অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের শিল্পমূল্য বিচার কর

অথবা, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের সাহিত্য মূল্য বিচার কর

উত্তর: বাংলা সাহিত্যে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ মধ্যযুগের প্রথম কাব্য। এর রূপ বৈশিষ্ট্যটি সেকালের বাংলা কাব্যে অদ্বিতীয়। মধ্যযুগের আদি নিদর্শন সত্ত্বেও এ কাব্যে কবি বড়ু চণ্ডীদাসের অসামান্য কবি প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। কাব্যটি জন্ম, তাম্বুল, দান, নৌকা, ভার, ছত্র, বৃন্দাবন, কালিয়দমন, যমুনা, বাণ, বংশী ও বিরহ এ তেরো খণ্ডে বিন্যস্ত। কাব্যের মূলকথা ‘বংশী’ ও ‘বিরহ’ খণ্ডে বিদ্যমান। কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কবি-প্রতিভার মূল স্ফূরণও এসব খণ্ডেই নিহিত।

বস্তুত এ কাব্যে সকল উপাদানই “অল্প বিস্তর আছে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এটি গীতগোবিন্দের অনুরূপ গীতি ও সংলাপবহুল নাট্যলক্ষণাক্রান্ত রচনা। এটি প্রধানত আখ্যান কাব্য হলেও নাট্যরসের প্রচুর উপাদান এতে আছে। তবে নাট্য রসাশ্রয়ী নানা ঘটনা ও সংলাপ থাকলেও এটি মূলত বর্ণনামূলক কাব্য। কবি কোথাও নিজে কাহিনির মধ্যে উপস্থিত থেকে পাত্রপাত্রীর উক্তির সাথে বর্ণনা যোগ করেছেন। কোথাও বা সংস্কৃত শ্লোকের দ্বারা সংলাপের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করেছেন।

কোনো সমালোচক শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে মহাকাব্য আখ্যা দিতে • চান। অলঙ্কার শাস্ত্রে, শৃঙ্গার, বীর, করুণ, শান্ত- এদের যে কোনো একটি রস মহাকাব্যের আদিরস বা প্রধান রস হতে পারে। সেদিক দিয়ে আদিরসাত্মক শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মহাকাব্য হতে বাধা নেই। তবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্যে কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র পরিকল্পনা প্রশংসনীয় হলেও এটিকে মহাকাব্য বলা যায় না। বরং আদি রসাত্মক পুরাণ কেন্দ্রিক আখ্যান কাব্য হিসেবে গ্রহণ করাই অধিকতর সমীচীন।

নাটকীয় উপাদানের পাশাপাশি কাব্যটিতে স্থানে স্থানে গীতিকবিতার সুর অনুরণিত হয়েছে। প্রচলিত পদাবলীর মতো বংশী ও রাধাবিরহ খণ্ডের অনেক পদই গীতিকবিতার পর্যায়ে পড়ে। রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়লীলা নিয়ে গ্রন্থটি রচিত হলেও কবির ব্যক্তি মনের উদ্ভাস অনেক স্থলেই কাব্যটিকে লিরিকধর্মী করেছে।

তবে সমগ্র কাব্যটিকে নানা দিক দিয়ে বিচার করে গীতি সংলাপমূলক আখ্যান কাব্য বলে গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিসংগত।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রচনারীতি ও কাব্যকলা অসাধারণ। এর কাহিনির ঐক্য পাঠকদের দৃষ্টি সহজেই আকর্ষণ করে। কাহিনির একমুখী গতি, একটি সমস্যার চারপাশে আবর্তন। কোন শাখা কাহিনি নেই, শাখার অত্যধিক বিস্তারও নেই। কাহিনির কেন্দ্রীয় সমস্যাটি দ্বন্দ্বমূলক। এ দ্বন্দ্ব, ঘটনা এবং ব্যক্তি ইচ্ছা ও চেষ্টার টানাপোড়েনে বিকশিত এবং চারিত্রিক বিবর্তনের সাথে সম্পৃক্ত। এ দ্বন্দ্ব আখ্যানটিকে হৃদয়গ্রাহী করেছে এবং নাটকীয়তার সঞ্চারে এর আস্বাদ বাড়িয়েছে।

কবি বড়ু চণ্ডীদাস ছিলেন গ্রামীণ কবি। তিনি নিজে কৃতবিদ্য হলেও অধিকাংশ স্থলে গ্রাম্য রুচির দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন। এ কাব্য সম্বন্ধে অভিযোগ,

“কাব্যটি যৌন কামনায় এবং মিলনের বর্ণনায় অশ্লীল। রুচিহীন গ্রাম্যতা এর সর্বদেহে এর পদগুলো তথ্যভারে স্থূল। সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়াতীত অনুভূতির ব্যঞ্জনার অভাবে এ কবিতাগুলো লিরিক লক্ষ্যাচ্যুত।”

তাছাড়া কাব্যটিতে সংগীতময় সংলাপের প্রাচুর্য লক্ষণীয়। সংলাপের তুলনায় এর ঘটনা বিরল বললেই চলে। কাব্যটিতে অনেক পুনরুক্তি ঘটেছে। রূপ বর্ণনা আবশ্যক অনাবশ্যকে বার বার এসেছে। একই ভাবের কামনা বাসনা আর্তি সামান্য ভাষান্ত রিত হয়েই প্রকাশ পেয়েছে বহুবার।

কিন্তু এত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে’ চরিত্র চিত্রণে, অনুভূতির গভীরতায় এবং আখ্যান গ্রন্থনে একটি সার্থক নিপুণতা চোখে পড়ে। তাছাড়া রাধা ও কৃষ্ণের উক্তির মধ্যে মাঝে মাঝে এমন একটি তীব্র ব্যঙ্গবিদ্রূপের তির্যকতা প্রকাশ পেয়েছে যা গতানুগতিক মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে স্বাদ পরিবর্তন সূচিত করেছে। ‘রাধা বিরহ’ খণ্ডে বিরহক্লিষ্ট রাধার প্রতি কৃষ্ণের সেই তীব্র নির্মম উক্তি,

“পোটলী বান্ধিঞাঁ রাখ

নহুলী যৌবন।”

যতই হৃদয়হীন হোক, ভাষার তির্যকতা লক্ষণীয়। দানখণ্ড, ভারখণ্ড, বংশীখণ্ড প্রভৃতি অংশে এ জাতীয় তীব্র ব্যঙ্গ পরিহাসের এমন সব উক্তি আছে যার তুলনা একমাত্র ভারতচন্দ্রের কাব্যেই। পাওয়া যায়।

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যে কবির বর্ণনা কৌশল, অলঙ্কার সন্নিবেশ এবং শব্দ যোজনা অতীব প্রশংসীয়। রাধা ও কৃষ্ণের রূপ বর্ণনায় কবি অনেক স্থলে উপমার আশ্রয় নিয়েছেন,

কৃষ্ণের রূপ – চন্দন তিলকে শোভিত ললাট।

যেহ্ন চাঁদ ষোল কলা

রাধার রূপ- নীল জলদসম কুন্তল ভারা।

বেকত বিজুলি শোভে চম্পক মালা৷৷

শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবির বর্ণনারীতিতে ও কল্পনাভঙ্গিতে কতকগুলো বিশেষত্ব লক্ষিত হয়। এ কাব্যে বড়ু চণ্ডীদাসের পাণ্ডিত্য ও কবিত্বের অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে। এ কাব্যে গীতগোবিন্দ, ভাগবত ও অন্যান্য পুরাণের অসীম প্রভাব রয়েছে। সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের রীতি অনুযায়ী এখানে অলঙ্কারাদি গৃহীত হয়েছে। যেমন-

উৎপেক্ষা – নন্দের নন্দন কাহ্ন আঢ় বাঁশী বাএ।

অলঙ্কার – যেন রএ পঞ্জরের শূয়া৷৷ (বংশীখণ্ড)

বিরহ বিধুরা রাধা বড়ায়িকে বলছে,

বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জানী।

মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী। (বংশী খণ্ড)

শ্রীকৃষ্ণের শ্যামল রূপ-

‘দেহ নীল মেঘ ছটা গন্ধ চন্দনের ফোটা

যেন উড়ে গগনে চান্দ গোটা৷৷ (বিরহ, ১৫)

রাধার বিরহ বিলাপ-

‘আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন

ঝরএ নয়নের পাণী।’ (বংশী খণ্ড)

কিংবা রাধার প্রতি উদাসীন কৃষ্ণকে বড়ায়ির ভর্ৎসনা-

‘ভাঁগিল সোনার ঘট যুড়ীবাক পারী।

উত্তম জনের নেহা তেহেন মুরারী।।

যে পুনি আধমজন অন্তরে কপট।

তাহার সে নেহা যেহ্ন মাটির ঘটা।।’ (রাধা বিরহ, ৬৮)

বাক্য, বাক্যাংশ ও শব্দ যোজনার মধ্যে যে অলঙ্কার ও মণ্ডন কলা প্রত্যক্ষ করা যায়, বড়ু চণ্ডীদাস কোনো পূর্ববর্তী দেশীয় আদর্শ হতে তা পাননি, সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র ও কাব্যাদি হতে মণ্ডন শিল্পের দৃষ্টান্ত সংগ্রহ করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি মধ্য যুগীয় বাংলা সাহিত্যের পথিকৃৎ।

বড়ু চণ্ডীদাস যেমন কাহিনি নির্বাচনে নানা পুরাণ হতে অংশবিশেষ-গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি বহু স্থলে কাব্যশরীরের মণ্ডনের জন্য জয়দেবের গীতগোবিন্দ হতেও কিয়দংশ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন ‘রাধা বিরহ’ খণ্ডের একটি পদ-

নিন্দ এ চন্দে চন্দন রাধা সবখনে।

গরল সমান মানে মলয় পবনে৷৷’

তুলনীয়- ‘নিন্দতি চন্দন সিন্দু কিরণ মনু বিন্দুতি খেদমধীরম,

…………………..কলয়তি মলয় সমীরণ॥’ (গীতগোবিন্দ)

তাঁর রুচিতে কিছু কিছু গ্রাম্যতা দোষ থাকলেও কাব্য শরীর নির্মাণে তিনি সংস্কৃত সাহিত্য হতে অলঙ্কারের আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন, সেজন্য তাঁর ব্যবহৃত উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি মার্জিত ও রসোচ্ছল।

বাহ্যত স্থূলতা ও অশ্লীলতা থাকা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কতকগুলো পদে কবির গভীর সৌন্দর্যবোধ ও শালীনতার পরিচয় পাওয়া যায়। বংশী ও বিরহ খণ্ডের পদগুলো সুর মূর্ছনাময় ও সংগীতধর্মী-

‘মেঘ আন্ধারী অতি ভয়ঙ্কর নিশী।

একসরী ঝুরোঁ মো কদমতলে বসী ॥

চতুর্দিকে চাহোঁ কৃষ্ণ দেখিতে না পাঁও।

মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাও ॥’ (১৯, রাধা বিরহ)

অথবা, আষাঢ় মাসে নয় মেঘ গরজএ।

মদন কদনে মোর নয়ন ঝুরএ ॥ (৬৪, বিরহ)

অথবা, দিনের সুরুজ পোড়াআঁ মারে

রাতিহো এ দুখ চান্দে।

কেমনে সহিব পরাণে বড়ায়ি

চখুত নাইসে নিন্দে ॥ (১৮, বিরহ)

অথবা, কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নইকূলে,

কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি গোঠ গোকুলে ॥ (২, বংশী)

এ পদগুলো ব্যঞ্জনাময় এবং কবিত্বে উচ্ছল। বংশীখণ্ড ও রাধা বিরহের শ্রেষ্ঠ পদ সমষ্টিকে বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যের ‘প্রাক রূপ’ বলে গণ্য করেছেন অনেক সমালোচক। অধ্যাপক ড. সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন,

“শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষণ একটু বিশেষ রকমের কিন্তু এটার ভাষা প্রাচীন বলিয়া কিছু দুর্বোধ্য বটে, কিন্তু অবোধ্য নহে। আনুনাসিকের সঙ্গীন খোঁচা এড়াইয়া, মহাপ্রাণ বর্ণের কণ্টক মাড়াইয়া, অপরিচিত শব্দের লতাগুল্ম ছাড়াইয়া যিনি এ কাব্য কুঞ্জে একবার প্রবেশ লাভ করিবেন তিনি কৃতার্থ হইবেন।”

বড়ু চণ্ডীদাস যে উঁচুমানের কবি ছিলেন তাতে সন্দেহ করার অবকাশ নেই। সম্ভবত তিনি লৌকিক কাহিনি অনুসরণে কাব্যটি রচনা করেছেন। ফলে রাধা এবং কৃষ্ণের প্রেমের যে মহিমা বৈষ্ণবমতে অতীন্দ্রিয় প্রেমের রূপক হিসেবে প্রকাশিত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে তা নেই। এতে রাধা কৃষ্ণের অনঙ্গরঙ্গ, স্থল গ্রাম্য রুচি, গ্রাম্য গালিগালাজ প্রভৃতির দ্বারা কবি যেন মর্ত্য প্রীতির পরিচয় তুলে ধরেছেন। সমালোচকের ভাষায়,

“দেহকে কেন্দ্র করে দেহরসের এমন বাধা সঙ্কোচহীন বিষামৃত পরিবেশন বাংলা কাব্যে এক প্রকার দুর্লভ বলিলেই হয়। ……………বড়ুর মধ্যে যে তীব্র প্রাণরসের পরিচয় আছে, রুচি অরুচির প্রশ্ন এড়াইয়া জীবন পিপাসার আকণ্ঠ আকুলতা অতৃপ্ত ভোগের মধ্যে কল্পিত হইয়াছে তাহা সমগ্র মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেই এক অনন্য সাধারণ সৃষ্টি।” (অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়: শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চরিত্র চিত্রণ ও কাব্যস্বরূপ)

অনেক সমালোচক আবার রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলাকে ভক্ত ও ভগবানের লীলারূপক বলে গ্রহণ করেছেন। তাঁরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একটা আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও প্রদান করেছেন। তবে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা অপেক্ষা এর মর্ত্যরসই আমাদের কাছে অভিনব এবং শোভনীয়। সমালোচক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর ভাষায়-

“কামিনী নদীর কূলে, গোকুলের মাঠে, অবিরত যে বংশীধ্বনি হইতেছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তাহা গোলক অভিমুখে আকর্ষণ করিতেছে। বড়ু চণ্ডীদাস বাঙালি জাতিকে তাহার দূরাগত প্রতিধ্বনি শুনাইয়া গিয়াছেন।”

বাস্তবিক কবি বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটি মূল্যবান সম্পদ। স্কুল বর্ণনার অন্তরালে সূক্ষ্ম অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনা ও এর প্রত্যক্ষ মানব রস যুগ যুগ ধরে সাধারণ পাঠক ও কাব্য রসিকগণকে আনন্দ দান করে আসছে। এটাই কাব্য হিসেবে এর সার্থকতা।