ভারতের অখণ্ড বিচার ব্যবস্থার সর্বনিম্ন আদালত গুলিকে আইনি পরিভাষায় অধস্তন আদালত (Sub-ordinate Court) বলা হয়। সমগ্র ভারতের জন্য যেমন সুপ্রিম কোর্ট, রাজ্যের জন্য যেমন হাইকোর্ট তেমনি জেলাগুলির জন্য যে বিচারালয় গঠন করা হয়, তাকে বলা হয় অধস্তন আদালত। জেলা আদালতের শীর্ষে থাকেন ডিস্ট্রিক্ট জজ এবং মহানগরের ক্ষেত্রে মহানগরীয় ম্যাজিস্ট্রেট।
অধস্তন আদালতের গঠন ও কার্যাবলি
রাজ্যের সর্বোচ্চ আপিল আদালত মহাধর্মাধিকরণের নীচে অধস্তন আদালত গুলির মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা— (1) জেলা স্তরের অধস্তন আদালত, (2) মহানগরের অধস্তন আদালত। আবার জেলার অধস্তন আদালত গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, যথা— (1) দেওয়ানি আদালত (Civil Courts), (2) ফৌজদারি আদালত (Criminal Courts)। হাইকোর্টের পরামর্শে মাননীয় রাজ্যপাল অধস্তন আদালতের বিচারপতিদের নিয়ােগ, পদোন্নতি ও বদলির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। ৭ বছর কোনাে ভারতীয় নাগরিক আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞতা অর্জন করলে এবং হাইকোর্ট কর্তৃক মনােনীত হলে, সেই ব্যক্তিকে রাজ্যপাল অধস্তন আদালতের বিচারপতিরূপে নিয়ােগ করতে পারেন। ন্যায় পঞ্চায়েত ছাড়া বাকি সকল অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ােগপত্র রাজ্যপাল এবং রাজ্য রাষ্ট্রকৃত্যক কমিশন দিয়ে থাকেন। রাজ্যপাল নিয়োগ পত্র দেওয়ার সময় হাইকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করেন।
জেলার অধস্তন আদালত
[1] দেওয়ানি আদালত (Civil Courts): জেলার দেওয়ানি আদালতগুলিকে আবার চার ভাগে ভাগ করা যায়, যথা—
- জেলা জজ বা বিচারকের আদালত: জেলার দেওয়ানি আদালত গুলির মধ্যে সর্বোচ্চ আদালত হল জেলা জজ আদালত। প্রতিটি জেলায় একটি করে জেলা জজের আদালত রয়েছে। জেলার শীর্ষ আদালতের বিচারককে বলা হয় জেলা জজ। তিনি আবার জেলার ফৌজদারি আদালতের বিচারক হিসেবেও কাজ করে থাকেন। এই আদালতে মূল ও আপিল উভয় প্রকার এলাকা রয়েছে। এই এলাকাগুলিতে যে-কোনাে মূল্যের দাবিদাওয়া সম্পর্কিত মামলার বিচার করা হয়।
- সাব জজ আদালত: জেলা জজ আদালতের নিম্নে আছে সাব জজ আদালত। এই আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দু-ধরনের মামলাই চলে। এই আদালতে মূল এলাকা ও আপিল এলাকা উভয় এলাকাই বর্তমান রয়েছে। ৫,০০০ টাকার বেশি মূল্যের মামলা এই আদালতে দায়ের করা যায়। মুন্সেফ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে এই সাব জজ আদালতে মামলা দায়ের করা যায়।
- মুন্সেফের আদালত: সাব জজ আদালতের নীচে রয়েছে মুন্সেফ আদালত। মহকুমা এবং জেলা শহরে এ ধরনের আদালত দেখা যায়। এই আদালতে ১,০০০ থেকে ৫,০০০ টাকা মূল্যের সম্পত্তি সম্পর্কিত মামলার বিচার করা হয়।
- ন্যায় পঞ্চায়েত বা ক্ষুদ্র আদালত: দেওয়ানি আদালতসমূহের সর্বনিম্ন আদালত হল ন্যায় পঞ্চায়েত। প্রত্যেকটি গ্রাম বা কয়েকটি গ্রামের জন্য একটি করে ন্যায় পঞ্চায়েত গড়ে তােলা হয়। এই ধরনের আদালতে গ্রাম্য বিবাদ বা ছােটোখাটো মামলার নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। প্রধানত, এখানে সামান্য পরিমাণ অর্থ সংক্রান্ত ছােটোখাটো মামলার বিচার করা হয়, আর বড়াে শহরের ছােটো মামলা পরিচালনার জন্য ক্ষুদ্র আদালত গঠন করা হয়।
[2] ফৌজদারি আদালত (Criminal Courts) : জেলার ফৌজদারি আদালতসমূহকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলি হল—
- দায়রা জজ আদালত: দায়রা জজ আদালত হল জেলার সর্বোচ্চ ফৌজদারি আদালত। জেলা বিচারক জেলা ফৌজদারি আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে সাহায্য করে থাকেন অতিরিক্ত দায়রা জজ সহকারী দায়রা জজ। বিচার বিভাগীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজের আদালতে আপিল করা যায়।
- অবর ম্যাজিস্ট্রেটের বা বিচারকের আদালত: ফৌজদারি আদালতের দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে অবর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। জেলার গুরুতর ফৌজদারি মামলার বিচার এখানে হয়ে থাকে। অবর ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দুই ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট থাকেন। যথা— (a) বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট, (b) প্রশাসনিক ম্যাজিস্ট্রেট। আবার বিচার বিভাগীয় বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর দু-ভাগে ভাগ করা যায়, যথা— (a) বেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট, (b) অবেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট।
[a] বেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট: গুরুতর ফৌজদারি মামলার বিচার বেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে সম্পাদিত হয়। ক্ষমতার গুরুত্ব অনুযায়ী এদেরকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়—
- প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট: যাঁরা সর্বাধিক ২,০০০ টাকা পরিমাণ জরিমানা করতে ও ২ বছর পর্যন্ত কারাবাসের নির্দেশ দিতে পারেন।
- দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট: যাঁরা সর্বাধিক ৬০০ টাকা পরিমাণ জরিমানা করতে ও ৬ মাস পর্যন্ত কারাবাসের নির্দেশ দিতে পারেন।
- তৃতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট: কারা সর্বাধিক ১০০ টাকা পরিমাণ জরিমানা করতে এবং ১ মাস পর্যন্ত কারাবাসের নির্দেশ দিতে পারেন।
[b] অবেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেট: সাধারণ ফৌজদারি মামলার বিচারের দায়িত্ব অবেতনভুক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সম্পাদিত হয়। পঞ্চায়েত আদালত : জেলার ফৌজদারি মামলার সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে ন্যায় পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত আদালত। ন্যায় পঞ্চায়েত গ্রাম্য মারামারি, পারিবারিক ছোটোখাটো মামলার বিচার করে থাকে। ভারতীয় দণ্ডবিধির নিয়মানুযায়ী ৫০ টাকা জরিমানা হতে পারে এমন ক্ষতিপূরণের বিচার এই আদালতে হয়।
মহানগরীয় অধস্তন আদালত
দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই, মুম্বাই প্রভৃতি মহানগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত। এই আদালত আবার দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা—
- দেওয়ানি আদালত: দেওয়ানি আদালতের সর্বোচ্চ স্তর হল নগর দেওয়ানি আদালত। আরনগর দেওয়ানি আদালতের নিম্নে রয়েছে ক্ষুদ্র আদালত।
- ফৌজদারি আদালত: মহানগরীয় ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত হল- নগর দায়রা আদালত। আর নগর দায়রা আদালতের ঠিক নিম্নে রয়েছে প্রেসিডেন্সির ক্ষুদ্র আদালত।
এখানে মনে রাখতে হবে নগর দেওয়ানি আদালতে দেওয়ানি মামলার বিচার হয় এবং নগর দায়রা আদালতে ফৌজদারি মামলার বিচার হয়।
ভারতের বিভিন্ন ধরনের আদালতের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।