“এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
উত্তর : শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত বৈষ্ণব মতবাদের সম্প্রসারণে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ব্যাপক বিকাশ ঘটে। পদাবলী সাহিত্য বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য। বৈষ্ণবমতে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। এই প্রেম সম্পর্ককে বৈষ্ণব মতাবলম্বীগণ রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা রূপকের মাধ্যমে উপলব্ধি করেছেন। বৈষ্ণব ধর্মমতকে কেন্দ্র করে যে বৈচিত্র্যধর্মী সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে তাকে বৈষ্ণব সাহিত্য নামে চিহ্নিত করা হয়। পদাবলীর কবিগণ বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের পটভূমিকায় অপূর্বসুন্দর পদগুলো রচনা করেছিলেন। কবিহৃদয়ের অকৃত্রিম অনুভূতির প্রকাশ এবং এর সর্বজনীন আবেদনের জন্য পদাবলী গীতিকবিতার মর্যাদালাভের যোগ্য। পদকর্তাগণের রচিত এসব কবিতা সুরের মাধ্যমে যখন মানবহৃদয়ে অনির্বচনীয় ভাবাবেগের সৃষ্টি করে তখন তাকে সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার মর্যাদা দেওয়া যায়। বৈষ্ণব পদাবলীর মধুর রসের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের রূপকাশ্রয়ে ভক্ত ও ভগবানের নিত্য বিরহমিলনের যে লীলাবৈচিত্র্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য নিহিত। বৈষ্ণবেরা ভগবান ও ভক্তের সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণকে পরমাত্মা বা ভগমান এবং রাধাকে জীবাত্মা বা সৃষ্টির রূপক মনে করে তাঁদের বিচিত্র প্রেমলীলার মধ্যেই ধর্মীয় তাৎপর্য উপলব্ধি করেছেন। বৈষ্ণব পদাবলীতে এই প্রেমলীলা প্রকাশিত হয়েছে রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়ের মাধ্যমে। আর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলা বিষয়ক এই পদগুলো পদকর্তাগণ প্রকৃতি। ও পরিবেশের সাথে সমন্বয় করে প্রকাশ করেছেন, যার ফলে এগুলো হৃদয়গ্রাহী এবং আকর্ষণীয় হয়েছে। বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস, চণ্ডীদাস প্রত্যেকের পদেই প্রকৃতির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যাপতির পদাবলীতে ধর্মীয় আবেগের চেয়ে রসবোধই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। উপরিউক্ত পঙ্ক্তিটি বিদ্যাপতির রচনা। এই পঙ্ক্তিতে কৃষ্ণপ্রেমে আকুল বিরহী রাধার চিত্তচাঞ্চল্যকে অসাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের আবহে তুলে ধরা হয়েছে। এ আকুলতা এ বিরহ শুধু রাধার একার নয়- সমগ্র বাঙালি নারীর বিরহ। কবি বিদ্যাপতি বলেন-
“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
ঝম্পি ঘন গর জন্তি সন্ততি
ভুবন ভরি বরি খন্তিয়া।
কান্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া ॥”
ভাদ্র মাসের ভরা বাদলের সময় প্রেমিক কাছে না থাকলে মন বিষণ্ণতায় ভরে ওঠে। হৃদয় শূন্য খা খা করে। বর্ষার ধারার সাথে সাথে প্রেমিক হৃদয়ের যন্ত্রণা ধারা সমভাবে প্রবাহিত হয়। চারদিকে কেঁপে মেঘ গর্জন করছে, ভুবন ভরে বর্ষণ হচ্ছে, কান্ত প্রবাসী, কাম দারুণ, সঘন খর শর হানছে। বিদ্যাপতি প্রকৃতির আবরণে রাধাহৃদয়ের অবারিত প্রেমকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন এই পদে। প্রকৃতির সাবলীল প্রবহমানতার মাঝে বিরহী রাধার চিত্ত প্রকাশিত।
Leave a comment