ভূমিকা: ভারতের সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় সরকারি আর্থিক ব্যয় হিসাব বা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হল সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি বা সরকারি গাণিতিক কমিটি। এই কমিটির উদ্দেশ্যই হল সরকারি ব্যয়ের সকল ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতার নীতি বজায় রাখা। অধ্যাপক পাইলি বলেছেন, সরকারি গাণিতিক কমিটিকে আনুমানিক ব্যয় হিসাবপরীক্ষা কমিটির যমজ ভাই নামে অভিহিত করা হয় (The Public Accounts Committee is the twin brother of the Estimates.)। এই নামকরণের পক্ষে যুক্তি হল আনুমানিক ব্যয় হিসাব কমিটি সরকারি ব্যয় বরাদ্দের দাবি পরীক্ষা করে এবং সরকারি গাণিতিক কমিটি সরকারের ব্যয় পদ্ধতি ও ব্যয়ের ফলাফল পর্যালােচনার মধ্যেই নিজের কার্যাবলিকে সীমাবদ্ধ রাখে।
সরকারি হিসাব পরীক্ষা কমিটি গঠন
ব্রিটিশ আমলে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের হিসাবপরীক্ষা কমিটি বা গাণিতিক কমিটি গঠিত হয়েছিল। স্বাধীন ভারতেও এই কমিটি তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। প্রথমে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৫ জন ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা হল ২২ জন। লােকসভা থেকে ১৫ জন সদস্য একক হস্তান্তরযােগ্য সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয় এবং রাজ্যসভা থেকে ৭ জন সদস্য রাজ্যসভা কর্তৃক সহযােগী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়। কোনাে মন্ত্রী এই কমিটির সদস্য হতে পারেন না। লােকসভার স্পিকার সরকারি হিসাব পরীক্ষা কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে ১ জনকে কমিটির চেয়ারম্যান পদে মনােনীত করেন। এই কমিটির সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ১ বছর বলে নির্ধারিত করা হয়।
সরকারি হিসাব পরীক্ষা কমিটির ক্ষমতা ও কার্যাবলি
সরকারি অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় হয়েছে কি না সেই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কমিটি যে-সমস্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে, সেগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一
- প্রথমত: সরকারের যাবতীয় ব্যয় এবং আর্থিক লেনদেনের হিসাব পরীক্ষা করাও এই কমিটির একটি মূল কাজ।
- দ্বিতীয়ত: এই কমিটি বিনিয়োগ হিসাব, পার্লামেন্টের কাছে পেশ করা যাবতীয় হিসাব অর্থাৎ পার্লামেন্ট কর্তৃক অনুমােদিত ব্যয় বরাদ্দ এবং সরকার প্রকৃতপক্ষে যে ব্যয় করেছে, তা পরীক্ষা করে দেখে এই কমিটি।
- তৃতীয়ত: সরকারি গাণিতিক কমিটি নিয়ন্ত্রক ও মা গণনা পরীক্ষকের পেশ করা ব্যয় বরাদ্দ হিসাবের পদ্ধতি যেমন পরীক্ষা করে দেখে তেমনি বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, স্বয়ংশাসিত সংস্থা এবং আধা-স্বয়ংশাসিত সংস্থার আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ ও লাভক্ষতির বিষয়ও পরীক্ষা করে দেখে।
- চতুর্থত: সরকারি হিসাব পরীক্ষা কমিটির আরও একটি উল্লেখযােগ্য কাজ হল পার্লামেন্ট যে উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অর্থ বরাদ্দ করেছে সেই অর্থ সঠিক খাতে যথাযথভাবে ব্যয়িত হচ্ছে কি না তা অনুসন্ধান করে দেখা।
- পঞ্চমত: সংসদ বা পার্লামেন্ট দপ্তরকে যে পরিমাণ অর্থ মঞ্জুর করেছে, সেই দপ্তরের দায়িত্বশীল আধিকারিকগণ সেই অর্থ ভারতের সঞ্চিত তহবিল থেকে তুলেছেন কি না, তাও দেখা সরকারি গাণিতিক কমিটির একটি উল্লেখযােগ্য কাজ।
- ষষ্ঠত: সরকারের কোনাে বিভাগ ধার্য অর্থের অপচয় ঘটাচ্ছে কি না তা দেখাও এই কমিটির অন্যতম কাজ বলে বিবেচিত হয়।
সরকারি ব্যয়ের হিসাব পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ক্ষেত্রে এই কমিটি মূলত তিনটি বিষয় খতিয়ে দেখে। যথা- (a) যে উদ্দেশ্যে এবং যে খাতে পার্লামেন্ট ব্যয় অনুমােদন করেছে তা যথাযথ অনুসরণ করা হয়েছে কি না। (b) যোগ্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা ব্যয় সংঘটিত হয়েছে কি না এবং (c) যোগ্য কর্তৃপক্ষের দ্বারা রচিত নিয়মানুসারে ব্যয় করা হয়েছে কি না সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি তাও খতিয়ে দেখে। সরকারি ব্যয়ের হিসাবপরীক্ষায় কোনাে অনুমােদিত ব্যয় ধরা পড়লে কমিটি তার কারণ ও যুক্তি বিচার করে সুপারিশ প্রদান করে এবং লোকসভার দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে।
সরকারি হিসাব পরীক্ষা কমিটির সীমাবদ্ধতা
সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটির ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা পালন করলেও, এই কমিটির কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়─
- (1) সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি ব্যয় সংক্রান্ত নীতি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। কমিটির কাজ ব্যয়ের পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
- (2) কমিটি শুধুমাত্র ব্যয়ের ত্রুটিবিচ্যুতিগুলির উপর মন্তব্য প্রকাশ করতে পারে। কোনাে বিষয়ের জন্য নির্দিষ্ট ব্যয় করে এই কমিটি কখনােই বাতিল করতে পারে না।
- (3) কমিটি সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বিভাগীয় প্রশাসনকে সঠিকভাবে পর্যালােচনা করে উঠতে পারে না।
- (4) কমিটির প্রতিবেদন বিচারবিশ্লেষণ করার মতাে সময়, সাধ্য বা ইচ্ছা পার্লামেন্টের হাতে থাকে না বলে এই কমিটি তার কার্য সম্পাদনে বাধার সম্মুখীন হয়।
উপসংহার: সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটির কার্যাবলি পর্যালােচনা করে বলা যায় যে, এই কমিটি সরকারের ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি বা গাণিতিক কমিটির কার্যকলাপ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কমিটির মতামত ও সুপারিশ পার্লামেন্টে আলােচিত ও সমালােচিত হয়। সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি সরকারের আয় ব্যয়ের দোষ ত্রুটি বিচারবিশ্লেষণ করে। তার ফলে সরকার সংযত থাকতে বাধ্য হয়, এই কমিটি প্রয়ােজনে বিভিন্ন ব্যক্তিকে সাক্ষ্যদানের জন্য আহ্বান করতে পারে। প্রয়ােজনীয় দলিল বা নথিপত্র পাঠানাের জন্য সরকারি দপ্তরকে নির্দেশ দিতে পারে। এই কমিটি শুধু হিসাবপরীক্ষা করে না, সরকারি নীতি রূপায়ণ সম্পর্কে অনুসন্ধান কার্য পরিচালনা করে। বিরােধীদল এই কমিটির প্রতিবেদনকে সরকারের বিরুদ্ধে সমালােচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এককথায় সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি বা গাণিতিক কমিটি সরকারি ব্যয়ের শবব্যবচ্ছেদ (Post-mortem) এর দায়িত্ব পালন করে। এইভাবে সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি বা গাণিতিক কমিটি দেশের শাসনকার্যের উৎকর্ষতা এবং শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।