ভূমিকা: ভারতের সংসদীয় কার্যপদ্ধতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল কিছু কিছু ধারণা, বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তসূচক প্রস্তাব এবং দৃষ্টি-আকর্ষণ বিজ্ঞপ্তির অবস্থিতি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য কিছু বিষয় হল ‘জিরো আওয়ার, অনাস্থা প্রস্তাব’, ছাঁটাই প্রস্তাব’, মুলতুবি প্রস্তাব’ এবং দৃষ্টি-আকর্ষণ প্রস্তাব ইত্যাদি।
ভারতীয় জাতীয় সংসদ বা রাজ্য আইনসভার প্রকরণ বা নিয়মবিধিতে জিরাে আওয়ারের উল্লেখ থাকলেও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনাে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপনের ক্ষেত্রে জিরাে আওয়ার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমানে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে কিংবা পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা-সহ অন্যান্য রাজ্যের বিধানসভা বা বিধানমণ্ডলীতে ‘জিরো আওয়ার’-এর প্রচলন বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। এই জিরো আওয়ারের সম্প্রসারণ মূলত ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ থেকে চালু হয়, যখন অধ্যক্ষের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন শ্রী সঞ্জীব রেড্ডি মহাশয়, তখন থেকে আজ ৪০ বছর ধরে সংসদীয় কার্যপদ্ধতির এই উল্লেখযােগ্য পর্ব হিসেবে ‘জিরো আওয়ার’-এর প্রচলন ঘটে।
পার্লামেন্টের দিনের পরিষদীয় কাজের দুটি পর্যায় রয়েছে一
- (1) সরকারি কাজকর্ম (Government business),
- (2) বেসরকারি GA (Non-Government business)।
প্রথম পর্ব হিসাবে চিহ্নিত বেসরকারি কাজকর্ম প্রশ্নোত্তর পর্ব দিয়েই শুরু হয়ে থাকে। তা ছাড়া মুলতুবি প্রস্তাব, উল্লেখ পর্ব, দৃষ্টিআকর্ষণী প্রস্তাব প্রভৃতিও সভার বেসরকারি কর্মসূচি বা কাজকর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অপরদিকে সরকারি কর্মসূচি শেষ হওয়ার পরেই সরকারি কর্মসূচি বা কাজকর্ম চালু হয়। পরিষদীয় প্রকরণ বিধিতে প্রত্যেক প্রকরণের জন্য ক্রমানুসারে পৃথক সময় নির্দিষ্ট করা রয়েছে। কিন্তু ‘জিরো আওয়ার নামে কোনােকিছু নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করা নেই। সংসদে বেসরকারি কাজকর্ম ও সরকারি কাজকর্ম পর্বের মধ্যবর্তী সময়কে বলা হয় জিরাে আওয়ার।
জিরাে আওয়ার বা শূন্য ঘণ্টার সময়সূচি
প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষেই শুরু হয় জিরাে আওয়ার, অর্থাৎ ঘড়িতে যখন ঠিক দুপুর ১২টা বাজে তারপর থেকে পুরাে ১ ঘন্টা ধরে অর্থাৎ ১টা পর্যন্ত আইনসভার যে-কোনাে কক্ষের কাজকর্ম চলতে থাকে বলে এই সময়কে জিরো আওয়ার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই সময়সূচির পর সংসদে বিরতি ঘােষণা করা হয় এবং বিরতির পর আবার সরকারি কাজকর্ম চালু হয়।
সভায় উত্থাপনের দায়িত্ব: জিরাে আওয়ার প্রথমে কে উত্থাপন করবেন তা মাননীয় অধ্যক্ষের সিদ্ধান্তের উপরই নির্ভর করে। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জিরাে আওয়ার সংক্রান্ত বিষয়টি কেন্দ্র বা রাজ্যের আইনসভায় একটি অভ্যাস বা রীতি হিসেবে পরিগণিত হত, তারপর ওই বছরই পরিষদীয় প্রকরণ বিধিতে ৩৭৭ নং রুলে জিরাে আওয়ার স্থান পেয়েছিল। জিরাে আওয়ারে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এম এল এ (MLA) দ্বারা সভায় উত্থাপন করা হয়। বিষয়টি এমনই গুরুত্বপূর্ণ যে, পূর্বে এই বিষয়ে নােটিশ দেওয়ার মতাে বা সভাকে অবহিত করার মতাে অবকাশ ছিল না। তাই সরাসরি কোনো মাননীয় সাংসদ বিধায়ক মাননীয় অধ্যক্ষ মহােদয়কে সভা চলাকালীন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করে থাকেন। এরপর মাননীয় অধ্যক্ষ মহােদয় গুরুত্ব বিবেচনা করে অনুমতি দিলে জিরাে আওয়ারে উক্ত বিষয়গুলি সভায় উত্থাপন করে তা আলােচনা করা হয়।
সমালােচনা: জিরাে আওয়ার-এর কিছু সীমাবদ্ধতা লক্ষ করা যায়─
- জিরাে আওয়ারের জন্য আইনসভার মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
- জিরাে আওয়ারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলােচনা থেকে পিছনে রয়ে যায়।
- অনেকসময় সদস্যদের অসংসদীয় অপ্রীতিকর কথা বলা ও আচরণ জিরাে আওয়ারের সভার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করে দিয়েছে।
তা সত্ত্বেও সদস্যবৃন্দ অত্যন্ত সন্তর্পণে জনস্বার্থের বিষয়গুলি “জিরো আওয়ার”-এ তুলে সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। তবুও একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সংসদীয় গণতন্ত্রে জিরাে আওয়ারের প্রয়ােজনীয়তা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। বিরোধী পক্ষের কাছে ‘জিরো আওয়ার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য পদ্ধতি বলে গণ্য হয়।
সংসদীয় কার্যপদ্ধতির মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অনাস্থা প্রস্তাব। ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্যে এমনকি অঞ্চলে যে শাসনব্যবস্থার অবতারণা ঘটেছে, তাকে বলা হয় দায়িত্বশীল সরকার। এখানে প্রতিনিধি সভার আস্থাভাজন মন্ত্রী এবং মন্ত্রীমণ্ডলী কেবল শাসনক্ষমতায় আসীন থাকতে পারেন। সভার আস্থা হারিয়েছে এইরকম প্রস্তাব মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে উত্থাপন করা হলে তাকেই বলা হয় অনাস্থা প্রস্তাব। ব্যক্তিগতভাবে কোনাে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা যায় না। সমগ্র মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে হয়।
অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের পদ্ধতি
এই প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য অধ্যক্ষের অনুমতি জরুরি। এই প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট সদস্য বা সদস্যবর্গকে অধ্যক্ষের অনুমতি প্রার্থনা করতে হয় এবং এই মর্মে লিখিত বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হয় সচিবকে। সভার এক-দশমাংশ সদস্য যদি এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেন, তবেই অধ্যক্ষ ওই প্রস্তাব উত্থাপনের অনুমতি দেন। লোকসভা এবং বিধানসভার ৫০ জন ও ৩০ জন সদস্য অনাস্থা প্রস্তাবের সমর্থনে দণ্ডায়মান হলে প্রস্তাবটি আলােচনার জন্য সভায় গৃহীত হয়েছে বলে স্পিকার ঘােষণা করেন। এই প্রস্তাব গ্রহণ করার পর ১০ দিনের মধ্যেই অনাস্থা প্রস্তাবের উপর আলােচনার দিন ধার্য করতে হয়। এ ব্যাপারে সরকারের অভিমত অনুযায়ী অধ্যক্ষ আলােচনার সুনির্দিষ্ট দিন ঘােষণা করেন। এইভাবে সভায় আলোচনা বা বিতর্ক শেষ হওয়ার পরেই স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাব সম্পর্কে কক্ষের সিদ্ধান্ত জানার জন্য সেটিকে ‘ধ্বনি ভোট’ হিসেবে পেশ করেন। ভোটাভুটিতে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়ে গেলে সরকারের পতন ঘটে।
অনাস্থা প্রস্তাব প্রত্যাহার
অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনকারী সদস্য ইচ্ছা করলে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে আলােচনার জন্য প্রস্তাবটি সভায় পেশ করার পূর্বে তাতে স্বাক্ষরকারী সব সদস্যকে প্রত্যাহার সংক্রান্ত এবং সব সদস্যের স্বাক্ষর সংবলিত একটি নােটিশ জমা দিতে হয়।
সমালোচনা: অনাস্থা প্রস্তাবের সমালােচনার উর্ধ্বে নয়─
- লোকসভায় বা বিধানসভায় যখন কোনাে রাজনৈতিক দল। এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকে তখন অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা ও সেটিকে পাস করানাে অলীক কল্পনামাত্র।
- বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে সরকারের ভূমিকার বিরােধী যুক্তি তর্ক জনসাধারণের কাছে পৌছে যায়। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের জনসমর্থন হারানাের আশঙ্কা থাকে।
অনাস্থা প্রস্তাব সামগ্রিকভাবে সরকারের অক্ষমতা ও অযােগ্যতাকে প্রতিপন্ন করার জন্য আক্রমণ পরিচালিত হয়। সরকার পক্ষ সর্বদা অনাস্থা প্রস্তাবের মােকাবিলা করার ব্যাপারে সক্রিয় ও যত্নবান হয়। কাজেই এ কথা বলা যেতেই পারে যে, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য।