অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যানুসারে রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা চরিত্রের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর
উত্তর: ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের আকর্ষণীয় ও প্রধান চরিত্র রাধা। এ চরিত্রটি পুরাতন বাংলা কাব্য সাহিত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রিত পূর্ণাবয়ব চরিত্র। রাধাকে কেন্দ্র করে আখ্যান বস্তুর বিবর্তন। রাধা চরিত্রের পরিকল্পনা কবি বড়ু চণ্ডীদাসের নিজস্ব কৃতিত্ব। কাব্যের গঠন, বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা ও রচনাশৈলীতে নানাপ্রকার দৈন্য থাকলেও এ চরিত্র অঙ্কনে কবি অসামান্য নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। সেজন্য রাধা চরিত্রই কেন্দ্রীয় চরিত্র।
রাধা চরিত্র সম্পর্কে প্রধান কথা হলো এর বিবর্তন ধর্ম। পরিবর্তন মান চরিত্র চিত্র পুরানো সাহিত্যে একান্ত দুর্লভ। সেদিক দিয়ে রাধা অদ্বিতীয়। সমালোচক শ্রীশঙ্করী প্রসাদ বসুর ভাষায়,
“চর্যাপদের পর কৃষ্ণকীর্তন যদি সর্বাধিক পুরাতন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন হয়, তবে বলিব, ইহার মধ্যে প্রাচীন কবি মনের সৃষ্টি, প্রাচীন কবি সংস্কারের অনুগত যে নারী চরিত্রটি পাইলাম, সে নারী কিন্তু চিরন্তনী- যুগের খোলসটি ছাড়াইয়া ফেলিলে চির মানবের রক্তস্পন্দিত দেহবিগ্রহ বাহির হইয়া আসিবে। সে নারী ‘তিন ভুবনজয়- মোহিনী’, শিরীষকুসুম কোঁঅলী, ‘অদ্ভুত কনকপূতশী’ ‘চন্দ্রাবলি রাহি।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মধ্যযুগের কবি ও কাব্য)
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধা রক্তমাংসে গঠিতা নারী। বৈকুন্ঠের লক্ষ্মী বা কৃষ্ণের হাদিনী শক্তি নয় সাধারণ একেবারেই লৌকিক। তার মধ্যে মানবীয় গুণের বিকাশ ঘটেক্কেবারেই রোমান্টিকা নয়, বাস্তবিক। কবি রেমীকাল খেটেছে। সে লেমিয়েছেন। মস্তার মুখের ভাষাটুকু তার নিজের। কবি সম্পূর্ণ আত্মসংহরণ করে রাধাকে আত্মপ্রসারের সুযোগ দিয়েছেন। তার প্রেম চেতনার পরিণতির প্রত্যেকটি স্তরের নিপুণ আলোক সম্পাদনে কবি যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা বিস্ময়কর।
রাধা চরিত্রের ক্রমবিবর্তন মনস্তাত্ত্বিক। এ মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ভিত্তিতে রাধার যৌবন চেতনাই প্রধানত ক্রিয়াশীল। বড়ু চণ্ডীদাস এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি দেখিয়েছেন রূপদর্শনজনিত প্রথাসিদ্ধ পূর্বরাগ ব্যতীত নিতান্ত দেহ মিলনের দ্বারা পুরুষের প্রতি নারীর প্রেম কিভাবে পল্লবিত ও বিকশিত হয়ে উঠতে পারে তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কন করেছেন। রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশের স্তরগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রথম পর্যায়ে কৃষ্ণের প্রতি রাধার প্রবল বিরূপতা ও বিতৃষ্ণা। গল্পের প্রারম্ভে রাধা ‘এগারো বছরের বালিকা’। যার মধ্যে যৌবন চেতনা জাগেনি এবং সে ‘আইহনের রানি।’ এই এগারো বছরের বালিকাকে কবি সুনিপুণভাবে অঙ্কন করেছেন। অল্প বয়সেই তার অসাধারণ আত্মস্বাতন্ত্র্যবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘তাম্বুল খণ্ডে’ কৃষ্ণ বড়ায়ির নিকট রাধার অপূর্ব রূপের কথা শুনে প্রেম নিবেদন করে তাম্বুল পাঠাল। কিন্তু রাধা ঘৃণাভরে সেই দান প্রত্যাখ্যান করল। কৃষ্ণের দেহকামনাকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছে। তাছাড়া সে হিন্দু ঘরের মেয়ে, মনে সতীত্ববোধ গেঁথে আছে। সংস্কার তার চিরকালের সম্পদ। অবস্থাপন্ন ঘরের বধূ সে কারণে গর্বও অল্প নয়-
‘বড়ার বৌহারী আহ্মে বড়ার ঝি।’
স্বামী নিয়ে তার অভিযোগের কোনো কারণ ঘটেনি। তাই আত্মমর্যাদার ঘোষণা-
‘ঘরের স্বামী মোর সর্বাঙ্গে সুন্দর
আছে সুলক্ষণ দেহ।
নান্দের ঘরের গরু রাখোআল
তা হলে কি মোর নেহা।’
তাই কৃষ্ণের প্রেরিত তাম্বুল এবং দেহমিলনের আবেদন রাধা ফিরিয়ে দিয়েছে।
এই রাধাই একদিন কৃষ্ণ কৃষ্ণ করে পাগল হয়েছে- রূপ, যৌবন, পতি-পরিজন, লাজ-লজ্জা, কুল-গোকুল সব ত্যাগ করে কৃষ্ণ সন্ধানে ছুটে গিয়েছে- রাধা চরিত্রের এই ক্রমবিবর্তনই বড়ু চণ্ডীদাসের কৃতিত্ব। তিনি রাধা চরিত্রের এই মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনকে সুকৌশলে তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে কবি অত্যন্ত সতর্ক পদক্ষেপে দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ‘তাম্বুল খণ্ডে’ কৃষ্ণের কপূর তাম্বুল রাধা ‘পেলাইল পাত্র’; দানখণ্ডে রাধার অনিচ্ছাকৃত আত্মসমর্পণ যার মধ্যে মনের কোন সম্পর্ক নেই। ‘নৌকাখণ্ডে’ কৃষ্ণের কামনা, রাধার প্রত্যাখ্যান, অবশেষে বাধ্য হয়ে রাধার আত্মসমর্পণ প্রায় বল প্রয়োগের সমান। তবে ‘নৌকাখণ্ড’ হতেই কৃষ্ণের প্রতি রাধার আসঙ্গ লিপ্সা অঙ্কুরিত হতে থাকে। ‘ভারখণ্ডে’ রাধা অনেক পরিমাণে সক্রিয়। ভারবহনে কৃষ্ণকে সে নিয়োজিত করেছে। ‘ছত্র’ ও ‘বৃন্দাবন’ খণ্ডে রাধা কৃষ্ণের প্রতি আরেকটু আকৃষ্ট হয়েছে। এখানে প্রেম ও দেহমিলনে রাধার সক্রিয়তা স্পষ্ট। ‘যমুনা’ ও ‘হার’ খণ্ডে তার মনে একটা প্রতিক্রিয়ার ভাব লক্ষ করা যায়। যশোদার কাছে রাধা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তার হার ছিনিয়ে নেবার। ‘বাণখণ্ডে’ কবি সুকৌশলে কৃষ্ণের হাত দিয়ে রাধাকে পুষ্পশরে বিদ্ধ করলেন। পুষ্পশরে মূর্ছিতা রাধা কৃষ্ণের স্পর্শে সঞ্জীবিত হয়েছে। এখানে তার সব বাধা ঘুচে গেছে এবং হৃদয়কামনা উদ্দাম হয়ে উঠেছে।
অতঃপর বংশীখণ্ড। এ খণ্ডেই রাধার পূর্বরাগ প্রকট হয়ে উঠেছে। একদিকে সামাজিক সংস্কার, অন্যদিকে কৃষ্ণের দুর্নিবার বংশীধ্বনি- এ দুইয়ের সংঘাতে তার চিত্ত উদভ্রান্ত পদাবলীর রাধিকার মতো রাধা বংশীধ্বনি শ্রবণে আত্মহারা, পাগলপারা। বাঁশির মধুরস্বরে রাধার অন্তরে কৃষ্ণপ্রেম গাঢ়; তাই বলেছে,
‘বাঁশীর শবদেঁ প্রাণ মরিআঁ
কাহ্ন গেলা কোন দিশে।
তা বিণি সকল আন্তর দহে
যেন বেআপিল বীষে।’ (বংশী, ৩)
বংশীধ্বনি শ্রবণে রাধার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় চির যুগের বিরহী হৃদয়ের ভাবোচ্ছ্বাস-
‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।। (বংশী, ২)
জাগতিক কোনো ব্যাপারে রাধার আর আকর্ষণ নেই। কৃষ্ণের রূপানুরূপে আকৃষ্ট রাধা তার পাদপদ্মে আত্মসমর্পণ করে বলেছে,
‘আজি হৈতে চন্দ্রাবলী হৈল তোর দাষী।’ (বংশী, ৪১)
এবং কি ব্যাকুলতা তার কথায় প্রকাশমান,
শ্রীনন্দনন্দন গোবিন্দ হে।
অনাথী নারীক সঙ্গে নে। (বংশী, ১৯)
বংশীখণ্ডের পরই বিরহখণ্ড। এ খণ্ডে কৃষ্ণবিরহে উন্মাদিনী রাধার হৃদয়ভেদী করুণ আর্তনাদ ফুটে উঠেছে। তাঁর প্রেমানুভূতি অন্তরের গভীরতম প্রদেশ হতে উৎসারিত হয়ে সমগ্র বিশ্ব সংসারে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বিশুদ্ধ কৃষ্ণপ্রেমে রাধার চিত্ত ভরপুর। কিন্তু কৃষ্ণ ধরা দিচ্ছে না। রাধার নিকট পৃথিবী শূন্য, জীবন অসার, যৌবন জঞ্জাল। সুদীর্ঘ বিরহখণ্ডে রাধার হৃদয়মন্থন- প্রাণ পীড়ন নানাসুরে ও ছন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়েছে। সেই বিভিন্ন বিচিত্র অবস্থা কবি বর্ণনা করেছেন সুনিপুণভাবে:
কখনো আত্মগ্লানি- পূর্ব সংস্কৃতির জন্য অনুতাপানল বিপুল , আক্ষেপ,
‘বিরহে বিকল গোসাঞি তোলো বনমালী।
সবে আছিলাহোঁ আহ্মে আতিশয় বালী। (বিরহ, ২৪)
কখনো সামাজিক সংস্কার, কলঙ্কের জ্বালা-
‘সামী মোর দুরুবার গোআলা বিশাল
প্রতি বোল ননন্দ বাছে।
সব গোপীগণে মোরে কলঙ্ক তুলিআঁ দিল
রাধিকা কাহ্নাঞির সঙ্গে আছে।’ (বিরহ, ১৩)
রাধার বিরহের একমাত্র শান্তি স্বপ্ন মিলনে। রাধা কেবল জাগরণে বা শয়নে নয়, স্বপ্নের মধ্যেও কৃষ্ণের ছবি দেখছে-
‘দেখিলোঁ প্রথম নিশী সপন সুন তোঁ বাসী
সব কথা কহিআরোঁ তোহ্মারে হে।
বসিআঁ কদমতলে যে কৃষ্ণ করিল কোলে
চুম্বিল বদন আহ্মারে হে।’ (বিরহ, ২)
কিন্তু সে স্বপ্ন ভেঙে যায়-
‘দারুণ কোকিল নাদে ভাঁগিল আহ্মার নিন্দে।’ (বিরহ, ২)
যে কৃষ্ণের জন্য রাধা নানা কৃষ্ণসাধন করেছে, সেই কৃষ্ণই এখন তার প্রতি বাম। প্রিয় মানুষের এ অন্যাসক্তি রাধার কাছে সবচেয়ে বড়ো বেদনা-
‘যে কাহ্ন লাগিয়া সো আন না চাহিলোঁ বড়ায়ি
না মানিলোঁ লগু গুরু জনে
হেন মনে পড়িহাকে আহ্মা উপেখিআঁ রোষে
আন লআঁ বঞ্চে বৃন্দাবনে।’ (বিরহ, ১৩)
বিরহিণী রাধা তাই মর্মভেদী জ্বালায় বলেছে,
‘দদ বুলি ঝাঁপ দিলোঁ সে মোর সুখাইল ল
মোওঁ নারী বড় অভাগিনী।’ (বিরহ, ১৩)
পদাবলীর রাধার মতো সর্বস্ব পরিত্যাগ করে যোগী ময়ে চলে যেতে চাইছে,
‘মাথা মুণ্ডিআঁ যোগিনী হআঁ
বেড়ায়িবোঁ নানা দেশে।’ (বিরহ, ১৮)
বিরহখণ্ডে রাধার বিরহের বেদনা সুগভীর আর্তি ফুটে উঠেছে। কৃষ্ণ বিহনে দুঃখে আতিশয্যে রাধা বার বার বলেছে,
‘সকল সন্তাপ কাহ্ন সহিবাক পারী।
তোর বিরহসন্তাপ সহিতে না পারী।’ (বিরহ, ৪০)
কখনো কাতর কণ্ঠে আবেদন জানায়,
‘আল মের বড়ায়ি
কাহাঞি মোরে আনি দে’।
‘রাধা বিরহ’ অংশে রাধা চরিত্রটি যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শে পরিকল্পিত হয়েছে। কৃষ্ণের প্রতি রাধার যে আর্তি কৃষ্ণসঙ্গ লাভের জন্য রাধার যে বিলাপ তা যদিও দেহমুখী, কিন্তু বিরহ বেদনায় আতপ্ত স্পর্শে মানবী রাধা যেন সহসা মহিমান্বিত লোকে উত্তীর্ণ হয়েছে। সমালোচক ড. অমিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন তা হলো,
“রাধার চপলতা, পরিহাস, শানিত ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা সবই ‘রাধা বিরহে’ আসিয়া একান্ত আত্মনিবেদনের অশ্রু ভারাতুর আকাঙ্ক্ষায় সরসর করিয়া কল্পিত হইয়াছে। রাধা বিরহে রাধা কৃষ্ণের আসঙ্গ লাভ করিয়াছে বটে, কিন্তু তাহাতে আর ‘আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি-ইচ্ছা’র উতল উতরোল নাই, দেহের আসক্তি আছে, কিন্তু লালসা নাই।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চরিত্র চিত্রণ ও কাব্যস্বরূপ)
বিরহখন্ডে এসে তাই আমরা রাধা চরিত্রের এক অন্ত জাগতিক সৌন্দর্যের সন্ধান পাই। রাধাকৃষ্ণ প্রেমে আর খাদ নেই। সমস্ত বিশ্ব সংসারের সামনে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে আপন বেদনা ঘোষণা করবার অবস্থায় পৌঁছেছে। বলবার সুরে তাই এক অপরূপ উদ্দীপ্তি-
‘ এরূপ যৌবন ভার কাহ্ন বিণি আসার
তা লাগি গরল শোঞে খায়িবোঁ।’ (বিরহ, ৫৫)
একদিন যে বালিকা নীতি বহির্ভূত অসামাজিক প্রেমের। বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, সেই রাধাই আবার কৃষ্ণপ্রেমে সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে উদভ্রান্ত হয়ে উঠেছে। বড়ু চণ্ডীদাস অনুপম কবি প্রতিভায় রাধা চরিত্রের এ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন এবং তার স্বরূপ তুলে ধরেছেন। রাধা চরিত্রের এ ক্রমবিকাশ যেন মানব ধর্মেরই প্রাধান্য ঘোষণা করে।
রাধা চরিত্রের ক্রমবিকাশের স্তরগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেল এ চরিত্র অঙ্কনে কবির পারঙ্গমতা অসাধারণ। রাধার * কারণেই ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যটি একটি ‘জীবনোজ্জ্বল’ কাব্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এর সৌন্দর্যবোধ পাঠককে. আকৃষ্ট করেছে। বড়ু চণ্ডীদাস সুনিপুণ ভাষ্যকারের মতো রাধার হৃদয় যন্ত্রণা, বিরহ বেদনা ও প্রেমচেতনা পরিস্ফুট করেছেন।
Leave a comment