বাংলা রচনা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ
[ সংকেত : ভূমিকা; প্রাকৃতিক সম্পদের সংজ্ঞার্থ; ভূমি-সম্পদ; বনজসম্পদ; মৎস্য-সম্পদ; নদ-নদী; খনিজ-প্রাকতিক সম্পদ; সৌরশক্তি; উপসংহার । ]
ভূমিকা : প্রাকতিক সম্পদ যেকোনাে দেশের ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধির শিকড়স্বরূপ। বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক সম্পদ উলেখযােগ্য ভূমিকা রাখছে। তবে একথা ঠিক যে, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদ অপ্রতুল। তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এ সম্প যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হলে এদেশও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
প্রাকৃতিক সম্পদের সংজ্ঞার্থ : প্রকৃতি প্রদত্ত সম্পদই হলাে প্রাকৃতিক সম্পদ। সাধারণত এ সম্পদ সৃষ্টিতে মানুষের কোনাে অবদান নেই। তবে এ সম্পদের ব্যবহার থেকেই মানুষ উন্নতি আর অগ্রগতির সােপান নির্মাণ করতে পারে। ভূমি, খনিজ পদার্থ, প্রাকতিক গ্যাস, মৎস্য, জল, সৌরশক্তি, পাহাড়-পর্বত প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে পড়ে। এ সম্পদ দুই ভাগে বিভক্ত। যেমন- কিছু সম্পদ দীর্ঘস্থায়ী আর কিছু সম্পদের স্থায়িত্বকাল সীমিত। আবার এমন কিছু প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যা কখনােই নিঃশেষ হয় না এ ধরনের সম্পদের মধ্যে ভূমি-সম্পদ উল্লেখযােগ্য।
ভূমি-সম্পদ : পৃথিবীর যেকোনাে দেশের ভূমি একটি স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদ। এ সম্পদের মধ্যে নিহিত থাকে দেশের সুখ, সমৃদ্ধি আর আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধি । বিশ্বের জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি থাকলেও এখানকার উর্বর ভূমি যতটুকু আছে, তা এদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য যথেষ্ট, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, এ ভূমি-সম্পদের যথার্থ ব্যবহার হচ্ছে না। এখনও অনেক উর্বর জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলােতে। আবার মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যার ঘনবসতি শুধু শহর তথা শিল্পাঞ্চলগুলােতে। এছাড়াও গ্রাম-গঞ্জে অপরিকল্পিত গৃহায়ন এ সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করে । তবে বাংলাদেশের মাটিতে যে সবুজের সমারােহ দেখা যায়, তাতে এ সম্পদের অপরিসীম সম্ভাবনারই কথা বলে। এছাড়াও এদেশে রয়েছে মূল্যবান বনজসম্পদ।
মৎস্য-সম্পদ : বলা হয়ে থাকে মাছে ভাতে বাঙালি’ । এদেশের নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর-ডােবায় প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। জনগণের প্রায় পুরাে আমিষের চাহিদা এসব উৎস থেকেই মিটে । এছাড়া এদেশের বঙ্গোপসাগরে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়, যা বর্তমানে দেশের চাহিদা মিটিয়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়াও পরিকল্পিত উপায়ে চিংড়ি মাছের চাষও বাংলাদেশের জন্য এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে । ইদানীং চিংড়িও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ফলে এ উৎস থেকে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে।
খনিজ-প্রাকৃতিক সম্পদ : খনিজ সম্পদ যেকোনাে দেশের জন্য সবচেয়ে বড়াে প্রাকৃতিক সম্পদ। একটি দেশ কত সমৃদ্ধ তার। পরিমাপ তার খনিজসম্পদেই করা হয়। যদিও বাংলাদেশে খনিজসম্পদ পর্যাপ্ত নয় তবুও এদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মতাে খনিজসম্পদ যথেষ্ট রয়েছে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের সঙ্গে খনিজ তেল থাকার সম্ভাবনার কথা বলছেন; এজন্য আরও গবেষণা হওয়া উচিত। বাংলাদেশের উল্লেখযােগ্য খনিজ-সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, চিনামাটি, তামা, কঠিন, শিলা সিলিকা বালু, গন্ধক। সম্প্রতি সিলেটের হরিপুরে তেল খনির সন্ধান পাওয়া গেছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞমহল যথেষ্ট আশাবাদী। আর এ তেল খনির সম্ভাবনা যদি বাস্তবে পরিণত হয় তাহলে অচিরেই বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে ।
নিচে কয়েকটি খনিজ-প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলােকপাত করা হলাে :
প্রাকৃতিক গ্যাস : বাংলাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে প্রাকৃতিক গ্যাস। বর্তমানে বাংলাদেশে ২৭টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে। প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে এবং সর্বশেষ ২০১২ সালে কুমিল্লায় । বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়াে প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র হলাে তিতাস গ্যাসক্ষেত্র। এটি ১৯৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তান শেন অয়েল কোম্পানি কর্তৃক আবিষ্কৃত হয় আর এখান থেকে উত্তোলন শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। এদেশের উন্নয়নে প্রাকৃতিক গ্যাস বিশেষ অবদান রাখছে।
কয়লা : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে কয়লা উল্লেখযােগ্য। ১৮৫৭ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত অনেক ভূ-তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভূভাগের নিচে বিরাট আকারের কয়লাখনির অস্তিত্ব রয়েছে। অবশেষে ২০০৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর হতে দিনাজপুর জেলার বড়াে পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে বাণিজ্যিকভাবে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। এক্ষেত্রে বার্ষিক উত্তোলন লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক মিলিয়ন মেট্রিক টন অথবা দৈনিক তিন হাজার তিনশত টন । কিন্তু নানাবিধ কারণে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। তদুপরি বিশেষজ্ঞগণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা যায় কি না সে ব্যাপারে সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন । আর এটা সম্ভব হলে মােট মজুদের প্রায় ৯০ শতাংশ আহরণ করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের রাজস্বখাতকে সমৃদ্ধ করবে এবং জ্বালানি সংকট নিরসনে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে।
চুনাপাথর : বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ভূগর্ভস্থ চুনাপাথরের সঞ্চয় আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৯ সালে। আমেরিকার স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি বগুড়া জেলার কুমাতে চুনাপাথরের অনুসন্ধান পায়। ১৯৬৫ সালে এখানে চুনাপাথর উৎপাদন শুরু হয়। এ সময় পাকভারত যুদ্ধের কারণে ছাতকে অবস্থিত ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে সরবরাহের জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে চুনাপাথর আমদানি বন্ধ হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন টাকেরঘাটের চুনাপাথর খনি থেকে চুনাপাথর উত্তোলন করে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে সরবরাহ করে। এছাড়াও বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিন দ্বীপ এবং সুনামগঞ্জ জেলার ভাঙ্গেরঘাট, লালঘাট এবং জয়পুরহাট জেলায় চুনাপাথরের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও এ খনি থেকে চুনাপাথর সংগৃহীত হলে তা দেশের অর্থনীতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।
খনিজ তেল : বাংলাদেশের সিলেটের কৈলাসটিলা এবং হরিপুরে তেলের মজদের সন্ধান পাওয়া গেছে। পেট্রোবাংলার হিসাবমতে এ দুটি জায়গার তেলের পরিমাণ ১৩৭ মিলিয়ন ব্যারেল হলেও এর ৫৫ মিলিয়ন ব্যারেল উত্তোলন সম্ভব। তবে তেল উত্তোলনে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা না থাকায় বিদেশিদের সহায়তা গ্রহণ করতে হবে। এ তেল উত্তোলন সম্ভব হলে এর বাজারমূল্য দাড়াবে ৪২ থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতাে, যা এদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক।
সিলিকা বালু : বাংলাদেশের সিলিকা বালুও গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে এই সিলিকা বালুর সন্ধান পাওয়া। গেছে। এগুলাে আমাদের আর্থনীতিক উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে।
সৌরশক্তি : সূর্য অপরিসীম শক্তির উৎস। প্রতিনিয়ত সূর্য প্রচর উত্তাপ নিঃসরণ করে। কিন্তু এর অল্প পৃথিবীতে এসে পৌঁছে। বায়ুমণ্ডলের মােট শক্তির ৯৯.৯৭ শতাংশ সূর্য থেকে পাওয়া যায়। সূর্য থেকে আগত এই শক্তি বায়ুমণ্ডলে তাপীয় শক্তি তথা গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সর্য থেকে বিকিরণের মাধ্যমে পথিবীতে যে শক্তি ক্ষুদ্র তরঙ্গ আকারে আসে তাহ সােরলাক্ত বর্তমানে এই সৌরশক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যতের ঘাটতি অনেকটা নিরসন করা সম্ভব হচ্ছে। তথাপি এই শক্তিকে কাজে লাগানাের যথেষ্ট অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিদ্যুতের চাহিদা মিটাতে ইতােমধ্যেই উন্নত দেশগুলাে সৌরশক্তিকে নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার করছে। আমাদের দেশের সৌরশক্তিকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাতে হবে। এজন্য সকলেরই সহযােগিতা প্রয়ােজন।
উপসংহার : প্রাকৃতিক সম্পদ যেকোনাে দেশের সমৃদ্ধির মূল হাতিয়ার। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যেসমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে; তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ খুঁজে বের করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে এক্য প্রয়ােজন । তবে সার্বিক বিষয়াদি বিশ্লেষণ করে উপলব্ধি করা যায় যে, বাংলাদেশে এখনও অসংখ্য প্রাকৃতিক সম্পদ হয়তাে আমাদের অজানা রয়ে গেছে । ভাগ্যচক্রে যদি একসময় এসব সম্পদ আবিষ্কৃত হয় তাহলে দেশ হিসেবে আমরা অনেক সমৃদ্ধ হব নিঃসন্দেহে। আমরা সেই সােনালি দিনের প্রত্যাশায় আছি।