অথবা, বৈষ্ণব পদাবলী কতটা গীতিকবিতা – আলোচনা কর

উত্তর : গীতিকবিতা হলো গান-কবিতার সংমিশ্রণ। [জা. বি. ২০১৯/ গীতিকবিতা কবির ব্যক্তিগত অনুভূতির বিচিত্র প্রকাশ। গীতিকবিতায় ব্যক্তি-মানুষের মনের ভাব ও চিন্তাচেতনার স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটে। গীতিকবিতার কথক একাকী আপন মনে তাঁর হৃদয়-ভাবনার কথা তুলে আনেন। কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি যখন সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে সংগীতমুখর হয়ে আত্মপ্রকাশ করে তখনই গীতিকবিতার জন্ম হয়।

সীমিত অর্থে গীতিকবিতা হিসেবে বৈষ্ণব পদাবলী : সংস্কৃত কবি জয়দেব, মৈথিলি কবি বিদ্যাপতি, বাঙালি কবি বড় চণ্ডীদাস ও দ্বিজ চণ্ডীদাস পদাবলী সাহিত্যে প্রচুর খ্যাতিলাভ করেন। মধ্যযুগের গীতিকবিতা বলতে আমরা বৈষ্ণব পদাবলীকেই বুঝি। মূলত এগুলো গান হিসেবে লেখা হয়েছিল।বৈষ্ণব কবিগণ প্রত্যেকেই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের সাধনামার্গও সম্প্রদায়গত ছিল। তাই তাঁদের কবিতায় ব্যক্তিগত কথা অপেক্ষা সম্প্রদায়গত তথা সাধনতত্ত্বের কথাই বাণীবিন্যাস লাভ করেছে। অপরপক্ষে আধুনিক গীতিকবিতা বস্তুত • গান নয়- এগুলো প্রধানত কবিতা। আর কবির একান্ত ব্যক্তিগত চেতনা অনুভূতির মিশ্রণের ফলেই বৈষ্ণব পদাবলী গীতিরসোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব পদাবলীতে মানবরসরেই ধর্মরসে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক ও আদর্শ গীতিকবিতায় বিশ্বচেতনা কবির আত্মচেতনায় মানব-রসই অভিষিক্ত হয়েছে। বৈষ্ণব পদাবলীর বিষয় আঙ্গিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়- এতে গীতিকবিতার সুরমূর্ছনা ফল্গুধারার ন্যায় প্রবহমান। মধ্যযুগের গীতিকবিতা ও আধুনিক গীতিকবিতার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও একটি বিষয় এক ও অভিন্ন। আর তা হলো গীতিকবিতায় কবির একান্ত অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। বৈষ্ণব কবিরা রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের আড়ালে যে কথা বলেছেন- তা একেবারেই তাঁদের ব্যক্তিক অনুভূতিজাত। ধর্মমূলক চিন্তা বা ভক্তিমূলক ভাবনাকে ছাপিয়ে এসব কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে মানবাত্মার প্রথম ও প্রধানতম অনুভূতির প্রকাশ। আর এ কারণেই বৈষ্ণব-পদাবলীতে মূর্ত হয়ে উঠেছে রক্ত-মাংসের মানব-মানবীর গভীর হৃদয়ের আকুতি ও সংবেদনশীলতা। যেমন-

ক. “সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পসিল গো

আকুল করিল মোর প্রাণ।”

খ “সই কেমনে ধরিব হিয়া

আমার বঁধুয়া আনবাড়ী যায়

আমার আঙিনা দিয়া ॥

গ. “রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।

প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁন্দে প্রতি অঙ্গ মোর।

হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কাঁন্দে।

পরাণ পিরিতি লাগি থির নাহি বান্ধে।”

রাধাকৃষ্ণ বিষয়ে লেখা এই কবিতাগুলো ভাব, ভাষা, রচনারীতি বা প্রেমানুভূতির বিচিত্রতা কোনো দিক থেকেই মানবিক অন্যান্য কবিতার চেয়ে কম নয়। প্রকৃতপক্ষে বৈষ্ণব কবিরা তাঁদের চিন্তা-চেতনাকে পদের কোথাও ধর্মীয় ভাবনা দ্বারা আচ্ছন্ন করে ফেলেননি। তাঁদের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে হৃদয় কুসুমকলি আপনি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে তাঁদের রচনায়। এর ফলে মধ্যযুগের সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলী গীতিকবিতার মর্যাদায় উন্নীত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। মূলত চৈতন্যপূর্ব পদাবলী সাহিত্যে ধর্মীয় আবহ থাকলেও পরবর্তী সময়ে তা দূরীভূত হয়ে রাধা-কৃষ্ণরূপী মানব-মানবীর হৃদয়কথাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই সার্বিক বিচারে বলা যায়- বৈষ্ণবপদাবলী পরিপূর্ণভাবে গীতিকবিতা না হলেও সীমিত অর্থে গীতিকবিতা।