উত্তর: অলঙ্কারশাস্ত্রে নয় প্রকার স্থায়ীভাব ও তা থেকে জাত নয়টি রসের কথা স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যেই বৈষ্ণব পদাবলী রচিত হয়েছিল বলে বৈষ্ণব পদকর্তাদের কিছুটা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে হয়েছে। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে পঞ্চরসকেই শুধু স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এই পঞ্চরস হলো-‘শান্ত, দাস্য, বাৎসল্য, সখ্য এবং মধুর বা উজ্জ্বল’।

এদের মধ্যে মধুর রসকেই সর্বোত্তম বলা হয়েছে-কারণ রাধাকৃষ্ণলীলার বিভিন্ন পর্যায় যথার্থ অভিব্যক্তি পেয়েছে একমাত্র মধুর রসেই।

শান্তরস গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুকূল নয়। মোক্ষলাভেচ্ছু ব্যক্তিই শান্তরসের অধিকারী, কিন্তু গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা মোক্ষবাঞ্ছাকে ‘কৈতবপ্রধান’ বলে মনে করেন, তাই বৈষ্ণব কবিতায় শান্তরসের স্থান নেই। অবশ্য চৈতন্যপূর্ব যুগের কবি বিদ্যাপতির ‘নিবেদন’ শীর্ষক পদগুলো শান্তরসের অপূর্ব নিদর্শন।

গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতে প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভক্তের সম্পর্ক কখনো প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক হতে পারে না বলেই বৈষ্ণব পদে দাস্যরসের পরিচয় পাওয়া কঠিন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা চলে যে বাংলার বাইরে কোথাও কোথাও এই দাস্যভাব দেখতে পাওয়া যায়।

যশোদার মনে বালক কৃষ্ণ বিষয়ে যে স্নেহব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, তাকে অবলম্বন করে বেশকিছু উৎকৃষ্ট বাৎসল্য রসের পদ রচিত হয়েছে বাল্যলীলা পর্যায়ে। বালক কৃষ্ণ ক্রমে কিশোর হয়ে সখাদের সঙ্গে গোষ্ঠে যেতেন-এই গোষ্ঠলীলা পর্যায়ের পদে সখ্যরসের প্রকাশ ঘটেছে।

এই গোষ্ঠযাত্রার পথেই রাধাকৃষ্ণের পরস্পর দর্শনলাভ ঘটে, কৃষ্ণের বাঁশী শ্রীমতী রাধাকে আকুল করে তোলে-এখান * থেকেই শুধু মধুর রূপ। বস্তুত বৈষ্ণব পদাবলীর বৃহত্তম ও মহত্তম অংশ এবং রাধা কৃষ্ণলীলার সমগ্র অংশই মধুর রসাশ্রিত। অধ্যাপক ড. সত্যজিৎ গোস্বামীর মতে তাই- “বৈষ্ণব পদাবলীর ভিত্তি বৈষ্ণবীয় পঞ্চরস বলে উল্লেখ করা হলেও বস্তুত বৈষ্ণব, পদাবলীর মূল ভিত্তি মধুর রস।

পঞ্চরসরূপ পঞ্চস্তম্ভের উপর বৈষ্ণব পদাবলী স্থাপিত, কিন্তু মধুর রসটিই তার কেন্দ্রীয় স্তম্ভ, বাকি চারটি রস প্রান্তিক স্তম্ভ হিসেবেই পরিগণিত হতে পারে মাত্র।”