অথবা, মৃণাল কেন আর মাখন বড়ালের গলি বা নিজের স্বামী-সংসারে ফিরতে চায় না?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পে পনেরো বছরে পত্নী জীবনের অভিজ্ঞতা, অনেক গ্লানি স্বীকার করে অনেক দুঃখকষ্ট সয়ে মৃণাল বুঝেছে সে মনুষ্যত্বের চরম বিকাশ পত্নীতে নয়, নারীত্বে।

‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের নারী আধুনিক সভ্যতার-চিন্তাশক্তির প্রথম প্রতিনিধি- যে প্রথাগত সমাজকে ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে উন্মুক্ত পৃথিবীতে- এখানেই তার চরিত্রের অনন্যতা। তার চিঠিতে স্বামীর প্রতি সম্বোধন ছিল তোমার। অর্থাৎ তার অভিযোগ ও বিদ্রোহ শুধু স্বামীর প্রতি ছিল না, ছিল তৎকালীন স্বার্থপর পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উপর, সামন্ততান্ত্রিক পরিবারের প্রতি। প্রতিবাদস্বরূপ প্রথাগত সমাজ-সংসার ছেড়ে সে বেরিয়ে পড়েছে পৃথিবীর পথে- সেখানে নেই বাধা বা বন্ধন, পদে পদে বিধিনিষেধের শিকল। বাইরের জগতে এসে সে মুক্তির আনন্দ খুঁজেছে। মৃণাল প্রথাগত সমাজ থেকে বেরিয়ে তীর্থে গমন করে। সেখান থেকে সে তার স্বামীকে চিঠি লিখেছে। সংসারের বহু বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল সে। তার একমাত্র মুক্তির জায়গা ছিল লুকিয়ে কবিতা লেখা। তার একটি মেয়ে হয়েই মারা যায়। যখন ঘরকন্নাই তার একমাত্র কাজ তখন সে পেল বিন্দুকে। বিন্দু ছিল তার বড় জা এর বোন। সে তার বিধবা মায়ের মৃত্যুর পর খুড়তুতো ভাইদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে এ সংসারে এসেছে। মৃণাল বিন্দুকে ভালোবাসে কিন্তু বাড়ির লোক বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তাই তারা বিন্দুকে বিয়ে দেয়। বিন্দুর স্বামী পাগল বলে সে কাপড়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। কিন্তু মৃত বিন্দুও তাদের বিষবাক্য থেকে রক্ষা পায়নি। বিন্দুর বোনও ঘরের মধ্যে লুকিয়ে কাঁদল। সংসারের মাঝে মেয়ে মানুষের অবহেলিত জায়গাটি মৃণাল তখন কষ্ট করে বুঝতে পারে। বিন্দু অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। মধ্যবিত্ত পরিবারে নারীর অবস্থান জটিল সেটা মৃণাল চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং বিন্দু চরিত্রটি সেটাকে আরো একটুখানি অগ্রগতি সাধন করেছে। বিন্দু মৃণালের চেতনায় জ্বেলে দিয়েছে মুক্তির আলো। নারী জাতির প্রতি অমানবিক আচরণে জ্বলে উঠেছে মৃণাল আপন সত্তায়। মৃণালের পরিবার ছেড়ে চলে আসার ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সমাজব্যবস্থাকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছেন। ব্যক্তি সচেতন মানুষ অস্তিত্ববাদী তাই মৃণাল গতানুগতিক মানুষের মতো আত্মহত্যা করেনি। তীর্থে এসে তাই সে সংসারের কারাভোগ বুঝতে পারল। মৃণাল তাই মরতে চায় না, মানুষের মতো বেঁচে থাকতে চায়। সে তার মেজ বউ পরিচয় মুছে ফেলে বাঁচার মতো বাঁচবে। তাই সে স্বামীর বাড়িতে আর ফিরবে না। আর এভাবেই মৃণাল চরিত্র রবীন্দ্রছোটোগল্পে তথা বাংলা ছোটোগল্পে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।