অথবা, একরাত্রি গল্পে বর্ণিত প্রেমের স্বরূপ আলোচনা কর
উত্তর: বাংলা সাহিত্যে সার্থক ছোটোগল্পের জনক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) শতান্ত্রিক ছোটোগল্প রচনা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিচিত্রধর্মী এ সকল গল্পে চিরন্তন বাঙালি সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আশা- নিরাশার কথা বর্ণিত হয়েছে। ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলোর মধ্যে যে কয়টি বিশ্বমানের প্রেমের গল্প হিসেবে ‘স্বীকৃতি পেয়েছে ‘একরাত্রি’ তার অন্যতম। এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ শাশ্বত প্রেমের এক অভূতপূর্ব কাহিনি বর্ণনা করেছেন যা পাঠককে মুগ্ধ ও বিমোহিত করে।
গল্পের কাহিনি: ‘একরাত্রি’ গল্পের কাহিনি একটি সুবিন্যস্ত পটভূমির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। গল্পের নায়কের শৈশবের খেলার সাথি সুরবালা একদিন যে তার জীবনের বিশেষ একটি উপাদানে পরিণত হবে সে আভাস গল্পের প্রারম্ভেই পাওয়া যায়। তাদের মায়েরা বলাবলি করতেন, ‘আহা দুটিতে ‘বেশ মানায়’। শিশু হলেও নায়ক এ কথাটার অর্থ বুঝত- ‘সুরবালার সঙ্গে একত্রে পাঠশালায় গিয়াছি, এবং বউ-বউ খেলিয়াছি।’ কিন্তু পরবর্তীতে লেখাপড়ার উদ্দেশে কলকাতায় গিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে নায়ক সুরবালাকে একেবারেই ভুলে যায়। দোশোদ্ধারে ব্যস্ত নায়ক সুরবালার অভিভাবকের দেওয়া বিয়ের প্রস্তাব অবহেলা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। গল্পের ভাষায় :
“কিন্তু এদিকে আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আজীবন বিবাহ না করিয়া স্বদেশের জন্য মরিব- বাপকে বলিলাম বিদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ সমাধা না করিয়া বিবাহ করিব না।”
পরবর্তীতে নোয়াখালির রামলোচন উকিলের সাথে সুরবালার শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। খবরটি নায়কের কানে পৌঁছালেও তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।
কাহিনির ঘনঘটা : এরপর নায়ক যখন এফ. এ. পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় তার পিতার মৃত্যু হলো। বিধবা মা ও দুটি অবিবাহিত বোনের দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় নায়ককে লেখাপড়া ও দেশোদ্ধারের মহান দায়িত্বে ইস্তফা দিয়ে রোজগারের পথে নামতে হলো। অনেক চেষ্টায় সে নোয়াখালির এক ছোট্ট শহরে এন্ট্রেন্স স্কুলের সেকেন্ড মাস্টারের চাকরি পেল। নায়কের আবাসিক ব্যবস্থা হলো স্কুলগৃহের একটি ছোটো কক্ষে। অবস্থাচক্রে সুরবালার স্বামী রামলোচন বাবু তার অনতিদূরেই সস্ত্রীক বসবাস করতেন। রামলোচন বাবুর সাথে তার আলাপ পরিচয় হলো। একদিন ছুটির দিনে নায়ক রামলোচন বাবুর সাথে গল্প করতে তার বাড়িতে গেল। সুরবালা তার সামনে এল না। এখন সে পরস্ত্রী, নায়কের বাল্যকালের খেলার সাথি নয়। সুতরাং পাশের ঘরে একটু খসখসানি, পায়ের একটুখানি শব্দ প্রভৃতি শুনেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হলো।
স্মৃতি সেতো বেদনা: এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বাস, সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে ঢল ঢল সুরবালার দুখানি চোখের কথা নায়কের স্মৃতিতে ভেসে উঠল। সহসা তার হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্ঠির দ্বারা চেপে ধরল এবং বেদনায় তার ভেতরটা টন টন করে উঠল। নায়ক উদ্ভ্রান্তের মতো বাসায় ফিরে এলেও সেই ব্যথাটা লেগেই রইল। কোনো কাজেই সে মন বসাতে পারল না। বাল্যকালে খেলার ছলে যে সুরবালা নায়কের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল যৌবনে সে সুরবালাকে স্পর্শ করা তো দূরের কথা তাকে এক নজর দেখার অধিকারও সে হারিয়ে বসেছে। সুরবালা এখন এক বেদনাময় স্মৃতিমাত্র।
নায়ক চরিত্রের অন্তরের হাহাকার: পিতার মৃত্যুতে তার সকল উচ্চাশা দূরীভূত হলে আত্মসমালোচনায় সে দগ্ধ হতে থাকে। সুরবালাকে অবহেলা করা এবং দেশপ্রেমের রঙিন স্বপ্ন তার কাছে বাতুলতা মনে হয়। যে সুরবালাকে সে সহজেই লাভ করতে পারত- আজ তার সাথে একটি কথা বলার অধিকারও তার নেই। সুরবালাকে সে হারিয়েছে নিজের খামখেয়ালির জন্য। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সুরবালা এবং নায়ক আজ একই শহরের বাসিন্দা। নায়ক সেকেন্ড মাস্টারির চাকরি নিয়ে যে-শহরে আসে সেখানেই বাস সরকারি উকিল রামলোচন রায়ের। নায়ক আগেই জানত এ রামলোচনের সাথেই বিয়ে হয়েছে তার বাল্যসখী সুরবালার। সমস্ত কল্পনার উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো যখন নির্বাপিত তখনই নায়কের পাশে আবার নতুন করে উদয় হয় সুরবালা। একদিন রামলোচন বাবুর বাসায় গিয়ে গল্প করতে করতে তার কানে এল, পাশের ঘরে অত্যন্ত মৃদু, একটি চুড়ির টুংটাং, কাপড়ের একটু শব্দ এবং জানালার ফাঁকে দুটি চোখের কৌতূহলভরা দৃষ্টির অনুভূতি। গল্পের ভাষায়:
“তৎক্ষণাৎ দুখানি চোখ আমার মনে পড়িয়া গেল- বিশ্বাস, সরলতা এবং শৈশবপ্রীতিতে ঢলঢল দুখানি বড়ো বড়ো চোখ, কালো কালো চোখের তারা, ঘনকৃষ্ণ পল্লব, স্থিরস্নিগ্ধ দৃষ্টি। সহসা হৃৎপিণ্ডকে কে যেন একটা কঠিন মুষ্টির দ্বারা চাপিয়া ধরিল এবং বেদনায় ভিতরটা টন্টন্ করিয়া উঠিল।”
রামলোচন বাবুর বাড়িতে সুরবালার উপস্থিতি সেকেন্ড ‘ মাস্টারকে অতীত জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়- সেই হলো যন্ত্রণার আরম্ভ। স্কুলের সেই চালাঘরে, দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে ঈষৎ উত্তপ্ত বাতাসে নিমগাছের পুষ্পমঞ্জরির সুগন্ধে অথবা সন্ধ্যায় পুষ্করিণীর ধারে সুপারি-নারিকেলের অর্থহীন মর্মরধ্বনি শুনতে শুনতে মনে হতো সুরবালাকে আজ চোখের দেখাও পাপ, সে আজ তার কেউ নয়- অথচ সামান্য ইচ্ছা করলেই সুরবালা তার কি না হতে পারত।
কাহিনির উপসংহার: দিন যেতে লাগল। নায়কের সমস্ত প্রেমিক মন জুড়ে সুরবালা বিরাজ করতে থাকল। এক সোমবারে সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। বিকেলের দিকে মুষলধারে বৃষ্টি এবং ঝড় আরম্ভ হলো। রাতে ঝড়ের বেগ বাড়তে লাগল। নায়ক জানত, রামলোচন বাবু একটা বড়ো মকদ্দমার কাজে বাইরে গিয়েছেন এবং এ দুর্যোগের রাতে সুরবালা একাই ঘরে অবস্থান করছে। দ্বিপ্রহর রাত্রে বানের ডাক শোনা গেল। চারদিক জলমগ্ন। সে যখন স্কুলের পুষ্করিণীর শুকনা পাড়ে গিয়ে উঠল তখন দেখা গেল বিপরীত দিক থেকে আত্মরক্ষার্থে সুরবালাও সেই পাড়ে এসে দাঁড়ায়। তখন প্রলয়কাল। পৃথিবীর সমস্ত আলো নিবে গিয়েছে- একটা ঢেউই হয়তো তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে এক করে দিতে পারে। কিন্তু এ প্রতিকূল পরিবেশে অন্ধকারের মধ্যে উভয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েও কেউ কাউকে একটা কুশল প্রশ্নও করতে পারল না। কেবল দুজনে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। গল্পের ভাষায়:
“রাত্রি প্রায় শেষ হইয়া আসিল- ঝড় থামিয়া গেল, জল নামিয়া গেল- সুরবালা কোনো কথা না বলিয়া বাড়ি চলিয়া গেল, আমি কোনো কথা না বলিয়া আমার ঘরে গেলাম।”
একরাত্রি গল্পের প্রেমের স্বরূপ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একরাত্রি’ একটি উন্নত মানের প্রেমের গল্প। যে প্রেম শুধু কাছেই টানে না, পরস্পরকে দূরেও ঠেলে দেয় সেই মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেমই গল্পটির উপজীব্য। কৈশোরে ও যৌবনের প্রারম্ভে গল্পের নায়কের মনে যে প্রেম বিকশিত হওয়ার ফুরসৎ পায়নি, নায়িকা পরহস্তগত হওয়ার পর সেই প্রেম ষোলকলায় পূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু তখন প্রেম নিবেদনের পাত্রীটি নায়কের নাগালের বাইরে। তাকে হাজার চেষ্টা করেও স্পর্শ করা দূরে থাক এক নজর দেখার অধিকারও প্রেমিক হারিয়ে ফেলেছে। নায়কের সমস্ত দিনরাত্রি দখল করে নিয়েছে তার স্বপ্নের নায়িকা সুরবালা। নায়কের এ প্রেমচিন্তার সাথে দেহজ কামনার কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রেমিকের সমস্ত সত্তার মাঝে প্রেমিকার অদৃশ্য উপস্থিতি প্রেমকে কামনার আগুনে দহন করতে পারেনি। তাই তো যখন এক দুর্যোগের কাল রাত্রে নায়ক নায়িকাকে দখল করার কোনো প্রতিবন্ধকতা যেখানে আদৌ ছিল না তখন একে অপরকে ছুঁয়ে দেখা তো দূরের কথা একটা কথাও বলতে পারেনি। সমস্ত প্রকার জাগতিক চাওয়া- পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা তাদের স্বর্গীয় প্রেমের কাছে কপূরের মতো উবে গিয়েছে। নায়কের মধ্যে যে উন্মত্ত কামনার লেলিহান শিখা প্রজ্বলিত ছিল তা শাশ্বত প্রেমের স্পর্শে মুহূর্তের মধ্যে নির্বাপিত হয়ে গিয়েছে। নায়িকা চলে গেলে নায়ক নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছে যে :
“মহাপ্রলয়ের তীরে দাঁড়িয়ে সে অনন্ত আনন্দের আস্বাদ পেয়েছে এবং ঐ একটিমাত্র রাত্রিই তার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা কাহিনি।”
উপসংহার : আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা বলা যায় যে, ‘একরাত্রি’ গল্পে যে প্রেমের পরিচর্যা করেছেন গল্পকার সে প্রেম কামনাবর্জিত এক মহৎ স্বর্গীয় প্রেম। এই প্রেম নায়িকাকে ঘর থেকে টেনে বের করার পরিবর্তে স্বামীর ঘরে ফিরে যেতে সাহায্য করেছে। জাগতিক প্রাপ্তি এই প্রেমের কাছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়। অনুভব ও উপলব্ধির পবিত্র পরশে এ প্রেমের আলো নায়ককে মহিমান্বিত করেছে- যা তার সমস্ত জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যময় ক্ষণ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সে মুহূর্তের কথা মানুষ কখনও ভুলতে পারে না।
Leave a comment