উত্তর: চণ্ডীদাসের পদাবলীর যদি কোনো একটি স্থায়ী সুর থাকে, তবে তা বেদনার সুর, আক্ষেপানুরাগের সুর। বিদ্যাপতির পদে যেমন ঐকান্তিক আর্তির সঙ্গে বিলাসবিভ্রম ও মিলনোল্লাসের তীব্র বিষামৃত পরিবেশিত হয়েছে, পদাবলীর চণ্ডীদাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। বস্তুত নিছক দেহকেন্দ্রিক মিলনরস, কারাকান্তির আসবমত্ততা-এ সমস্ত পদাবলীর চণ্ডীদাসে বিশেষ নেই। কৃষ্ণের পূর্বরাগের বর্ণনায় কিছু কিছু বাস্তব সৌন্দর্যের ইঙ্গিত আছে। কৃষ্ণের উক্তি:

সই মরম কহিয়ে তোরে।

আড় নয়নে ঈষৎ হাসিয়া

বিকল করল মোরে ॥

ফুলের গেঁড়ুয়া লুফিয়া ধরয়ে

সঘনে দেখায় পাশ।

উচ কুচযুগ বসন ঘুচায়ে

মুচকি মুচকি হাস ॥

চণ্ডীদাসকে সমালোচকগণ আধ্যাত্মিক কবি বলে বর্ণনা করে থাকেন। রাধার দেহসৌন্দর্যের প্রতি কৃষ্ণের আকর্ষণ অনুরাগ বর্ণনা করতে গিয়ে চণ্ডীদাসকে কিছু কিছু আদিরসাত্মক চিত্রকল্প গ্রহণ করতে হয়েছে। সিক্তবসনা শ্রীরাধাকে দেখে কৃষ্ণের উক্তি :

চলে নীল শাড়ী নিঙ্গাড়ি নিঙ্গাড়ি

পরাণ সহিত মোর।

সেই হৈতে মোর হিয়া নহে থির

মনমথ জ্বরে ভোর ॥

অপূর্ব দেহসৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে চণ্ডীদাসের কোনো জুড়ি নেই। কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাস দেহের কবি নন, আনন্দবিলাসের কবি নন। যেখানে তিনি দেহের কথা বলেছেন তার প্রায় সবটাই কৃষ্ণের উক্তিরূপে প্রকাশ পেয়েছে। চণ্ডীদাসের দুই একটি পদে সম্ভোগের চিত্রও আছে :

বিগরিত কেশ কুন্তল শিখিচন্দ্রক

বিগরিত নিতল নিচোল।

দুহুক প্রেমরসে ভাসল নিধুবন

উছলল প্রেমহিলোল।

চণ্ডীদাসের পদাবলী হতে রাধার চরিত্রটি যেন জীবন লাভ করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনেকে বলেছেন চণ্ডীদাসের রাধা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত নয়। এর কারণ, হয়ত বা তাঁর পদের শান্ত, স্নিগ্ধ, সমাহিত ভাব। কোনো অতিরিক্ত সউচ্ছ্বাস তাঁর পদগুলোতে স্থান পায়নি। দীনেশচন্দ্র সেন বলেন, ‘চণ্ডীদাসের বাণী সহজ, সরল ও সুন্দর।’ চণ্ডীদাস যে ধ্যানপরায়ণা রাধিকার মূর্তিটি দেখিয়েছেন, তার অশ্রুসজল নেত্র আমাদেরকে স্বর্গীয় প্রেমের স্বপ্ন দেখিয়ে চৈতন্যপ্রভুর দুটি সজলচক্ষুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই মূর্তি ভাষার পুষ্পপল্লবের বহু ঊর্ধ্বে নির্মল অধ্যাত্ম্যরাজ্য স্পর্শ করে অমর হয়ে আছে। সেখানে সাহিত্যিক সৌন্দর্যের বিড়ম্বনা নেই। চণ্ডীদাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন :

“চণ্ডীদাস গভীর এবং ব্যাকুল, বিদ্যাপতি নবীন এবং মধুর।….

চণ্ডীদাস আসিয়া চির পুরাতন প্রেমের গান আরম্ভ করিয়া দিলেন।”

চণ্ডীদাসের সহজ সরল রাখালী সুরের মধ্যে মানবজীবনের দেশকালাতীত আনন্দবেদনার বাণী ধ্বনিত হয়েছে। তাঁর প্রেম- বিরহ-মিলন দেহকে অবলম্বন করেও দেহাতিচারী। তিনি রচনা সৌন্দর্যের জন্য যে সমস্ত অলঙ্কারের সাহায্য নিয়েছেন, সেগুলো একেবারে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন-

  1. ক্ষুরের উপর রাধার বসতি নড়িতে কাটিয়ে দেহ।
  2. জল বিনে মীন জনু কবচুঁ না জীয়ে।
  3. তুষের অনল যেন সাজাইয়া এমতি পুড়িয়া মরে।
  4. কানুর পিরীতি চন্দনের রীতি ঘষিতে সৌরভময়।

উপরিউক্ত অলঙ্কারগুলো থেকে এ কথা স্পষ্ট যে তিনি কৃত্রিম কবিত্বের মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বর্ণনা করেননি। যা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, তেমন বাকরীতিই চণ্ডীদাসের আকর্ষণ। তাঁর পদ উপভোগ করতে হলে পাঠককেও কিছুটা কল্পনা কুশলতার অধিকারী হতে হবে। চণ্ডীদাসের কাব্যে গ্রাম- বাংলা তার প্রকৃতি ও মানুষ তার সাবলীল সত্তায় উদ্ভাসিত। সমস্ত কবিকুলের মধ্যে চণ্ডীদাস অনন্য। চণ্ডীদাসের মতো বাস্তব জীবনের মুখোমুখি আর কোনো বৈষ্ণব কবি দাঁড়াননি। কোনো রমণীয় কল্পলোকে নয়, জীবনকে প্রত্যক্ষ করে তাঁর তথ্যভিত্তিক কাব্যকে দাঁড় করাবার চেষ্টা বাঙালি পদকর্তাদের মধ্যে একমাত্র চণ্ডীদাসই করেছেন। চণ্ডীদাস সৌন্দর্যের দাস নন, সহজের সন্তান । চণ্ডীদাস বাংলাদেশের কবি, আপামর জনসাধারণের কবি।