অথবা, চণ্ডীদাসের পদসমূহের শিল্পমাধুর্য বিচার কর

উত্তর: বাংলা ভাষায় রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা গানে আদি ও সর্বজন প্রিয় কবি হলেন চণ্ডীদাস। বিদ্যাপতির মতো তিনিও মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি। বাংলার রজকিনী প্রেমিক বাশুলী সেবক পল্লিকবি চণ্ডীদাস রামীকে কেন্দ্র করে কামগন্ধহীন নিকষিত দেহ সদৃশ যে প্রেমামৃতের সন্ধান পেয়েছিলেন কৃষ্ণ প্রিয়ার চিত্রাঙ্কনে সেই বৈরাগিনী যোগিনী প্রেম সাধিকাকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। ভক্তিরস বাজনকারী ভগবৎ প্রেম সাধিকার কোমল বেদনা শ্রীমুখী রূপটি কবির চোখে ধরা পড়েছিল। সেজন্যই তাঁর ভাষা ও ছন্দে সরল অলঙ্কারবিহীন এক প্রাণস্পর্শী আবেগ অজস্র করুণাধারায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।

বৈষ্ণব পদকর্তা হিসেবে চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করলে দেখা যাবে তিনি সহজভাবের আত্মতন্ময় কবি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

“চণ্ডীদাস সহজ ভাষায়, সহজভাবের কবি,”

তাঁর কবি প্রতিভা মূলত গীতিধর্মী। চণ্ডীদাস তাঁর সৃষ্ট রাধাকে আপনার আত্মার প্রতিফলন হিসেবে গড়েছেন। রাধার ভাবানুভূতিকে দূরে দাঁড়িয়ে নিরাসক্ত আর্টিস্টের দৃষ্টিতে দেখা ও রূপবদ্ধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি আপন কবিসত্তাকে রাধার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছেন। রাধা যখন বলে,

‘নাম পরতাপে যার ঐছন করল গো

অঙ্গের পরশে কিবা হয়।’

‘নাম পরতাপে যার ঐছন করল গো অঙ্গের পরশে কিবা হয়।’

তখন এই তন্ময় প্রেমাকুলতায় রস বিগলনে চণ্ডীদাস নিজেও বিগলিত হয়েছেন। রাধার ক্রন্দনে কবির ব্যক্তি অনুভূতি ও প্রেম জিজ্ঞাসার আর্তি ঝংকার তুলেছে। এই অর্থেই চণ্ডীদাসের কবিতার গীতিধর্ম সার্থক।

চণ্ডীদাসের কবিতার কাব্য সৌন্দর্য বিচারে আরেকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে; তা হলো কবি অতিমাত্রায় আবেগপ্রবণ। অনুভূতির রসাপুতি তাঁর কবিতার প্রাণ। বুদ্ধির দীপ্তির অপেক্ষা তিনি রাখেন না। যুক্তির ক্রম তাঁর কবিতায় মেলে না। এই আবেগ প্রবণতা আবার অতিমাত্রায় কোমল এবং স্পর্শকাতর, একান্ত করুণ এবং বাংলার জলভরা শ্যামল মেঘের সাথে তুলনীয়। সমালোচক নীলরতন সেনের ভাষায়,

“প্রতিটি কথায় তিনি যেন এক প্রাণভরা

অভিমান- স্নেহ-বিষাদ মেশানো গভীর

রসনিষিক্ততার স্বাক্ষর রেখেছেন।” (চণ্ডীদাসঃ বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়)

চণ্ডীদাসের রাধা বিদ্যাপতির রাধার মতো মন ও দেহের বর্ণোজ্জ্বলতার অত চমক সৃষ্টি করেনি, কামাসক্তিবিহীন প্রগাঢ় প্রেমচিত্রাঙ্কনে ভাষা ও ছন্দেও কবি নিরাভরণ তন্ময় চিত্ররূপের আশ্রয় নিয়েছেন। চণ্ডীদাসের রাধা প্রেমব্যাকুলতায় ভাবগভীরতায় আত্মায় গভীরতম প্রদেশে অবতারণ করেছে। কৃষ্ণই তার ধ্যানজ্ঞান। একটি নামের সংকেতেই কল্পনার ধন কৃষ্ণ যেন রাধার কাছে মূর্তি ধারণ করে। তাই রাধা বলেছে,

‘সই, কেবা শুনাইল শ্যাম-নাম

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।’ (পদ-৫৭)

কৃষ্ণপ্রেমে আকুল রাধা প্রাকৃত সংসার ধর্ম ত্যাগ করে যোগিনীর রাঙাবাস ধারণ করে প্রেম বৈরাগিনী হয়েছে। চণ্ডীদাসের তুলিতে আঁকা কৃষ্ণদর্শনাকুলা রাধার রূপ হলো,

‘ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার

তিলে তিলে আইসে যায়।

মন উচাটন নিশ্বাস ষঘন

কদম্ব-কাননে চায়।।

চণ্ডীদাসকে বিশেষভাবে বলা হয় ‘আক্ষেপানুরাগের কবি’। অনুরাগ মিশ্রিত আক্ষেপের ভাবব্যঞ্জনা তাঁর রাধার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। কৃষ্ণপ্রেমে ব্যাকুল রাধা সমাজ সংসারের নিন্দা ও ধিক্কারকে অবহেলা করে কেবল প্রাণের, প্রেমের আকর্ষণে ঘর ছেড়েছিল। সেই রাধা প্রিয়তম কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তার যে বেদনা তা নিদারুণ। এই প্রত্যাখ্যানজনিত বেদনায় রোমান্টিক সৌন্দর্য বিরহের অতি গভীর সুর মিশে আছে। রাধা বলেছে,

‘কি মোহিনী জান বঁধু কি মোহিনী জান।

অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন ৷৷

‘ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর।

পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর ৷৷ (পদ-১২২)

এ বেদনা নারীর- বিশেষকরে বাংলার ভাবপ্রবণ পল্লিবালার একান্ত অনুভূতি। কৃষ্ণ তা বুঝবে না। তাই রাধার হৃদয় মন্থনজাত উক্তি,

বঁধু তুমি যদি মোরে নিদারুণ হও।

মরিব তোমার আগে দাঁড়াইয়া রও। (পদ-১২২)

প্রিয়তমের ব্যবহারে যখন মনে আক্ষেপ জাগে, সংশয় আসে তখন আপন মৃত্যু কামনা ছাড়া তার মুখে ভাষা থাকে না।

অভিসার সাজসজ্জায় দুর্নিবার পথ পরিক্রমায় লীলাময়ী যে রাধাকে বিদ্যাপতি বা গোবিন্দদাস চিত্রিত করেছেন চণ্ডীদাসের অভিসারিকা প্রেমাকুলা রাধা তার থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। চণ্ডীদাসের রাধার প্রাকৃত গৃহকর্ম, স্বামী সেবায় রজনী যায়। প্রতীক্ষারত কৃষ্ণের কাছে যেতে রাধা ব্যাকুল হলেও পথ নেই; কেননা ‘ঘরে গুরুজন ননদী দারুণ।’ ফলে রাধার বিলম্ব হয়। কিন্তু প্রেমিক কৃষ্ণ তার দেরি দেখে নিজেই যখন উপস্থিত হয় তখন রাধা বলে উঠে,

“এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা

কেমনে আইল বাটে।

আঙ্গিনার মাঝে বঁধুয়া ভিজিছে

দেখিয়া পরাণ ফাটে ।। (পদ-১৬৫)

এ রাধা ঠিক অভিসারিকা নয়। প্রেমের মাদকতায় রাধা বিহ্বল হয়েও কৃষ্ণের দুঃখে তার প্রাণ কাঁদে। তাই কৃষ্ণকে কাছে পেয়েও মিলনের দিনেও রাধার বিচ্ছেদের ভয়। গভীর আলিঙ্গনেও রাধা বলে,

‘দুহু ক্রোড়ে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাৰিয়া।

আধ তিল না দেখিলে যায় যে মরিয়া’। (চণ্ডীদাস পদ-১৮৮)

নিখিলের রূপ থেকে অরূপের দিকে চিরন্তন সৌন্দর্য প্রেমকামনার ও বিরহের এই সুতীব্র সুগভীর আর্তি চণ্ডীদাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “চণ্ডীদাসের মিলনেও সুখ নেই। চণ্ডীদাস প্রেমকেই জগৎ বলে জেনেছেন। বিদ্যাপতি ভোগের কবি, চণ্ডীদাস সহ্য করার কবি। চণ্ডীদাস সুখের মধ্যে দুঃখ এবং দুঃখের মধ্যে সুখ দেখতে পান। চণ্ডীদাসের প্রেম “কিছু কিছু সুধা বিষগুণ আঠা।” …………তাই তো তাদের মিলনে ‘দুহুঁ কোরে দুহু কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া।’

চণ্ডীদাসের কবিতার সম্যক স্ফূর্তি দুঃখ বিরহ-বেদনার বর্ণনায়। খণ্ডিতা রাধার যে চিত্র চণ্ডীদাস এঁকেছেন, তা তিরস্কারের অগ্নি, সেখানেও অভিমান-অশ্রুতে নির্মল হয়ে উঠেছে। সখীকে আপন দুঃখের কথা বলতে গিয়ে রাধা বলেছে,

সই, কেমনে ধরিব হিয়া

আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায়

আমার আঙিনা দিয়া ৷৷ (পদ-১৯০)

চণ্ডীদাস ঠিক মানুষের কবি না। যেখানে মিলনের দিনেও রাধার বিচ্ছেদের ভয়, সেখানে মধুর-বিরহ সৃষ্টির কোনো অবকাশ কবি রাখেননি। কৃষ্ণ মথুরায় চলে গেলেও রাধা তার গুমরানো ক্রন্দন বাইরে প্রকাশ করতে পারেনি। দীর্ঘকাল পরে দেখা হলে প্রবাস প্রত্যাগত কৃষ্ণকে শুধু বলেছে,

বহু দিন পরে বঁধুয়া এলে।

দেখা না হইতে পরাণ গেলে।।

এতেক সহিল অবলা ব’লে।

ফাটিয়া যাইত পাষাণ হ’লো।। (পদ-২৭৮)

এখানে ব্যঙ্গ-ভর্ৎসনার জ্বালা নেই, আছে অসংখ্য বেতনার্ত কথা, বুকের রক্ত নিংড়ানো দীর্ঘশাস।

চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদগুলোর মধ্যে প্রাণের যে সুগভীর আকুলতা প্রকাশিত হয়েছে তা কবির কবিক্ষমতারই উপযুক্ত। ভাষা এত সহজ বলেই এত মর্মস্পর্শী। অলঙ্করণের চেষ্টা নেই বলেই এর আবেদন এত অভ্রান্ত ও মর্মমূল স্পর্শী বেদনার তীব্রতা সঞ্চার করে। জনৈক সমালোচক চণ্ডীদাসকে বাংলা ‘কবি ভাষার জনক’রূপে চিহ্নিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে সমালোচক নীলরতন সেনের মন্তব্য, “চণ্ডীদাসের ভাষায় শব্দসম্পদে বাংলার স্বকীয় স্নেহ-অনুযোগ, সৌন্দর্যের ধারাস্নান, সুখ-দুঃখ নিঙড়ানো প্রেমের আর্তি, লোক-চেতনার বিভিন্ন প্রকাশ, পদাবলীর একটি নিজস্ব। প্রকাশ-রীতির পরিচয় বহন করছে।” (বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়)

অলঙ্কার সচেতন কবি না হলেও চণ্ডীদাসের পদে অনেকাংশে স্নিগ্ধ প্রচ্ছন্ন অলঙ্করণ সৌন্দর্য লক্ষিত হয়। যেমন-

ব্যতিরেক অলঙ্কার: ‘এমন পিরীতি কভু নাহি দেখি শুনি’। (পদ-১২৪)

পরাবৃত্তির অলঙ্কার: ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু পর। (পদ-১২২)

উপমা অলঙ্কার : কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি

ঘষিতে সৌরভময়।

রূপক অলঙ্কার : পিরীতি পালঙ্কে শয়ন করিব

পিরীতি সিথান মাথে।

চণ্ডীদাসের সর্বাধিক প্রিয় ছন্দোবধ ছিল ৬/৬/৮ মাত্রা ভাগের লঘুত্রিপদী। দৃষ্টান্ত :

যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু

লোক অপযশ কয়

সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি

আর জানি কার হয়। (পদ-১৯০)

পরিশেষে বলা যায় যে, চণ্ডীদাসের ভাষায় যে সরলতা, অকৃত্রিমতা ও অলঙ্কারহীন চিত্রধর্মিতা তা পরবর্তীকালের অনেক কবি চেষ্টা করেও তেমনভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। চণ্ডীদাস খুব সামান্য সরল সহজ কথায় একেকটি ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন। এটাই তাঁর কবি প্রতিভার বৈশিষ্ট্য।