ভূমিকা : ভারতের সংবিধানে রাজ্যের শাসন বিভাগের মতাে রাজ্যের আইন বিভাগের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি বিস্তৃতভাবে আলােচনা করা হয়েছে। রাজ্য আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট বা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হতে পারে। সংবিধান অনুসারে রাজ্য আইনসভা গঠিত হয় সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপাল, রাজ্য বিধানসভা ও বিধান পরিষদকে নিয়ে। যেসব রাজ্যের আইনসভা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সেইসব রাজ্যের আইনসভার উচ্চকক্ষকে বলা হয় বিধান পরিষদ (Legislative Council)। বর্তমানে ভারতের ২৯টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং জম্মু ও কাশ্মীর এই ৭টি অঙ্গ রাজ্যের আইনসভা দ্বিকক্ষযুক্ত। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্যান্য রাজ্যের আইনসভা এককক্ষবিশিষ্ট অর্থাৎ এককক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভায় কেবলমাত্র বিধানসভা বিদ্যমান। সংবিধানের ১৬৯ নং ধারা অনুসারে বিধানসভার মােট সদস্য এর অধিকাংশ এবং উপস্থিত ও ভােটদানকারী সদস্যের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট বিধান পরিষদের সৃষ্টি বা বিলােপের প্রস্তাব রাজ্য আইনসভায় পাস হলে পার্লামেন্ট সংশ্লিষ্ট রাজ্যে বিধান পরিষদ চালু করতে বা তুলে দিতে পারে।
বিধান পরিষদের গঠন
বিধান পরিষদের আয়তন বিধানসভার আয়তন অনুযায়ী কমবেশি হতেই পারে, তবে বিধান পরিষদের সদস্য সংখ্যা বিধানসভার সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি হতে পারে না, আবার ৪০-এর কমও হবে না। এই ব্যবস্থা প্রচলিত হওয়ার একমাত্র কারণ হল, বিধানসভার উপর যেন বিধান পরিষদ প্রাধান্য বিস্তার না করতে পারে অনুচ্ছেদ ১৭১ (১)]। সংবিধানে বিধান পরিষদ গঠনের যে পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়েছে তা চূড়ান্ত নয়। রাজ্য বিধানমণ্ডলের এই কক্ষের গঠন সংক্রান্ত আইন রচনার চূড়ান্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সংসদকে অর্পণ করা হয়েছে [অনুচ্ছেদ ১৭১ (২)]। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না সংসদ এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করছে ততক্ষণ পর্যন্ত বিধান পরিষদের গঠন সেইরকমই হবে যেরকম সংবিধানে উল্লেখ করা আছে।
বিধান পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন পদ্ধতি : সংবিধানে বলা আছে, বিধান পরিষদ অংশত মনােনীত ও অংশত নির্বাচিত একটি সংস্থা। নির্বাচন হবে পরােক্ষ এবং তা হবে একক হস্তান্তরযােগ্য ভোট দ্বারা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নীতি অনুসারে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সদস্য গ্রহণ করে বিধান পরিষদে নানা ধরনের লােকের সমাবেশ ঘটতে পারে। বিধান পরিষদের ৬ ভাগের মধ্যে ৫ ভাগ সদস্য পরােক্ষভাবে নির্বাচিত হন এবং অবশিষ্ট ১ ভাগ সদস্য রাজ্যপাল দ্বারা মনােনীত হয়ে থাকেন। বিধান পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন ও মনােনয়নের পাঁচটি ধাপ রয়েছে―
- বিধান পরিষদের মােট সদস্য সংখ্যার ১/৩ ভাগ পৌরসংঘ, জেলা পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহের সদস্যদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।
- প্রায় ১/১২ ভাগ নির্বাচিত হবেন ওই রাজ্যে বসবাসকারী অন্তত তিন বছর আগে স্নাতক হয়েছেন, এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক।
- প্রায় ১/১২ ভাগ নির্বাচিত হবেন ওই রাজ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চেয়ে নিম্নমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত তিন বছর শিক্ষকতায় নিযুক্ত আছেন এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত নির্বাচকমণ্ডলী কর্তৃক।
- প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য রাজ্য বিধানসভার সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন।
- অবশিষ্ট এক-ষষ্ঠাংশ সদস্য সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, কলা, সমবায় আন্দোলন ও সমাজসেবা বিষয়ে জ্ঞান বা ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতা আছে এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে রাজ্যপাল কর্তৃক মনােনীত হয়ে থাকেন।
যােগ্যতা : সংবিধানের ১৭৩ নং ধারা অনুযায়ী বিধান পরিষদের সদস্য পদপ্রার্থীকে—(a) ভারতীয় নাগরিক হতে হবে, (b) কমপক্ষে ৩০ বছর বয়স্ক হতে হবে, (c) পার্লামেন্টের ঘােষণা অনুসারে অন্যান্য যােগ্যতার অধিকারী হতে হবে। এ ছাড়া দেউলিয়া, বিকৃত মস্তিষ্ক বা সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত কোন ব্যক্তি বিধান পরিষদের সদস্য হতে পারবেন না।
কার্যকাল : বিধান পরিষদের সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ ৬ বছর ধার্য করা হয়েছে। তবে এটি একটি স্থায়ী কক্ষ বলেই বেশি পরিচিতি লাভ করে। একে কখনােই ভেঙে দেওয়া যায় না। প্রতি দু-বছর অন্তর প্রত্যেক শ্রেণির অন্তর্গত এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসর গ্রহণ করতে পারে অনুচ্ছেদ ১৭২ (২)] এবং ওই শূন্য আসনগুলিতে নতুন সদস্য নির্বাচিত ও মনােনীত হতে পারেন।
সভা পরিচালনা : বিধান পরিষদের সভা পরিচালনা করেন সভাপতি। সভাপতি সদস্যদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তাকে সাহায্য করার জন্য একজন সহ-সভাপতি সদস্যগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সভাপতির অনুপস্থিতিতে সহ-সভাপতি সভার কার্য পরিচালনা করে থাকেন। সভায় কোন আলোচ্য বিষয়ের উপর সমান সংখ্যক ভোট পড়লে সভাপতি একটি নির্ণায়ক ভোট প্রদান করতে পারেন। একইসঙ্গে সভাপতি এবং সহ-সভাপতির পদ শূন্য হলে রাজ্যপাল ওই কক্ষের যে-কোনাে সদস্যকে সভার কার্য পরিচালনার দায়িত্ব ন্যস্ত করতেই পারেন (১৮৩ নং ধারা)।
অপসারণ পদ্ধতি : বিধান পরিষদ ১৪ দিন পূর্বে নােটিশ দিয়ে, প্রস্তাব উত্থাপন করে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভারতের সমর্থনে বিধান পরিষদের সভাপতি ও সহ-সভাপতিকে অপসারিত করা যেতেই পারে।
বিধান পরিষদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি
বিধান পরিষদের কক্ষটি যেমন আলােচনা ও সমালােচনা করতে পারে তেমনই প্রয়ােজনে পরামর্শও দিতে পারে। তথাপি যেসকল কার্যাবলি এই কক্ষ সম্পাদন করে থাকে, সেগুলি হল―
(1) আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিধান পরিষদ রাজ্যসভার অনুরূপ কক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু সংবিধানের বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, রাজ্যসভা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে যেসব ক্ষমতা ভােগ করে থাকেন, সেইরূপ ক্ষমতা বিধান পরিষদ কখনােই ভােগ করতে পারে না। তার কারণ হল, রাজ্য আইনসভার যে-কোনাে বিল বিধান পরিষদে উত্থাপন করা যেতে পারে কিন্তু অর্থ বিল একমাত্র বিধানসভায় উত্থাপন করা যায়। আবার বিধানসভায় পাস হওয়া কোনাে বিলকে বিধান পরিষদ সর্বাধিক ৪ মাস পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে। অবশ্য বিধানসভায়। সংশ্লিষ্ট বিলটি পুনরায় গৃহীত হলে সেই বিলের ক্ষেত্রে বিধান পরিষদের একান্ত সম্মতির আর প্রয়ােজন হয় না।
(2) অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা : বিধান পরিষদের অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা খুব সীমিত। সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার রীতি অনুযায়ী কোনাে অর্থ বিলকে বিধান পরিষদে কখনােই উত্থাপন করা যায় না। বিধানসভায় পাস হওয়া কোনাে অর্থ বিল রাজ্য বিধান পরিষদে প্রেরণ করা হলে সেই কক্ষ ১৪ দিন সেই বিলটিকে আটকে রাখতে পারে কিন্তু ১৪ দিনের মধ্যে বিধান পরিষদ বিলটিকে বিধানসভায় সুপারিশ-সহ বা সুপারিশ ছাড়া ফেরত পাঠাতে বাধ্য থাকে। বিধানসভা বিধান পরিষদের সুপারিশ গ্রহণ বা বর্জন উভয় কাজই করতে পারে। কোনাে বিল অর্থ বিল কি না সে বিষয়ে বিধানসভার স্পিকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হয়।
(3) শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাজ্য বিধান পরিষদের শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতার মধ্যে উল্লেখযােগ্য দিক হল বিধান পরিষদ দৃষ্টি আকর্ষণ প্রস্তাব উত্থাপন, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারের সমালােচনা করতেই পারে। সংবিধানের বিধান পরিষদের উপর শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনাে ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি। কেননা জনপ্রিয় কক্ষ হিসেবে পরিচিত বিধানসভার কাছে মন্ত্রিসভা দায়বদ্ধ থাকতে হয়।
(4) অন্যান্য ক্ষমতা : অন্যান্য ক্ষেত্রে রাজ্য বিধান পরিষদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ, কেন-বিধান পরিষদের সদস্যবৃন্দ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। সংবিধান-সংশােধন সংক্রান্ত কোনাে বিলে বিধান পরিষদের অনুমােদন অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয় না।
মূল্যায়ন : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজ্য আইনসভার উচ্চকক্ষ হিসেবে পরিচিত বিধান পরিষদের যৌক্তিকতা নিয়ে বহু আগেই প্রশ্ন উঠেছিল। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্যে বিধান পরিষদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়লেও, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত মােট পাঁচটি রাজ্যে (বিহার, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ এবং জম্মু ও কাশ্মীর) বিধান পরিষদের অস্তিত্ব বজায় থাকলেও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট রাজ্য আইনসভার তুলনায় এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে বা তার নৈপুণ্য অনেক বেশি বলে পরিচিতি লাভ করেছে।