ভূমিকা: সংসদীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য অনুসারে শাসন বিভাগের উপর আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় পার্লামেন্টের দুটি কক্ষের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি সদস্য সংখ্যা বিশিষ্ট লোকসভা সদস্যগণ (৫৪৫ জন) প্রত্যক্ষভাবে এবং কম সদস্যবিশিষ্ট রাজ্যসভার সদস্যগণ (২৫ ० জন) পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন। কার্যত মন্ত্রীপরিষদ (মন্ত্রীসভা) বা সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণে লোকসভার প্রধান ভূমিকা পালন করে।
(1) মন্ত্রিসভা বা সরকারের গঠন লোকসভা সমর্থনের উপর নির্ভরশীল: সরকার গঠন থেকে শুরু করে তার কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ এবং কার্যকাল পার্লামেন্টের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। মন্ত্রীসভার গঠন সম্পূর্ণরূপে পার্লামেন্টের উপর নির্ভরশীল আর এই নির্ভরশীলতা রাজ্যসভা নয় লোকসভা উপর নির্ভর করে। কারণ রাজ্যসভায় কোনাে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে কি নেই তার উপর মন্ত্রীসভা বা সরকার গঠন নির্ভর করে না, লোকসভায় যে দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দল বা জোট সরকার গঠন করে। সেই জোট বা দলের নেতা বা নেত্রী কে রাষ্ট্রপতি মন্ত্রীসভা বা সরকার গঠনে আহ্বান জানান।
(2) মন্ত্রীপরিষদ (মন্ত্রীসভা) বা সরকারের কার্যকাল লোকসভার আস্থার উপর নির্ভর করে: সংবিধান অনুসারে মন্ত্রীপরিষদ বা সরকারের মেয়াদ হল ৫ বছর। কিন্তু মন্ত্রীসভা বা সরকার ৫ বছর ক্ষমতায় আসীন থাকতে পারবে কিনা তা নির্ভরশীল লোকসভা সমর্থন বা আস্থার উপর। সংবিধানের ৭৫ (৩) নং ধারা অনুসারে মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে লোকসভার নিকট দায়িত্বশীল। কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে লােকসভায় মন্ত্রীপরিষদের পরাজয় ঘটে এবং অনাস্থা ভােটে হেরে গেলে সমগ্র মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়। তাই মনে রাখতে হবে যে, লোকসভায় যতদিন শাসকদলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে, মন্ত্রীপরিষদও ততদিন ক্ষমতায় আসীন থাকবে।
(3) সরকারের আয় ব্যয়ের উপর সংসদীয় নিয়ন্ত্রণ: ভারতের সরকারি আয় ব্যয়ের উপর পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণকে সংবিধানে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। পার্লামেন্টের সমর্থন ব্যতীত সরকার কোনােপ্রকার কর ধার্য বা করের হার পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের ২৬৩ (৩) নং ধারানুযায়ী পার্লামেন্টের আইনি অনুমােদন ব্যতীত সরকার ভারতের সাত তহবিল থেকে কোনােরূপ অর্থ ব্যয় করতে সক্ষম হয় না।
(4) অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: লােকসভায় মন্ত্রীপরিষদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সরকারকে অপসারণের চেষ্টা করতে পারে। লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেলে এটাই প্রমাণিত হয় যে, মন্ত্রীসভার উপরে লোকসভার আর কোনাে আস্থা নেই, শাসকদল সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়।
(5) বিভিন্ন প্রস্তাবের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ: পার্লামেন্টের উভয় ক্ষে মন্ত্রীসভা কি জবাবদিহি করতে হয়। পার্লামেন্টের সদস্যগণ রাজ্যসভা কিংবা লোকসভায় বিভিন্ন প্রশ্ন ও প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। যেমন মুলতুবি প্রস্তাব, দৃষ্টি আকর্ষণীয় প্রস্তাব, অধিকার ভঙ্গের প্রস্তাব ইত্যাদি। তা ছাড়া সরকারের অর্থ মঞ্জুরির দাবি লােকসভা প্রত্যাখ্যান করতে বা তার পরিমাণ হ্রাস করতে পারে। পার্লামেন্টের অনুমােদন ছাড়া সরকার এক কপর্দক ব্যয় করতে পারে না বা কর ধার্য করতে পারে না। তা ছাড়া বাজেট বা কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বিল লোকসভায় প্রত্যাখ্যাত হলে মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হয়।
(6) আর্থিক ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের (লোকসভার) নিয়ন্ত্রণ: আর্থিক ক্ষেত্রেও ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার হাতে আর্থিক বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। আর্থিক বিষয়ে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ বলতে কার্যত লোকসভার নিয়ন্ত্রণকেই বােঝায়। লোকসভা আনুমানিক ব্যয় কমিটি, সরকারি গাণিতিক কমিটি এবং ভারতের মহানিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের মাধ্যমে সরকারি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে থাকে, তা ছাড়া অর্থ কমিশনের রিপাের্টও পার্লামেন্টে পেশ করা হয়, পার্লামেন্টের অনুমােদন ছাড়া কোনাে সুপারিশ কার্যকর হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সরকারি মঞ্জুরিকৃত অর্থ ঠিকভাবে ব্যয়িত হয়েছে কি না তা দেখার জন্য পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সরকারি গাণিতিক কমিটি উপস্থিত রয়েছে।
এ ছাড়াও শাসন বিভাগ কর্তৃক গৃহীত অন্যান্য কিছু ব্যবস্থা যেমন জরুরি অবস্থা ঘােষণা, রাজ্যে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা জারি প্রভৃতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘােষিত হলেও পার্লামেন্ট সেই ঘােষণা অনুমােদন না করলে অনির্দিষ্টকাল তা কার্যকর থাকে না। আর-একভাবেও সরকার বা মন্ত্রীসভাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই পদ্ধতি হল সরকার তার প্রতিশ্রুতি যথাযথভাবে পালন করছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা। এরজন্য ভারত সরকারের যে কমিটি আছে তার নাম হল সরকারের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কমিটি। এই কমিটি পার্লামেন্টের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়।
মূল্যায়ন: উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, আইনগত দিক থেকে পার্লামেন্ট মন্ত্রীপরিষদ (মন্ত্রীসভা) বা সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করে। পার্লামেন্টে মন্ত্রীসভা গঠন থেকে শুরু করে তার কার্যকালের মেয়াদ সব কিছুই নির্ভর করে লােকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার উপর।