ব্যক্তি মানুষের নামের ক্ষেত্রে কানা ছেলের নাম পদ্মলােচন হলে ক্ষতি নেই। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কোনাে সাহিত্যকর্মের সার্থক নাম সেই রচনাটির প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে। অনেক সময় নামের মধ্য দিয়েই লেখক তার অভিপ্রেত বক্তব্যের ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন। কাজেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে দরকার হয় সার্থক নামকরণের। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আলােচ্য গল্পটির নাম দিয়েছেন ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’। এই গল্পের বিষয়বস্তুতে আছে বাঁচা-মরার প্রসঙ্গ, আছে বাঁচা, বাঁচাতে চাওয়া এবং বাঁচাতে না পারার কথা।
গল্পের প্রধান চরিত্র মৃত্যুঞ্জয় একদিন অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাথের উপর অনাহারে মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে পায়। এই দৃশ্য তাকে এতটাই আহত করে যে, তারপর থেকে তীব্র অপরাধবােধে ভুগে থাকে। অনাহারক্লিষ্ট মানুষের কথা ভেবে তার দৈনন্দিন আহারনিদ্রা ব্যাহত হয়। আদর্শবাদী চাকুরিজীবী যুবক মৃত্যুঞ্জয় স্ত্রী এক বেলা খাওয়া কমিয়ে সেই খাবার অভুক্তদের বিলিয়ে দিতে শুরু করে। এমনকি অফিসের পুরাে মাসমাইনেটা সহকর্মী বন্ধু নিখিলের হাতে তুলে দেয় ত্রাণ তহবিলের জন্য। শহরের ফুটপাথে ঘুরে ঘুরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত দের দুঃসহ যন্ত্রণার শরিক হয়। শেষ পর্যন্ত চাকুরি, পরিবার, সমাজ সবকিছু পরিত্যাগ করে না-খেতে পাওয়া মানুষদের দলে ভিড়ে তাদেরই একজন হয়ে ওঠে। তাদেরই মতা মুখ ভরতি দাড়ি নিয়ে মগ হাতে মারামারি করে লঙ্গরখানার খাবার খায় আর ফুটপাতে পড়ে থাকে।
অত্যন্ত সংবেদনশীল মৃত্যুঞ্জয় এবাবে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের জন্য সমব্যথী হয়ে তাদেরই একজন হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত সে কিন্তু কাউকেই বাঁচাতে পারে না। ভয়ংকর এই সমস্যার কোনাে সমাধান করতে পারে না। গল্পটি পড়তে পড়তে বােঝা যায়, একক মানুষের আন্তরিকতায় আত্মত্যাগে কিংবা সমানুভূতিসম্পন্ন হয়ে ওঠার মধ্যে এই সমস্যার প্রকৃত সমাধান নেই। এভাবে কেউ কাউকে বাঁচাতে পারে না, বাঁচতে পারে না নিজেও।
গল্পকার এই গল্পের মধ্যে একক মানুষের সেই ব্যর্থ প্রয়াস এবং দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ পরিণামকে প্রশমিত করার জন্য সমবেত স্বার্থত্যাগের একান্ত অভাব, এই দু-দিকেই অঙ্গুলি সংকেত করেছেন। আর সেখানেই ‘কে বাঁচায়, কে বাঁচে’ নামটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।