিব এবং সহকারী অধীনস্থ সচিব মিলে মধ্য পর্যায়ের পরিচালক গঠন করে থাকে।
জওহরলাল নেহরু সর্বপ্রথম ড. গােপালস্বামী আয়েঙ্গারকে তাঁর মুখ্য সচিবের পদে নিযুক্ত করেন। আয়েঙ্গার শুধুমাত্র মুখ্য সচিব হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেননি, তিনি নেহরুর মুখ্য পরামর্শদাতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মাহেশ্বরীর মতে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দীর্ঘ শাসনকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বা দপ্তর সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকে। কার্যত অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রধান পরামর্শদাতা রূপে পরিচিত মুখ্য সচিব প্রধানমন্ত্রীর কাজ ও ক্ষমতা নির্ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে কাকে নিয়োগ করা হবে তা প্রধানমন্ত্রীর সচিব স্থির করে থাকেন। জরুরিকালীন অবস্থার সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের ক্ষমতা অধিক বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এই সময় সাধারণ নির্বাচনে মোরারজি দেশাই-এর নেতৃত্বে ভারতের জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাদের প্রথম পদক্ষেপই ছিল প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া। এর ফলে প্রশাসনিক ব্যাপারে ও গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়গুলিতেও এই অফিসই প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে পারবে। কিন্তু নীতি নির্ধারণের কোনাে ভূমিকা এই অফিসের না থাকলেও এই কার্যালয়ের বা কর্মীসংস্থার কাজ হবে প্রধানমন্ত্রীকে প্রশাসনিক ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় সাহায্য করা। এইভাবে মোরারজি দেশাইয়ের সময় থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে সংকুচিত ক্ষমতায় কাজ করতে হয়। কেন্দ্রীয় সচিবালয় বা কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামাের ক্ষেত্রে এটা এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে ইন্দিরা গান্ধি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হলে এই ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যদিও ইন্দিরা গান্ধীই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় রূপান্তরকে বহাল রাখেন। এই কার্যালয়ের রূপান্তর। হওয়ার ফলে সচিবালয় যে প্রচুর ক্ষমতা ভােগ করে তার অবসান হতে শুরু করল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রধান কাজ
(1) প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের প্রধান হিসেবে বিভিন্ন সরকারি কাজ সম্পাদনে ও রূপায়ণে সাহায্য এবং সহযােগিতা করা, যদিও সবই প্রতিষ্ঠিত সরকারি পদ্ধতির কাঠামাের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে।
(2) ভারতে বিদেশি লগ্নি থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির উত্থান ও পতন সকল বিষয়ই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়। রাজনীতি, অর্থনীতি বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলিও নরসিমহা রাও এই কার্যালয়ের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিক থেকে বলা যায় রাওয়ের আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অতীতের সচিবালয়ের রূপ ধারণ করেছিল কারণ এই কার্যালয়কে যুকমাের্চার স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশ অনুসারে কাজ করতে হত।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের নির্বাচন এবং পরবর্তী দুটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে কেন্দ্রে বহু দলের ভিত্তিতে পুনরায় সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গুরুত্ব অনেকটা কমে যায়, কারণ বর্তমানে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জাতীয় গণতান্ত্রিক মাের্চা এক গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হওয়ার ফলে ইন্দিরা গান্ধী নরসিমহা রাও এর আমলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অপরিসীম ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামােতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।