ভূমিকা: ভারতে লোকসভার সভাপতিকে অধ্যক্ষ বা স্পিকার বলে অভিহিত করা হয়। ভারতের স্পিকারের পদমর্যাদা সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতির সমতুল্য বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন। জওহরলাল নেহরু বলেছেন, লোকসভার স্বাধীনতা ও সন্ত্রমের মূর্ত প্রতীক হলেন অধ্যক্ষ। প্রকৃতপক্ষে তিনিই লোকসভার সর্বোচ্চ পদ অলংকৃত করে থাকেন।
স্পিকারের নির্বাচন: স্পিকার বা অধ্যক্ষ লোকসভায় সভাপতিত্ব করেন। সংবিধানের ৯৩ নং ধারানুযায়ী ভারতে সাধারণ নির্বাচনের পর নবগঠিত লোকসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে স্পিকার পদে এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত করেন। মূলত, লোকসভায় যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সেই দলই নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে স্পিকার বা অধ্যক্ষ পদে প্রার্থী হিসেবে মনােনীত করে।
স্পিকার পদের যোগ্যতা: লোকসভার সদস্য হতে গেলে যেসব যােগ্যতা থাকা প্রয়ােজন, অধ্যক্ষকেও সেইসব যােগ্যতার অধিকারী হতে হয়।
স্পিকারের কার্যকাল ও পদচ্যুতি: স্পিকারের কার্যকাল পাঁচ বছর অর্থাৎ লোকসভার কার্যকালের সমান। তবে লোকসভা ভেঙে গেলেও নব-নির্বাচিত লােকসভার প্রথম অধিবেশন না বসা অবধি তাকে দায়িত্বে থাকতে হয়। তার কার্যকালের মধ্যে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। লােকসভা তার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব পাস করে তাকে পদচ্যুতও করতে পারে। তবে তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অনাস্থা প্রস্তাব আনতে গেলে লোকসভার অন্তত ১৪ দিন পূর্বে এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয়। অনাস্থা প্রস্তাব আলােচনা চলাকালে ডেপুটি স্পিকার লোকসভার কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
স্পিকারের বেতন ও ভাতা: স্পিকারের বেতন ও ভাতা সঞ্চিত তহবিলের ধার্য ব্যয়ের থেকে মেটানাে হয়। স্পিকারের বেতন রাজ্যসভার সভাপতির মতাে ১,২৫,০০০ টাকা এবং অন্যান্য সরকারি সুযােগসুবিধা পাবেন বলে ধার্য করা হয়।
স্পিকারের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
(1) প্রশাসনিক কার্যপরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা: লােকসভায় কোন্ কোন্ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে, কী ধরনের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হবে, কোনাে সংশােধনী প্রস্তাব বৈধ কি না, কোন্ কোন্ নােটিশ আলােচনার জন্য গৃহীত হবে ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। অধ্যক্ষের যে-কোনাে সিদ্ধান্তকে আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হয়।
(2) সভায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা: সভার শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব অধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত রয়েছে। কোন্ সদস্য আগে বক্তব্য রাখবেন, কোন্ সদস্য পরে বক্তব্য রাখবেন—তা তিনিই ঠিক করে দেন। কোনাে সদস্য আদৌ বক্তব্য রাখতে পারবেন কি না এবং পারলে কতক্ষণ রাখতে পারবেন, তা স্পিকারের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযােগে কোনাে সদস্যকে সাময়িকভাবে সভা থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ স্পিকার দিতে পারেন। এই নির্দেশ উপেক্ষা করলে মার্শাল বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে কক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। সভার নিয়মশৃঙ্খলা সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তিনি সভার কাজকর্ম সাময়িকভাবে মুলতুবিও রাখতে পারেন। এ ব্যাপারে তার কোনাে আচরণকে আদালতের এক্তিয়ারের মধ্যে এনে বৈধতার প্রশ্ন তােলা যায় ঊ। এ ছাড়া সভায় বক্তৃতা বা বিতর্কের সময় অশালীন মন্তব্য ও আপত্তিকর আচরণের জন্য স্পিকার যে-কোনাে সদস্যকে সংযত হওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।
(3) অর্থ বিলের ক্ষেত্রে ভূমিকা: সরকারের অর্থ সংক্রান্ত সমস্ত বিল লোকসভায় উত্থাপিত হয়। কোনাে বিল অর্থ বিল কি না এ সম্পর্কে কোনাে সংশয় দেখা দিলে, তার মীমাংসা স্পিকার কে করতে হয়। এ ব্যাপারে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। অর্থ বিলকে রাজ্যসভায় এবং রাষ্ট্রপতির নিকট পাঠানাের সময় ১১ নং ধারা অনুযায়ী, স্পিকার কে এই মর্মে প্রমাণপত্র (certificate) দিতে হয় যে, বিলটি অর্থ বিল।
(4) লোকসভার সদস্যদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে ভূমিকা: লোকসভার কোনাে সদস্য অধিকার ভঙ্গের কোনাে অভিযোগ আনলে, স্পিকারকে তার প্রতিবিধান করতে হয়। কারণ, লোকসভার সদস্যদের অধিকার রক্ষার ভার তার উপরই ন্যস্ত রয়েছে। সভার এলাকার মধ্যে কোনাে সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে হলে স্পিকারের অনুমতির প্রয়ােজন হয়।
(5) রাষ্ট্রপতি ও লোকসভার মধ্যে যােগসূত্রকারক হিসেবে ভূমিকা: স্পিকার হলেন লােকসভা এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে একটি যােগসূত্রকারক। রাষ্ট্রপতি স্পিকারের মারফত লোকসভার যাবতীয় খবরাখবর সংগ্রহ করে থাকেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি প্রেরিত বাণী, বার্তা, বক্তব্য ইত্যাদি লোকসভা প্রেরিত হলে, স্পিকার স্বয়ং লোকসভায় তা উত্থাপন করে থাকেন।
(6) সংসদীয় কমিটির উপর নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ভূমিকা: লােকসভা তার কাজকর্মগুলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য কিছু কিছু কমিটি নিয়ােগ করে। স্পিকার এই সমস্ত কমিটিগুলোর সভাপতিদের নিয়ােগ করেন এবং কমিটিগুলির কাজকর্মের প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়ে থাকেন। কমিটিগুলি যেমন -বিধি সম্পর্কিত কমিটি (Rules Committee), সভার কর্মপদ্ধতি পরিচালনা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটি (Business Advisory Committee)। স্পিকারের নিয়ন্ত্রণে থেকে তাদের কার্য সম্পাদন করতে হয়।
(7) নির্ণায়ক ভোট নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা: স্পিকার লোকসভার কোনাে আলােচনায় যােগ দিতে পারেন না। তবে কোনাে বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে সমান সংখ্যক ভোট পড়লে তিনি তার নির্ণায়ক ভােট (Casting Vote) প্রদান করতে পারেন। এই নির্ণায়ক ভারতে সাহায্যে বিষয়টির অচলাবস্থার অবসান ঘটে।
(8) পদত্যাগ পত্রের যথার্থতা বিচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা: লোকসভার কোনাে সদস্য পদত্যাগ করলে সেই পদত্যাগপত্রটি স্পিকারের হাতে জমা দিতে হয়। সংবিধানের ৩৩ তম সংশােধন (১৯৭৪ খ্রি.) অনুযায়ী অনুসন্ধান করার পর তিনি যদি মনে করেন যে সদস্যটির পদত্যাগ স্বেচ্ছাকৃত নয়, তাকে জোর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে, তবে তিনি পদত্যাগপত্রটি অস্বীকার করতে পারেন।
(9) কোরামের বিচারের ক্ষেত্রে ভূমিকা: কোরামসংখ্যক সদস্যের উপস্থিত না থাকলে লোকসভার কাজকর্ম চলতে পারে না। লোকসভায় কোরাম আছে কি না তা দেখেন স্পিকার এবং না থাকলে সভার কাজকর্ম সাময়িক ভাবে স্পিকার স্থগিত রাখতে পারেন।
(10) সভার কর্মসূচি নির্ধারণে ভূমিকা: লোকসভার সভাপতি বলে পরিচিত স্পিকার লোকসভার কর্মসূচি স্থির করেন। কোন বিষয়টিকে আলােচনার জন্য গ্রহণ করা যাবে, কোন বিষয়টিকে গ্রহণ করা যাবে না- সেই বিষয়ে স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়। এ ছাড়াও সভার কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য স্পিকার রাজ্যসভা ও লোকসভা উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করে থাকেন [১১৮ (৪) নং ধারা ]।
(11) সভার সচিবালয়ের প্রধান হিসেবে ভূমিকা: স্পিকার লোকসভার সচিবালয়ের প্রধান হিসেবে তার ভূমিকা পালন করে থাকেন। তিনি সভার সকল সদস্য তথা সকল কর্মচারীর জীবন, সম্মান এমনকি তাদের সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তাজনিত দায়িত্বভার পালন করে থাকেন। এ ছাড়াও সভায় উপস্থিত সদস্য ও অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের (দর্শক, সাংবাদিক) আসনের উপযুক্ত ব্যবস্থা থেকে গ্রহণ করতে হয়। সংসদের কার্যবিবরণী ও সেই সংক্রান্ত রেকর্ড ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের দায়িত্বও তিনিই পালন করেন।
(12) সদস্যপদ বাতিলের ক্ষেত্রে ভূমিকা: লোকসভা সদস্যগণ দলত্যাগবিরােধী আইনে প্রযুক্ত কি না, স্পিকার সেই বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে পারেন। যদি অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয় তাহলে স্পিকার সংশ্লিষ্ট সদস্যের সদস্যপদ বাতিল বা খারিজ করে দিতে পারেন। উল্লেখ্য, সংবিধানের ৫২ তম সংশােধনে (১৯৮৫ খ্রি.) স্পিকারের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
স্পিকারের পদমর্যাদা
লোকসভার স্পিকারের ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সম্পর্কে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একটি বক্তব্য এখানে উল্লেখ করা যায়। তার মতে, সমস্ত কক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন স্পিকার। তারই মধ্যে সমস্ত কক্ষের মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতিনিধিত্ব ঘটে। এই প্রতিনিধি কক্ষ যেহেতু সমস্ত জাতির মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক, এই কারণে স্পিকারের কর্তব্য হল দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে থেকে নিরপেক্ষভাবে লোকসভার কার্যাদি সম্পাদন করা। জওহরলাল নেহরুর উক্তি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে স্পিকারের পদমর্যাদা সম্পর্কে নেহরুর অভিমত হল স্পিকার আইনসভার প্রতিনিধিত্ব দান করেন। তিনি আইনসভার সম্মান, স্বাধীনতা প্রদানের মাধ্যমে আইনসভাকে সমগ্র জাতির প্রতিনিধিত্ব করার ভূমিকা গ্রহণ করেন। জাতির স্বাধীনতা এবং সম্মানের প্রতীক হলেন স্পিকার (“The speaker represent the House. He represents the dignity of the House, the freedom of the House and became the House represents the nation…. the speaker becomes the symbol of the Nations’ freedom and dignity.”)। ভারতের লোকসভার স্পিকারের পদমর্যাদা সম্পর্কে আশা করি এটি একটি যথার্থ মূল্যায়ন।