ভূমিকা: জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা’ (Public Interest Litigation) প্রসঙ্গে আলােচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে, জনস্বার্থ বলতে কী বােঝায়? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের সাধারণ ধারণা হল জনস্বার্থ প্রকৃত অর্থে ‘জনগণের স্বার্থকেই’ বােঝায়।
জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার সংজ্ঞা: বর্তমান ভারতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিভাগের কাজে অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। এই কারণে ভারতে এক নতুন ধরনের মামলার উদ্ভব ঘটেছে, যাকে আইনি ভাষায় জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা বলা হয়। বিচারপতি বি আগরওয়ালের ভাষায় বলা যায় যে, যেসব ক্ষেত্রে সরকার কিংবা সরকারি কর্তৃপক্ষ তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে অথবা ক্ষমতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের উপর প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে শােষণ, অবিচার, নিপীড়ন সম্পন্ন করে সেইসব বিষয়গুলিকে জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পি এন ভগবতীর এক যুগান্তকারী রায়দানের মাধ্যমে জনস্বার্থজনিত মামলাগুলির ক্ষেত্রে আইনি জটিলতা ও ব্যয় সংকোচ ব্যবস্থা করায় বিচারব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এর পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, সরকারের জনস্বার্থবিরোধী কোনাে নীতি বা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে বিচার প্রার্থনার সুযােগ লাভ করে। কারণ, ন্যায়বিচার পাওয়া ভারতবাসীর একটি মৌলিক অধিকার রূপে বিবেচিত হয়। এক্ষেত্রে বিচার বিভাগ। তথা আদালত কোনাে মামলাকে তখনই গ্রহণ করে যদি মামলাটির সঙ্গে দেশ তথা দেশবাসীর স্বার্থ নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত থাকে, তাহলে সেই মামলাটিকে জনস্বার্থ মামলারূপে চিহ্নিত করা হয়।
জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার উদাহরণ: যেসব বিষয়কে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইন ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী করা যায় না, সেইসকল বিষয় জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার অন্তর্ভুক্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে মিসা আইনের ১৭ (ক) অনুচ্ছেদ বাতিল করা, ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে বেগার শ্রমিকদের মুক্তি ও মজুরি বৃদ্ধি, ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে বধূহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের চরম শাস্তির সপক্ষে রায় দেওয়া, ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলাদের উপযুক্ত ভরণপােষণ বিষয়ে রায়দান, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে শিশু ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত চূড়ান্ত রায়দান।
জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা এলাকা: জনস্বার্থে যে-কোনাে সাধারণ নাগরিক, সমাজ সচেতন কোনো ব্যক্তি, কোনাে প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বৃহত্তর স্বার্থে বা কোনাে গরিব মানুষের স্বার্থে মামলা দায়ের করতে পারে। তবে এই মামলা গ্রহণ করার পূর্বে আদালতকে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই পর্যবেক্ষণ করতে হয়, যেমন─
- মামলাটি শুধুমাত্র জনস্বার্থ বিষয়ক কি না,
- মামলাটি কোনাে ব্যক্তিগত লাভের সঙ্গে যুক্ত হলে চলবে না,
- কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত আছে এমন কোনাে বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দাখিল করা যাবে না,
- কোনাে খারাপ মতলব বা অসাধু উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য জনস্বার্থ মামলা করা যাবে না।
জনস্বার্থ সংক্রান্ত মামলার বিষয়: যেসকল বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা করা যায় তার মধ্যে উল্লেখযােগ্য কয়েকটি হল─
- শিশু শ্রমিকদের বেগার খাটানাের বিরুদ্ধে,
- ঠিকাদার কর্তৃক শ্রমিককে শোষণ করার বিরুদ্ধে,
- বিচারাধীন বন্দিকে বেআইনিভাবে খাটানাের বিরুদ্ধে,
- পুলিশি হেফাজতে কোনাে ব্যক্তির উপর অকথ্য অত্যাচার,
- শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে, বৃহৎ কিছু নির্মাণে ইমারত কর্তৃপক্ষ এবং আইনি কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে,
- পরিবেশ দূষণ ও শব্দদূষণের বিরুদ্ধে,
- প্রাকৃতিক দুর্যোগে সরকারের গাফিলতি বা ব্যবস্থা গ্রহণে অহেতুক বিলম্ব হওয়ার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা দায়ের করা যায়।
সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের অগ্রণী ভূমিকা পালন: সংবিধানের ২২৬নং এবং ৩২নং ধারা অনুযায়ী হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট মূল এলাকার মধ্যে থেকে জনস্বার্থ বিষয়ক মামলায় সরকারের বিরুদ্ধে লেখ বা নির্দেশ জারি করতে পারে। জনস্বার্থ মামলাকে ইংরেজিতে PIL (Public Interest Litigation) বলে অর্থাৎ জনস্বার্থ মামলার ইতিবাচক দিকটি তুলে ধরে সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে বহু গণতন্ত্র বিরোধী আইন কিংবা শাসন বিভাগের অন্যায় নির্দেশ, আদেশকে বাতিল করে দিয়ে বহু সামাজিক অবক্ষয় ও বহু নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের স্বাধিকার ফিরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে। বর্তমান পরিবর্তিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা সুপ্রিমকোর্টকে নাগরিক স্বার্থরক্ষায় এক ইতিবাচক অগ্রণী ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করেছে।
সাম্প্রতিককালে আদালতের সদাজাগ্রত দৃষ্টি সরকারকে আইনের পথে চলতে ও আইন সঠিকভাবে প্রয়ােগ করতে বাধ্য করে এবং জনস্বার্থ রক্ষায় নাগরিকদের সচেতন করে তােলে। সামাজিক দায়বদ্ধতা পরিবেশগত সচেতনতার কারণে শোষিত-বঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে ন্যায়বিচার প্রদান ও প্রতিকার প্রদানের উদ্দেশ্যে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট যে নমনীয় ভূমিকা পালন করে এসেছে, তা যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে। এ ছাড়া প্রধান ধর্মাধিকরণ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট কোনাে মামলাকে জনস্বার্থ হিসেবে চিহ্নিত করে সেই মামলাটির প্রথমে গুরুত্ব উপলব্ধি করে। এরপর জনস্বার্থ বিষয়টিকে যথার্থ মূল্যায়ন করে, অবিচার এবং নিষ্পেশনের হাত থেকে দেশ ও দেশবাসীকে রক্ষা করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এ বিষয়ে সুতি বিচারপতি পি এন ভগবতী, কুলদীপ সিং, জে এম ভার্মা প্রমুখদের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে।
জনস্বার্থ মামলা সমালােচনা: তবে অনেকসময় পর্যাপ্ত কারণ ছাড়াও জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়ে থাকে। এই কারণে এই মামলা কিছুটা হলেও সমালােচিত হয়一
- জনস্বার্থ বিষয়ক মামলাগুলির বেশিরভাগই আইন ও শাসন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হলেও এই সমস্যা মােকাবিলার দায়িত্ব বিচার বিভাগের উপরও এসে পড়ে, ফলে আদালতে মামলার পাহাড় জমে ওঠে।
- জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার কারণে যখন আদালত শাসন বিভাগের পদস্থ অফিসার ও কর্মীদের কাজকর্মের উপর বিভিন্ন বাধানিষেধ আরােপ করে তখন শাসন বিভাগের আধিকারিকরা দায়িত্ববােধ পালন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। ফলে তারা স্বাধীনভাবে কোনাে ভূমিকা পালনে অগ্রসর হতে পারে না।
- কেবলমাত্র বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। আর্থ সামাজিক পরিবর্তন ও আধুনিকীকরণ প্রক্রিয়া জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে,পরিবেশ দূষণ কেবলমাত্র আইনি পথে মােকাবিলা করা সম্ভব নয়, এরজন্য চাই মানুষের সচেতনতা।
- লােকসভার অধ্যক্ষ সােমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উক্তিটি স্মরণীয়, বিচার বিভাগের কাজ আইন প্রণয়ন করা নয়, আইনকে বলবৎ করা। তবে জনস্বার্থ রক্ষার নামে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে বিভিন্ন মামলা গ্রহণ করে রায়দানে উদ্যোগী হয়েছে, সে বিষয়ে বিচার বিভাগের এই অতি-সক্রিয়তা’ জনগণ সহজে মেনে নিতে পারছে না।
যাইহােক বিভিন্ন সমালােচনা সত্ত্বেও জনস্বার্থ বিষয়ক মামলা বৃহত্তর সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নাগরিক অধিকারবোধকে যেভাবে প্রসারিত করেছে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তবে এর পাশাপাশি এ কথা ভুললে চলবে না যে, সম্প্রতি সরকারের জনমুখী কার্যকলাপের নামে জনস্বার্থবিরােধী যে-কোনাে কার্যকলাপের নিদর্শন প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আদালতের সঠিক হস্তক্ষেপ করা উচিত না অনুচিত, সেই নিয়ে গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষদের কাছে একটা সংশয় থেকেই যায়।