অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের ‘বংশী’ ও ‘রাধাবিরহ’ খন্ডের কাব্য সৌন্দর্য আলোচনা কর
উত্তর : লিখিত সাহিত্যের সর্বজন স্বীকৃত আদি নিদর্শন হচ্ছে কবি বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। রাধা কৃষ্ণের প্রণয় লীলাই এ কাব্যের প্রধান উপজীব্য। এ কাব্যের কাহিনি তেরো খণ্ডে বিভক্ত। ভাগবতের সাথে এর পার্থক্য কাহিনিগত ও রসগত। ‘জন্ম’ খণ্ডের পর ‘তাম্বুল’ খণ্ড থেকে ‘বাণ’ খণ্ড পর্যন্ত কাম শাস্ত্রের আদি রস বা দেহজ প্রেমের বর্ণনা। সমালোচকের ভাষায়, “উদগ্র যৌন তৃষ্ণার লেলিহান জিহ্বা যেন কাব্যের রসটুকু প্রায় নিঃশেষে পান করিয়াছে।” কিন্তু ‘বংশী’ ও ‘রাধা বিরহ’ খণ্ডে এই দেহজ প্রেমের বর্ণনা অনুপস্থিত। এখানে কবি যে অদ্ভুত কবিত্ব শক্তির স্ফুরণ দেখিয়েছেন তা তাঁর গভীর সৌন্দর্যবোধ ও শালীনতার পরিচয়বাহী।
‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’র পদগুলো পদাবলীর মতো স্বতন্ত্র খণ্ড কবিতা নয়। কবি খণ্ড কবিতা রচনা করার জন্য এ কাব্য লেখেননি। এতে যে পদগুলো রচিত হয়েছে সেগুলো সংলাপমুখর সংগীতময়তার ভিতর দিয়ে কাহিনিকে গতি দিয়েছে। আরম্ভ এবং কাহিনি বিস্তারে নাটকীয়তা রয়েছে এবং এর বর্ণিত বিষয়ে লোলুপ কামনা, অশ্লীল আবহে অমার্জিত অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট একথা স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডে কবির কাব্য ভাবনা এক নতুন মোড় নিয়েছে। প্রচলিত পদাবলীর মত ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডের অনেকগুলো পদই গীতি কবিতার পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলা নিয়ে গ্রন্থটি রচিত হলেও কবির ব্যক্তিমনের উচ্ছ্বাস অনেক স্থলে কাব্যটিকে ‘লিরিক-ধর্মী’ করেছে। বিশিষ্ট সমালোচক অধ্যাপক ক্ষেত্র তাঁর ‘প্রাচীন কাব্য সৌন্দর্য জিজ্ঞাসা ও নব মূল্যায়ন’ গ্রন্থে বলেছেন,
“অনেক পদে রাধার হৃদয়ানুভূতির প্রকাশ ঘটনা পরিক্রমার সামান্য সূত্রে বদ্ধ বলেই অনেকটা তথ্যভারমুক্ত বিশুদ্ধি অর্জন করেছে। বড়ুর লিরিথিজম বিচারে এরাই অবলম্বন। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, বংশীখণ্ডে এবং অন্যত্র দু-চারটি করে আছে, বাকি সবগুলোই বিরহখণ্ডে। ………………… এগুলোতে চণ্ডীদাসের পদাবলীর অরূপ ইন্দ্রিয়াতীতের ব্যঞ্জনা না থাকলেও, গভীর আন্ত রিকতার অভাব নেই।” (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)
এই মন্তব্য থেকে আমরা বুঝতে পারি ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডে কবি বড়ু চণ্ডীদাস লিরিকধর্মী কবিতা রচনা করেছেন। এ দুটি খণ্ডে তিনি যে মন্ময় সুরের আবেশ জাগানিয়া আর্তি প্রকাশ করেছেন তাতে তাঁর অনন্য কবি প্রতিভার আশ্চর্য পরিচয় মেলে।
‘বংশীখণ্ডে’ কৃষ্ণের বাঁশীর সুরে রাধা আকুলা। যমুনায় জল আনতে গিয়ে রাধা কৃষ্ণের বাঁশী শোনে। এ বাঁশীর সুরে তার সমস্ত কার্য বিপর্যস্ত হয়। কৃষ্ণ বাঁশীর সুরে তাকে উন্মনা করে পালিয়ে বেড়ায়, ধরা দেয় না। বিরহিণী রাধার সেই চিত্র চরিত্র কবি অপূর্ব কবিত্বের সাথে বর্ণনা করেছেন। এখানে আমরা প্রথম শুনি রাধার উক্তি,
‘কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকুলে।
কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।।
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন।।
………………………………………………………………
আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন।।’ (বংশী, ২)
এ পদটি রাধার ব্যক্তিগত জীবন ভাবনার প্রতিফলনে উজ্জ্বল। এখান থেকেই আমরা লক্ষ করি, পদাবলীর সুরের সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সুরের আন্তরিক মিল।
‘বংশী’ খণ্ডের সূচনাতেই আমরা আরেকটি বিষয় লক্ষ করি যে, কাব্যের স্থূলভাব অনেকটা অপসারিত হয়েছে। নায়ক-নায়িকা উভয়ের চরিত্রেই একটা অভাবনীয় পরিবর্তন এসেছে। কৃষ্ণের রাধার দেহের উপরে আর কোনো আকর্ষণ নেই। অন্যদিকে বাঁশীর সুরে উন্মাদিনী রাখা বৃন্দাবন কুঞ্জে প্রেমাভিসারে যাত্রা করবার জন্য উন্মুখ হয়েছে।
‘বাঁশীর শবদেঁ চিত্ত বেআকুল বড়ায়ি
জাইবোঁ তার অনুসারে।’ (বংশী, ১১)
অবশেষে কৃষ্ণকে কাছে পেতে রাধা কৃষ্ণের মোহনবাঁশী চুরি করে বড়ায়ির পরামর্শে। কৃষ্ণ রাধাকে নানাভাবে বলে বাঁশী ফিরিয়ে দিতে, কখনো অনুরোধ কখনো ভয় প্রদর্শন করে। কিন্তু রাধা চুরির অপরাধ স্বীকার করে না। এ পদগুলোতে দ্বন্দ্বের সুর আছে যা নাটকীয়তা প্রকাশ করেছে। রাধা কৃষ্ণের কলহে নাটকীয় দ্বন্দ্ব সংক্ষোভ তীব্র। দৃষ্টান্ত,
কৃষ্ণ- ‘সুণহ আইহনদাসী তোঁ মোর চোরায়িলি বাঁশী
তেঁসি তোর পাছে বেড়ায়িএ।
বাঁশীগুটী দেহ যবে বড় পুণ পাহ তবে
বাঁশী পাইলে সুখে ঘর জাইএ।’
বাঁশী যবে পাইএ তবে ঘসি ঘাটিএ
চারি চীর করি বা পোড়াইএ।’ (বংশী, ৩৬)
পদগুলোর নাটকীয়তা কবির কবিত্বের উৎকর্ষে অনুপম। তাছাড়া স্বাধীন পদ হিসেবেও এগুলো মূল্য বহন করে। ‘রাধাবিরহ’ খণ্ডে রাধার মনোভাবকে কবি আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে রূপ দিয়েছেন। রাধার কৃষ্ণার্তি বিরহখণ্ডের প্রতি ছত্রে মূর্ত হয়ে উঠেছে। রাধা কৃষ্ণের জন্য ব্যাকুল। সে শয্যা রচনা করে কৃষ্ণের অপেক্ষায় আছে। রাত গভীর হল তবু কৃষ্ণ এল না। রাধার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে আপন মনের আর্তি বড়ায়ির কাছে প্রকাশ করল একান্তই আপন সুরে,
“যে কাহ্ন লাগিয়া মো আন না চাহিলোঁ
বড়ায়ি
না মানিলোঁ লগু গুরু জনে
হেন মনে পড়িহাসে আহ্মা উপেখিআঁ রোষে
আন লআঁ বঞ্চে বৃন্দাবনে।’ (বিরহ, ১৩)
তাঁর আক্ষেপ বাণীর মধ্যে ধ্বনিও হয়েছে শির যুগের বিরহীর আকুল আর্তনাদ :
‘দহ বুলী ঝাঁপ দিলোঁ সে মোর সুখাইল ল
মোওঁ নারী বড় অভাগিনী।’ (বিরহ, ১৩)
বিরহজনিত অবস্থায় রাধার উক্তির মধ্যে কবির গভীর জীবন বোধ উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়েছে :
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী। (বংশী, ২)
‘বংশী’ খণ্ডেই প্রথম রাধার মধ্যে বিরহজনিত গভীর ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল; ‘রাধা বিরহ’ খণ্ডে এসে রাধার সেই বিরহ ব্যাকুলতা তীব্র আকার ধারণ করে। এখানে রাধার যে বিরহ বেদনা তা পদাবলীর রাধিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পদাবলীর রাধিকার মতো কৃষ্ণপ্রাণগতা রাধা যোগিনীর মতোই প্রেম দুশ্চর তপস্যায় রত:
‘যোগী যোগ চিন্তে সেহ্নমনে।
কাহ্নাঞি ছাড়ী না জানো মো আনে।’ (বিরহ, ১০)
রাধার মনোবেদনা ও করুণ আর্তির চিত্র বড়ু চণ্ডীদাস বেশ নিপুণ হাতে এঁকেছেন।নিম্নলিখিত পদগুলো সুর মূর্ছনায় ও সংগীতধর্মিতায় কবির মৌলিক কল্পনাশক্তির পরিচয় দেয়। দৃষ্টান্ত:
‘মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশী।
একসরী ঝুরোঁ মো কদমতলে বসী।
মেদনী বিদার দেউ পথিআঁ লুকাওঁ৷’ (বিরহ, ১৯)
অর্থাৎ, মেঘ ঘন অন্ধকার রাতে একাকিনী রাধা অশ্রু বিসর্জন করছে; চারদিকে চেয়ে কৃষ্ণকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। এখানে রাধার আক্ষেপ বাণীর মধ্যে যেন কোনো অতৃপ্ত প্রাকৃত রমণীর ক্রন্দন গুমরিয়ে উঠেছে।
কিংবা, বর্ষা ঋতুতে রাধার বিরহ অসহনীয়। কবির বর্ণনাও অনুপম-
‘ফুটিল কদমফুল ভরে নোঁআইল ডাল।
এভোঁ গোকুলক নাইল বাল গোপাল॥
কত না রাখির কুচ নেতে ওহাড়িআঁ।
নিদয়হৃদয় কাহ্নি না গেলা বোলাইআঁ।’ (বিরহ, ৬৩)
অথবা, আষাঢ় মাসে নব মেঘ গরজএ।
মদন কদনে মোর নয়ন ঝুরএ॥ (বিরহ, ৬৪)
এ পদগুলো ব্যঞ্জনাময় এবং কবিত্বে উচ্ছ্বল। এ রসোত্তীর্ণ পদগুলোর মধ্যে আমরা পদাবলীর রাধার ‘মহাভাবময়ী’ রূপটি প্রত্যক্ষ করি। পদাবলীতে আমরা যে মধুর প্রেমগীতি, ব্যাকুল শান্তি, ধীরস্থির বিরহ অনল দগ্ধশ্রী রাধার ধ্যান গম্ভীর মূর্তি পাই উদ্ধৃত পদসমূহের মধ্যে সেই চিত্রই পরিপূর্ণ বিকশিত কমলের মতো আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। এখানে লালসা- ‘ কামনার কোনো গন্ধ নেই। দেহ ভোগাকাঙ্ক্ষাও এখানে প্রবল নয়, সমুদয় পার্থিব ধ্যানধারণার গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের মন এক সমুন্নত সৌন্দর্যানুভূতির কল্পনাতে গিয়ে মিলে যায়।
পদাবলীর রস মাধুর্যের সাথে বড়ু চণ্ডীদাসের বিরহের পদগুলো তুলনীয়। পদাবলীতে আমরা রাধার যে কৃষ্ণ প্রেমে পাগলিনী রূপ দেখি; সে মূর্তি প্রভাবিত হয়েছে বংশী এবং বিরহখণ্ডে। এই দুই খণ্ডে কাব্যরস এবং কাব্যভাষা পরিপূরক পেয়েছে। ভাবের গহীন লোকে রাধার আত্মোদক অতুল বৈভবের সাথী হয়ে পবিত্রতম আকাঙ্ক্ষালোকে স্থান দিয়েছে। সমালোচক ড. কৃষ্ণপদ গোস্বামী বলেছেন,
“শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সমাপ্তির ভিতর দিয়া বৈষ্ণব পদাবলীর জয়যাত্রা আরম্ভ হইয়াছে।”
(শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রুচি, সৌন্দর্যবোধ ও আধ্যাত্মিকতা)
সুতরাং বাহ্যদৃষ্টিতে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’কে ব্যঞ্জনাহীন স্থূল কাব্য মনে হলেও এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে এ কাব্যের অন্তর্গত কতকগুলো পদ মাধুর্য ভাবমণ্ডিত। অফুরন্ত সৌন্দর্য-সুধা এই পদগুলো হতে ঝরে পড়ছে। যে কোনো ভক্ত রসিকের পক্ষেই এ পদগুলো আস্বাদ্য। অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন তা হলো, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের …………….. ভাষা প্রাচীন বলিয়া কিছু দুর্বোধ্য বটে, কিন্তু অবোধ্য নহে। আনুনাসিকের সঙ্গীন খোঁচা এড়াইয়া, মহাপ্রাণ বর্ণের কণ্টক মাড়াইয়া, অপরিচিত শব্দের লতাগুল্ম ছাড়াইয়া যিনি এই কাব্যকুঞ্জে একবার প্রবেশ লাভ করিবেন তিনি কৃতার্থ হইবেন।”
উপরিউক্ত আলোচনায় বলা যায় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলা সাহিত্যের একটি মূল্যবান সম্পদ। স্কুল বর্ণনার অন্তরালে এ কাব্যের বংশী ও বিরহখণ্ডে যে কাব্য সৌন্দর্য রয়েছে তা সাধারণ পাঠকদের যুগ যুগ ধরে আনন্দ দান করছে।
Leave a comment