ভূমিকা: কেন্দ্রীয় সরকারের আইনসভা বা পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। এই দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অর্থাৎ পার্লামেন্ট ভারতীয় সংবিধানের ৭৯ নং ধারানুসারে রাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভা এবং লোকসভার নিয়ে গঠিত হয়েছে।
লোকসভা: ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নাম হল লােকসভা (House of the People)। এই সভা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই সভাকে জনপ্রতিনিধিসভাও বলা হয়ে থাকে।
লোকসভার গঠন
লোকসভা অনধিক ৫৫২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা সর্বাধিক ৫৩০ জন হতে পারে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও জাতীয় রাজধানী অঞ্চলের প্রতিনিধির সংখ্যা হল ২০ জন এবং রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত ইঙ্গ-ভারতীয় সদস্য সংখ্যা হল ২ জন। বর্তমানে লোকসভার সদস্য সংখ্যা ৫৪৫। এর মধ্যে ৫৩০ জন অঙ্গরাজ্যগুলি থেকে নির্বাচিত, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রতিনিধির সংখ্যা ১৩ জন এবং ২ জন ইঙ্গ-ভারতীয় প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনােনীত হন। জনগণ সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে গােপন ব্যালটের মাধ্যমে অঙ্গরাজ্যগুলির প্রতিনিধিগণকে নির্বাচন করে থাকেন। সংবিধানের ৩৩০ নং ধারানুযায়ী লোকসভার তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা আছে। বর্তমানে লোকসভার তপশিলি জাতির জন্য ৭৯টি আসন এবং তপশিলি উপজাতি দের জন্য ৪০টি আসন সংরক্ষিত রয়েছে।
লোকসভার প্রার্থীদের নির্বাচনের যােগ্যতা: লোকসভার নির্বাচিত হতে গেলে নির্বাচন প্রার্থীকে অবশ্যই—
- (a) ভারতীয় নাগরিক সদস্য হতে হবে,
- (b) ২৫ বছর বয়স্ক হতে হবে,
- (c) রাজ্য সরকার বা ভারত সরকারের কোনাে লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না,
- (d) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া, উন্মাদ এবং ভবঘুরে বলে ঘােষিত কোনাে ব্যক্তি লােকসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
লোকসভার প্রার্থী নির্বাচন পদ্ধতি: লোকসভার সদস্য বা এমপি (MP) গণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন।
লোকসভার সভাপতি: নবগঠিত লোকসভার সদস্যরা প্রথম অধিবেশনে নিজেদের মধ্য থেকে সভাপতি হিসেবে একজনকে অধ্যক্ষ বা স্পিকার হিসেবে নির্বাচন করেন এবং স্পিকারের অনুপস্থিতিতে একজনকে সহকারী অধ্যক্ষ বা উপাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচন করে থাকেন। লোকসভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন স্পিকার বা অধ্যক্ষ। তার অনুপস্থিতিতে উপাধ্যক্ষ সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
লোকসভার সভাপতির বেতন ও ভাতা: বর্তমানে লোকসভার স্পিকার রাজ্যসভার সভাপতির মতাে মাসিক ১,২৫,০০০ টাকা বেতন ও অন্যান্য সুযােগসুবিধা এবং অবসরকালীন পেনশন ভােগ করে থাকেন।
লোকসভার অধিবেশন: রাষ্ট্রপতি পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের (লােকসভা/রাজ্যসভা) বা যে-কোনাে কক্ষের অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। কোনাে বিলের উপর মতবিরােধ তৈরি হলে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনের কাজকর্ম পরিচালনার জন্য কোরাম সংখ্যক সদস্যের উপস্থিতি আবশ্যক। কোরাম হল মােট সদস্যের এক-দশমাংশের উপস্থিতি।
লোকসভার সদস্যদের কার্যকাল: লোকসভার কার্যকালের মেয়াদ হল ৫ বছর। তবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি লােকসভা ভেঙে দিতে পারেন। আবার জরুরি অবস্থার সময় রাষ্ট্রপতি লোকসভার মেয়াদ প্রয়ােজনবােধে ১ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে পারেন।
লোকসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
(১) আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রধান কক্ষ হিসেবে পরিচিত লােকসভা আইন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালন করে থাকে। সংবিধানে আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে তিনটি তালিকায় বিভক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রতালিকার ক্ষেত্রে এককভাবে এবং যুগ্ম তালিকার ক্ষেত্রে অঙ্গরাজ্যগুলির সঙ্গে যুগ্মভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারে। এ ছাড়া রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়েও পার্লামেন্ট এককভাবে আইন প্রণয়ন করে। কোনাে কোনাে সময় সাধারণ বিলের ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভার মধ্যে বিরোধ বাধলে তা মীমাংসা করার জন্য রাষ্ট্রপতি উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশন আহ্বান করেন। লোকসভার সদস্য সংখ্যা বেশি বলে, যৌথ অধিবেশনেও লোকসভার মতামত গৃহীত হয়ে থাকে।
(২) অর্থ বিল সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লোকসভায় ভূমিকা: আইনের খসড়া রূপকে বলা হয় বিল। সাধারণ বিল পাসের ক্ষেত্রে লোকসভা ও রাজ্যসভা উভয় কক্ষ সমক্ষমতাসম্পন্ন তবে অর্থ বিলের ক্ষেত্রে লোকসভা চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। অর্থবিল কেবলমাত্র লোকসভায় উত্থাপিত হতে পারে। কোনাে বিল অর্থবিল কিনা সেই ব্যাপারে লোকসভার অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। লােকসভা কর্তৃক গৃহীত যে-কোনাে অর্থ বিল রাজ্যসভায় প্রেরিত হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে সেটিকে লোকসভায় ফেরত পাঠাতে হয়। এই সময়ের মধ্যে লোকসভায় ফেরত না এলে সংশ্লিষ্ট বিলটি উভয় কক্ষে গৃহীত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
এ ছাড়া বাজেট নিয়ে রাজ্যসভা আলোচনা করতে পারলেও ব্যয় মঞ্জুরি দাবি, বিনিয়োগ বিল পাস প্রভৃতি ব্যাপারে লোকসভায় চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। তা ছাড়া মঞ্জুরিকৃত অর্থ সঠিক খাতে ব্যয়িত হচ্ছে কিনা এবং সরকারি আয় ব্যয় ব্যবস্থা সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাহ হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য লােকসভা দুটি কমিটির তদারকি করে থাকে। এই কমিটি দুটি হল一
- (a) সরকারি হিসাবপরীক্ষা কমিটি (Public Accounts Committee),
- (b) আনুমানিক ব্যয় পরীক্ষা কমিটি (Estimates Committee)।
(৩) মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: মন্ত্রীসভা গঠনের ক্ষেত্রে লােকসভার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কোন্ দল বা জোট সরকার গঠন করবে তা নির্ভর করে লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনের উপর। রাষ্ট্রপতি লোকসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল বা জোটের নেতাকে মন্ত্রীসভা গঠনে আহ্বান জানান। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা লোকসভার কাছে কেবলমাত্র দায়বদ্ধ থাকে। লোকসভা যে-কোনাে মন্ত্রী বা মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে পারে এবং সেই প্রস্তাব যদি পাস হয় তাহলে সমগ্র মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়। এ কথা বলা যায় যে, লোকসভা আস্থার উপরই সমগ্র মন্ত্রীসভার অস্তিত্ব নির্ভর করে।
(৪) শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: লোকসভার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সমগ্র মন্ত্রীসভা-সহ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করা। প্রকৃতপক্ষে লোকসভার আস্থা হারালে মন্ত্রীসভার পতন ঘটে। সুতরাং লােকসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতা রক্ষা করা মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচিত হয়। কেননা সমগ্র মন্ত্রীসভা যৌথভাবে লোকসভার কাছে দায়িত্বশীল থাকে। শাসন বিভাগের কয়েকটি নিয়ন্ত্রণের উপায় হল一
- লোকসভার যে-কোনাে সদস্য যে-কোনাে বিষয়ে মন্ত্রীদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
- বাজেট প্রস্তুতির সময় লোকসভার বিরােধী পক্ষের সদস্যরা বাজেটের বিভিন্ন ত্রূটিবিচ্যুতি সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন।
- কঠোরভাবে বাজেট প্রস্তুতির সমালােচনা করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য সচেষ্ট হতে পারেন।
- সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকারের কাজের সমালােচনা বা মূল্যায়নও করতে পারেন।
(৫) নির্বাচন ও পদচ্যুতি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: লোকসভার গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন কয়েকটি কাজ হল一
- ভারতের রাষ্ট্রপতি এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।
- লোকসভার সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে স্পিকার স্পিকারকে নির্বাচিত করে থাকেন।
- এ ছাড়া লোকসভার সদস্য রাজ্যসভার সঙ্গে যৌথভাবে অপসারণ করতে পারে-সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রকৃত্যকের সভাপতি ও সদস্যদের, মুখ্য নির্বাচনী অফিসারকে, নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষককে, ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রধান ও সদস্যদেরকেও পদচ্যুত বা অপসারণ করতে পারে।
(৬) জরুরি অবস্থা জনিত ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে লােকসভা কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। লোকসভার এক-দশমাংশ সদস্যের অনুরােধক্রমে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিষয়ে সভায় আলােচনার ব্যবস্থা করা যায়। লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থনে লোকসভায় জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের কোনাে প্রস্তাব গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করতে পারেন।
(৭) বিচার সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লোকসভার ভূমিকা: রাজ্যসভার মতাে লোকসভা আইনসভার অবমাননা কিংবা অধিকার ভঙ্গের অভিযােগে সংশ্লিষ্ট কক্ষের সদস্য নন এমন যে-কোনাে ব্যক্তিকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করতে পারে।
(৮) সংবিধান-সংশোধনের ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: ভারতের সংবিধান-সংশােধনের ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মতো লোকসভা সমান ক্ষমতা ভােগ করে থাকে। বস্তুত উভয় কক্ষের সম্মতি ছাড়া ভারতের সংবিধান সংশোধন করা সম্ভব নয়।
(৯) নতুন রাজ্য গঠন ও পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে লোকসভার ভূমিকা: পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা এক্ষেত্রে রাজ্যসভার মতাে সমান ক্ষমতা ভােগ করে থাকে। যে যে ক্ষেত্রগুলিতে লোকসভা রাজ্যসভার মতাে সমান ক্ষমতা ভােগ করে, সেই ক্ষেত্রগুলি হল—নতুন রাজ্য গঠন, রাজ্য পুনর্গঠন অথবা কোনাে রাজ্যের সীমানার হ্রাসবৃদ্ধি, নাম পরিবর্তন প্রভৃতি।
(১০) অন্যান্য ক্ষমতার ক্ষেত্রে লোকসভা ভূমিকা: দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আলােচনার জন্য লোকসভার সদস্য বৃন্দ মুলতুবি প্রস্তাব, দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারে। তা ছাড়া ‘জিরো আওয়ারে’ সদস্যগণ ইচ্ছানুযায়ী যে-কোনাে বিষয় আলোচনা করতে পারেন। সদস্যগণ নিন্দাসূচক প্রস্তাবের মাধ্যমে কোনাে মন্ত্রী বা সামগ্রিকভাবে মন্ত্রীসভার কার্যাবলির সমালােচনা করতে পারেন।
মূল্যায়ন: তত্ত্বগতভাবে ভারতের কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার হাতে বিপুল ক্ষমতা অর্পণ করা হলেও বাস্তবে কার্যক্ষেত্রে লোকসভা সেই ক্ষমতা ভােগ করতে পারে না, কারণ আইন প্রণয়নে লোকসভা নয়, মন্ত্রীসভার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর প্রাধান্য বৃদ্ধির ফলে লোকসভার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টে শক্তিশালী বিরােধীদলের প্রভাবজনিত ঐক্যের অভাবে লােকসভা কার্যত শাসকদলের গৃহীত নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের হাতিয়ার বা মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। তবে বলা প্রয়ােজন যে, ভারতীয় সংবিধানে কোনাে কক্ষ যাতে এককভাবে পরিবর্তন করে নিজের ক্ষমতার পরিধি প্রসারিত করতে না পারে সেই ব্যবস্থা সংবিধানে গৃহীত হয়েছে।