ভূমিকা: একবিংশ শতাব্দীর রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনীতির আলােচনায় সংসদ বা পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস একটি গুরুত্বপূর্ণ আলােচ্য বিষয় বলে পরিগণিত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংসদীয় ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসের বিষয়টি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষেও এই প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অনুকরণে গড়ে ওঠা ভারতের পার্লামেন্টের ক্ষমতা ব্রিটেনের পার্লামেন্টের মতােই নানা কারণে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রিত বা সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়ন, মন্ত্রীসভা গঠন নিয়ন্ত্রণ ও অপসারণ এবং সরকারি আয় ব্যয় নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হলেও বাস্তবে ভারতীয় পার্লামেন্ট প্রকৃত ক্ষমতা ভােগ করে না। সংবিধান বিশেষজ্ঞ কে সি হোয়ার এর ভাষায় (“…legislature has declined in certain respects and particularly in powers in relation to the executive.“)I
(১) সুশৃঙ্খল দলব্যবস্থার প্রাধান্য: ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাব বা প্রাধান্য, যা সংসদের ক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। লোকসভার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এককভাবে বা জোটবদ্ধভাবে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে থাকে। এর ফলে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতৃস্থানীয় নেতা বা নেত্রীর নির্দেশ অমান্য করা একজন সামান্য সাংসদের পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ তার পক্ষে দলীয় নির্দেশ অমান্য করা অসম্ভব। তিনি সকল প্রকার দলীয় সিদ্ধান্ত বিনা প্রতিবাদে মেনে চলেন, অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন দল বা কোয়ালিশনের নেতা বা নেত্রীর নির্দেশ দলীয় সাংসদরা বিনা বাক্যব্যয়ে গ্রহণ করেন। সমালােচকরা বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় সংসদ ক্ষমতাসীন দল বা জোটের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের যন্ত্রে রূপায়িত হয়েছে। এর ফলে সংসদের ভূমিকা ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়েছে।
(২) সংসদ সদস্যদের জ্ঞানের অভাব: ভারতে অনেক নেতা বা মন্ত্রীরা আছেন যাদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাগত যােগ্যতা বা কাজের অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি দক্ষতাও তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। পার্লামেন্টে যে কৌশলগত জ্ঞানের প্রয়ােজন হয় অনেকের মধ্যে তার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সুযােগে মন্ত্রীরাই সকলরকম আইন প্রণয়নের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকেন। এর ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা হ্রাস পায় অপরদিকে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মন্ত্রীদেরই একক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
(৩) অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা: কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা : থাকার ফলে পার্লামেন্টের প্রাধান্য অনেকাংশে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার আইন প্রণয়ন করে থাকে। রাষ্ট্রপতির জারি করা অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্সকে পরবর্তীকালে পার্লামেন্ট সম্মতি দিতে বাধ্য থাকে, এর পিছনে মূলত দলীয় রাজনীতির প্রভাব কাজ করেছে। অনেক সমালোচক মনে করেন, পার্লামেন্টের অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতি যে জরুরি আইন জারি করেন তার ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
(৪) সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা: ভারতীয় সংবিধানের রক্ষাকর্তা ও ব্যাখ্যা কর্তা হিসেবে পরিচিত সুপ্রিমকোর্টের কার্যকরী ভূমিকা নিঃসন্দেহে ভারতীয় পার্লামেন্টের ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে, কারণ আইনের বৈধতা বিচারের ক্ষমতা সুপ্রিমকোর্টের রয়েছে বলেই সুপ্রিমকোর্টকে সংবিধানের অতন্দ্র প্রহরী বলা হয়। এই ভূমিকা পালনের কারণেই পার্লামেন্টের আইন প্রণয়ন বা সংবিধান সংশােধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। সমালােচকদের মতে, সুপ্রিমকোর্ট বিভিন্ন মামলায় রায়দান করে পার্লামেন্টের ক্ষমতাকে কিছুটা হলেও হ্রাস করেছে। যেমন কেশবানন্দ ভারতী (১৯৭৩ খ্রি.) মামলার রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিমকোর্ট ঘােষণা করেছিল যে, সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তনের কোনাে ক্ষমতা পার্লামেন্ট ভােগ করতে পারে না।
(৫) অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইনের প্রভাব: বর্তমান সময়ে পার্লামেন্টকে বিভিন্ন ধরনের কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। এই কারণেই পার্লামেন্টের একার পক্ষে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, যার ফলে পার্লামেন্টের মূল নীতিগুলি নির্ধারণ করার দায়িত্ব শাসন বিভাগই পালন করে থাকে। এই নীতির ভিত্তিতে শাসন বিভাগ আইনের বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন, উপ-আইন, আদেশ বা নির্দেশ জারি করে। শাসন বিভাগ দ্বারা প্রণীত এই আইনকে অর্পিত ক্ষমতাপ্রসূত আইন বলা হয়। বর্তমান সময়ে এই আইনের প্রচলনের ফলে একদিকে যেমন ক্যাবিনেটের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপরদিকে পার্লামেন্টের ক্ষমতা বা মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।
(৬) জনগণের অনাস্থা: ভারতের সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় পার্লামেন্টের তুলনায় শাসন বিভাগের উপর জনগণ বেশি আস্থাশীল। বর্তমান সময়ে কেবিনেট বা মন্ত্রীসভা জনগণের আস্থার প্রতীক ও চাহিদাপূরণের কেন্দ্রস্থল। এই কারণেই নাগরিকরা তাদের ভালােমন্দ, সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযােগের জন্য শাসন বিভাগের কাছে দ্বারস্থ হয়। জনগণের এই মানসিকতাও পার্লামেন্টের মর্যাদা এবং ক্ষমতা হ্রাসের অন্যতম একটি কারণ।
(৭) প্রশাসনিক আদালতের ভূমিকা: ইংল্যান্ডের মতাে ভারতেও প্রশাসনিক আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে কর্মচারীদের বিরােধ নিষ্পত্তির জন্যই প্রশাসনিক আদালত চালু রয়েছে। যার ফলে মন্ত্রীসভার প্রভাব ও ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের হাতে বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে। এর ফলে পার্লামেন্টের ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
(৮) সদস্যদের আচার-আচরণ: সংসদীয় গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি বড়াে শর্ত হল আইনসভায় সরকারি এবং বিরােধীদলের মধ্যে পারস্পরিক বােঝাপড়া। কিন্তু কারণে-অকারণে যদি উভয়ের মধ্যে কোনাে বিষয়কে কেন্দ্র করে তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি হয় এবং তা যদি সংসদীয় রীতিনীতি লঙ্ঘন করে চরম অশােভন পর্যায়ে উপনীত হয়, তাহলে তা পার্লামেন্টের মর্যাদার পক্ষে হানিকর। তাই দেখা যায় যে, বর্তমানে কোনাে কোন সংসদে অসংসদীয় আচরণ পূর্বাপেক্ষা যথেষ্ট বৃদ্ধি পাওয়ায় পার্লামেন্টের মর্যাদা যথেষ্ট ক্ষুদ্র হয়েছে।
(৯) ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ: বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তথা মন্ত্রীসভার হাতে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে বলেই ভারতের শাসন ব্যবস্থা কার্যত প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। বাস্তবে প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের ক্ষমতা যতটা বৃদ্ধি পাচ্ছে পার্লামেন্ট তথা সংসদের ক্ষমতা ততটাই হ্রাস পাচ্ছে।
(১০) তথ্য প্রদানের ব্যাপারে সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য প্রদানের ব্যাপারে সরকারের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বা অর্ডিন্যান্স জারি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। রাজিব গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ঠক্কর কমিশনের রিপাের্ট বা অতীতে নেতাজি অন্তর্ধান কমিশনের সুপারিশ জনসাধারণের সামনে আনতে সরকার সদর্থক ভূমিকা পালন না করায় পার্লামেন্টের মর্যাদা প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়।
উপসংহার: ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামাে চালু হওয়ার ফলে সাংসদের থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বর্তমানে পার্লামেন্টকে অন্ধকারে রেখে বহু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বা হচ্ছে যেমন— অতি সম্প্রতি ডিমানিটাইজেশন এর সিদ্ধান্ত একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। অধ্যাপক জে সি জোহারির ভাষায়, (“..the cabinet…. can make use of the Parliament in repudiating the challenge of the Judiciary.”)I উপরোক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তত্ত্বগতভাবে ভারতে পার্লামেন্টের শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলেও বাস্তবে তা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে।