ভূমিকা: ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রে যেমন রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনসভা, তেমনই রাজ্যগুলিতে রয়েছে রাজ্য সরকারের আইনসভা, তবে সব রাজ্যের আইনসভা গুলির কেন্দ্রীয় আইনসভা অর্থাৎ পার্লামেন্টের মতাে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট নয়। কিছু কিছু রাজ্যের আইনসভা গুলি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হলেও অধিকাংশ রাজ্যেই আইনসভা গুলি এক কক্ষবিশিষ্ট বলে পরিচিতি লাভ করে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে এমন কয়েকটি রাজ্যের উদাহরণ হল— অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, জম্মু ও কাশ্মীর, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু এবং উত্তরপ্রদেশ। এ ছাড়া ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্যগুলির আইনসভা হল এককক্ষবিশিষ্ট।
রাজ্য আইনসভার গঠন
রাজ্য আইনসভার গঠন আলোচনা করতে হলে রাজ্য বিধানসভা ও রাজ্য বিধান পরিষদের গঠন অবশ্যই আলােচনা করা দরকার।
বিধানসভার গঠন: রাজ্য আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষ বলে পরিচিতি লাভ করে বিধানসভা। বিধানসভার গঠন সম্পর্কে সংবিধানের ১৭০ নং ধারায় বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। সংবিধান অনুসারে কোনাে অঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার সদস্য সংখ্যা ৬০-এর কম বা ৫০০-এর বেশি হবে না। রাজ্য বিধানসভার মােট নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ২৯৪ জন। তা ছাড়া রাজ্যপাল কর্তৃক মনােনীত ইঙ্গ-ভারতীয় সম্প্রদায়ের ১ জন প্রতিনিধি থাকেন। তখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার মােট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ২৯৫ জন।
বিধানসভার সদস্যগণ সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে রাজ্যের নাগরিকদের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের জন্য সমগ্র রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে কতকগুলি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হয়। প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকা থেকে একজন করে। সদস্য নির্বাচিত হন। সাধারণত প্রতি ৭৫ হাজার জনসংখ্যাপিছু একজন। সদস্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।
তা ছাড়া রাজ্যপাল যদি মনে করেন যে, রাজ্যের বিধানসভায় ই-ভারতীয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ হয়নি, তা হলে তিনি ওই সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন সদস্য মনােনীত করতে পারেন (৩৩৩ নং ধারা)।
বিধানসভার সদস্য পদপ্রার্থীর যােগ্যতাগুলি হল一
- (a) তাকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে,
- (b) তার বয়স হবে অন্তত পঁচিশ বছর,
- (c) কোনো সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা চলবে না। তেমন কোনাে পদে অধিষ্ঠিত থাকলে প্রার্থী হওয়ার আগে তা ছাড়তে হবে,
- (d) আদালত কর্তৃক দেউলিয়া বা বিকৃত মস্তিষ্কসম্পন্ন বলে ঘোষিত কোনাে ব্যক্তি সদস্যপদের প্রার্থী হতে পারবেন না,
- (e) কোনো ব্যক্তি একসঙ্গে বিধানসভা ও পার্লামেন্টের সদস্য থাকতে পারেন না।
সংসদ ও বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের পরিচয় সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিধানসভার সদস্যগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে অধ্যক্ষ বা স্পিকার এবং অন্য একজনকে উপাধ্যক্ষ বা ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করেন। স্পিকার সভার সদস্যদের মধ্য থেকে অনধিক ছয় জনকে সভাপতি হিসেবে মনােনীত করেন। স্পিকারের অনুপস্থিতিতে ডেপুটি স্পিকার সভার কাজকর্ম পরিচালনা করেন এবং এই দুই পদাধিকারীর অনুপস্থিতিতে সভাপতিগণ পরামর্শ অনুযায়ী সভার কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
বিধান পরিষদের গঠন : ভারতীয় সংবিধানের ১৭১ নং ধারায় বিধান পরিষদের গঠন সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে। বিধান পরিষদের আয়তন বিধানসভার আয়তন অনুযায়ী কমবেশি হতেই হবে বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা বিধানসভার সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হবে না আবার বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা কোনাে অবস্থাতেই ৪০-এর কম হতে পারবে না। বিধান পরিষদের ৬ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ সদস্য পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট ১ ভাগ সদস্য রাজ্যপাল কর্তৃক মনােনীত হয়ে থাকেন। বিধান পরিষদের মােট সদস্য সংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য মিউনিসিপ্যালিটি, জেলা বাের্ড থেকে এবং অন্যান্য স্বায়ক্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এ ছাড়া এক-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত হন বিধানসভার সদস্যগণ কর্তৃক একক হস্তান্তরযােগ্য সমানুপাতিক ভোটের ভিত্তিতে, এক-দ্বাদশ (১/১২) অংশ শিক্ষকদের দ্বারা এবং এক-দ্বাদশ (১/১২) অংশ স্নাতকগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। তা ছাড়া অবশিষ্ট সদস্যগণ বিজ্ঞান, চারুকলা, সাহিত্য, সমাজসেবার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকেও রাজ্যপাল মনােনীত করে থাকেন।
রাজ্য আইনসভার ক্ষমতা ও কার্যাবলি
[1] আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা: রাজ্য আইনসভার প্রধান কাজ হল রাজ্য বা রাজ্যের যে-কোনাে অংশের জন্য প্রয়ােজনীয় আইন প্রণয়ন করা। বর্তমানে রাজ্য তালিকাভুক্ত সকল বিষয়ে রাজ্য আইনসভা আইন প্রণয়ন করতে পারে। এ ছাড়া অত্যন্ত জরুরি পরিস্থিতিতেও রাজ্যতালিকাভুক্ত যে-কোনাে বিষয়ে পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করতে পারে।
একমাত্র রাজ্যপালের ক্ষমতা রয়েছে রাজ্য আইনসভায় পাস হওয়া প্রতিটি বিলে স্বাক্ষর প্রদান করার। রাজ্যপাল এই বিলে সম্মতি দিলে বিল আইনে পরিণত হয়। যদি তিনি বিলে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন তাহলে বিলটি বাতিল বলে বিবেচিত হয়। রাজ্যপাল আবার কোনাে বিলকে পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন।
যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়ে রাজ্য আইনসভা আইন প্রস্তুত করতে পারে। কিন্তু পার্লামেন্ট-প্রণীত আইন শুধুমাত্র যুগ্ম রাজ্যতালিকাভুক্ত বিষয়েই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। রাজ্য আইনসভা কর্তৃক কোনাে বিলের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিজে সম্মতি না দিয়ে তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠাতে পারেন।
[2] শাসন বিভাগ গঠন ও নিয়ন্ত্রণ: বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে নিয়ে রাজ্যের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। তবে বিধানসভার সদস্য না হয়েও রাজ্য মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়া যায়। ভারতের অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তার মন্ত্রীসভার সদস্যের বিধান পরিষদ থেকে নিয়ােগ করতে পারেন, যদিও মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার সদস্য হতে পারেন। বস্তুত রাজ্যের মন্ত্রীসভার গঠন বিধানসভার উপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে যে রাজনৈতিক দল বা জোট বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দল বা গোষ্ঠী মন্ত্রীসভা গঠন করতে পারে।
বিধানসভার কাছেই শাসন বিভাগ দায়িত্বশীল থাকে। এ ছাড়াও রাজ্যের মন্ত্রীসভার সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনের উপর নির্ভর করে। রাজ্যের মন্ত্রীরা বিধানসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালে মন্ত্রীসভার পতন অনিবার্য বলে বিবেচিত হয়। মন্ত্রীসভাকে বিধানসভার অধিকাংশ সদস্যের আস্থাভাজন হতে হয়, তা না হলে মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে বিধানসভায় কোনাে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হলেই মন্ত্রিসভা কে পদত্যাগ করতে হয়।
সংবিধানের ১৬৪ (২) নং ধারানুসারে রাজ্যের মন্ত্রীসভাকে বিধানসভার কাছে যৌথভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হয়। এই যৌথ দায়িত্বশীলতার অর্থ হল মন্ত্রীসভা তার সকল কাজের জন্য বিধানসভার কাছে জবাবদিহি করবে। আবার কোনাে মন্ত্রী বিধানসভায় পরাজিত হলে তা সমগ্র মন্ত্রীসভার পরাজয় বলে প্রতিপন্ন হয়।
শাসন বিভাগের উপর বিধানসভার এই নিয়ন্ত্রণ বহুলাংশে তাত্ত্বিক, খুব একটা বাস্তবসম্মত নয়। কারণ দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিতেই মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। তবে চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পর ভারতের রাজনৈতিক পরিকাঠামো যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। এই কারণেই মন্ত্রীসভার দায়িত্বশীলতা একটা বৃঢ় ও কঠিন সত্য বলে বিধানসভার কাছে প্রতিপন্ন হয়।
[3] অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা: অর্থবিল কেবলমাত্র বিধানসভাতেই উত্থাপন করা হয়। বিধানসভা রাজ্য সরকারের কর ধার্য, কর সংগ্রহ ও ব্যয় বরাদ্দের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ছাড়া সরকারের কোনােরূপ কর ধার্য, কর সংগ্রহ বা অর্থ যদি ব্যয় করতে হয় তাহলে বিধানসভার অনুমােদনের প্রয়ােজন হয়। বিধানসভাতেই প্রথম বাজেট, রাজস্ব বিল, বিনিয়োগ বিল উত্থাপন করা হয়। বিধানসভা অনুমােদন না করলে সরকারের ব্যয়মঞ্জুরীর দাবি কার্যকর হয় না। তা ছাড়া বিধানসভাই সরকারের ব্যয়মঞ্জুরীর দাবি প্রত্যাখ্যান বা হ্রাস করতে পারে, কিন্তু ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারে না। তবে এই ক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়। যেমন কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় রাজ্যের সঞ্জিত তহবিলের উপর ধার্য ব্যয় হিসেবে পরিগণিত হয়। সুতরাং প্রতি বছর এইসকল ব্যয় বিধানসভায় অনুমােদনসাপেক্ষ হয় না।
[4] সংবিধান-সংশােধনমূলক ক্ষমতা: পার্লামেন্টের হাতেই ভারতীয় সংবিধান সংশােধনের মূল ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কিত কতকগুলি বিষয়ে সংবিধান সংশােধনের জন্য অন্তত অর্ধেক রাজ্য আইনসভার অনুমােদন প্রয়ােজন হয় [৩৬৮ (২) ধারা]। এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য বিষয়গুলি হল কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন, সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্ট সম্পর্কিত বিষয়সমূহ ইত্যাদি।
[5] অন্যান্য ক্ষমতা: রাজ্য আইনসভার অন্যান্য ক্ষমতা গুলি হল―
- রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ অর্থাৎ বিধানসভা বিভিন্ন বিষয়ে সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বলাবাহুল্য, সরকারি কার্যকলাপ ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিধানসভার সদস্যগণ বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন মন্ত্রীদের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করে থাকে এবং মন্ত্রীদেরও এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। বিধানসভার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় মন্ত্রীরা যে-সমস্ত সংবাদ ও তথ্য পেশ করেন, তা নির্ভরযােগ্য সূত্রে সংগৃহীত হয়ে থাকে। বেতার, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যম জনসাধারণকে এই সমস্ত বিষয় জানতে সাহায্য করে।
- রাজ্যের বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য একটি বিশেষ নির্বাচক সংস্থার সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকেন।
- বিধানসভায় যে বিষয়গুলি পর্যালোচনা করা হয়, সেগুলি হল- নিয়ন্ত্রক ও মহাগণনা পরীক্ষকের প্রতিবেদন, রাজ্যের রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশনের প্রতিবেদন প্রভৃতি। রাজ্য সরকার যে-সমস্ত কমিশন গঠন করে তাদের প্রতিবেদন সম্পর্কে রাজ্য আইনসভায় আলােচনা হয়ে থাকে। এ ছাড়া রাজ্য আইনসভায় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়।
- রাজ্যের সীমানা পরিবর্তন ও পুনর্গঠন সম্পর্কিত বিল পার্লামেন্টে উত্থাপিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি বিধানসভার মতামত নিয়ে থাকেন।
মূল্যায়ন: রাজ্য রাজনীতিতে রাজ্য আইনসভার গুরুত্ব অপরিসীম। দলীয় আনুগত্যের কারণে রাজ্য আইনসভার নিম্নকক্ষ বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের নির্দেশ মেনে চলে। ফলে শাসন বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিধানসভায় যে তর্ক বিতর্ক হয় তার ফলে জনমত সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সুতরাং জনসাধারণের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কক্ষ বিধানসভার নিজস্ব একটি গুরুত্ব ও মর্যাদা বর্তমানেও বজায় রয়েছে।