বংশীখণ্ড
০১. বড়ায়ি লইআঁ রাহী গেলী সেই থানে।
সখিসবে বুইল রাধা লড়িউ সিনানে৷৷
ষোল শত গোপী গেলা যমুনার ঘাটে।
তা দেখিআঁ কাহ্নাঞি পাতিল নাটো। (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়ায়িকে সঙ্গে নিয়ে রাধা সেই স্থানে গমন করলে সখিরা বললো এসো রাধা স্নানে যাই। ষোলো শত গোপী নিয়ে যমুনার ঘাটে যাত্রা করল। তা দেখে কৃষ্ণ নাট্যলীলা আরম্ভ করে দিলেন।
০২. হরিষে পুরিআঁ কাহ্নাঞি তাহাত ওঁকার।
বাঁশীর শবদেঁ পারে জগ মোহিবার।
যমুনার ঘাটে রাধা বাঁশীনাদ সুণী।
জল লআঁ ঘর আয়িলী আইহনের রাণী। (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে কৃষ্ণ তাতে ওঙ্কার ধ্বনি দিলেন। বাঁশির শব্দ শুনে জগৎ মোহিত করতে পারে। আইইন পত্নী রাধা যমুনার ঘাটে বাঁশির শব্দ শুনে জল নিয়ে ঘরে ফিরল।
০৩. আকুল করিতে কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন।
পাখি নহোঁ তার ঠাই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ। (পদ-২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমার মন আকুল করার জন্যই কি নন্দের পুত্র কৃষ্ণ সুমধুর সুরে বাঁশি বাজায়। (আমি) পাখি তো নই যে তার কাছে উড়ে যাব। হে ধরিত্রী (পৃথিবী) বিদীর্ণ হও সেখানে প্রবেশ করে আত্মগোপন করি।
০৪. সুসর বাঁশীর নাদ সুণী আইলো
মো যমুনাতীরে।
শোভন কলসী করে ধরিআঁ
পারিলো যমুনানীরে।
বড়ায়ি ল।
বাঁশীর নাদ না শুণী এবে
কাহ গেলা কিবা দূরে।
প্রাণ বেআকুল ভৈল এবে
কিমনে জায়িবোঁ ঘরে। (পদ-৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি মধুর বাঁশির সুর শুনে যমুনা তীরে এলাম। শোভন কলসী হাতে নিয়ে যমুনার জল পার হলাম। ওগো বড়াই, বাঁশির সুরতো আর শুনতে পাইনে, কৃষ্ণ কি দূরে চলে গেল? আমার প্রাণ যে বড়ো ব্যাকুল হয়ে উঠল, কেমন করে ঘরে ফিরে যাব।
০৫. আহোনিশি মো আন না জাণো
এত দুখ কহিবো কাএ।
কাহ্নের ভাবে চিত্ত বেআকুল
লাজে মোঁ না কান্দো রাএ॥ (পদ-৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কতদিন আমি আর অন্য কিছুই জানি না, আমার এ দুঃখের কথা কাকে বলব? কৃষ্ণের ভাবনায় আমার চিত্ত ব্যাকুল, লজ্জায় আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারি না।
০৬. এবে বড় নয়নে মো না দেখোঁ সুন্দরী।
কথাঁ গেলে পাইব আহ্মে শ্রীকৃষ্ণ হরী॥
হেনক উপায় মোক বোল চন্দ্রাবলী।
তবে মো তোহ্মাক আণি দিবোঁ বনমালী॥ (পদ-৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ : সুন্দরী (রাধা), আমি এখন চোখ মেলে দেখতে পাই না। কোথায় গেলে আমি শ্রীকৃষ্ণকে পাব। চন্দ্রাবলী, আমাকে কোন উপায় বলে দাও। তবে, আমি তোমার বনমালীকে এনে দেব।
০৭. আইস ল বড়ায়ি মোর রাখহ পরাণ।
সহিতে না পারোঁ মদন পাঁচ বাণ॥
সরস বসন্ত ঋতু কোকিল রাএ।
আধিক বিরহশিখি হৃদএ জলএ॥ (পদ-৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়ায়ি, এসো আমার প্রাণ রক্ষা কর। মদনের পঞ্চবাণ সহ্য করতে পারছি না। কাল সরস বসন্ত, কোকিল ডাকছে। হৃদয়ে বিরহ-জ্বালা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
০৮. কে বোলে চন্দন চাঁদ আতি সুশীতল।
আহ্মার মনত ভাএ যেহেন গরল॥
নব কিশলয় ভৈল দহন সমান।
ঘাঅত উপরে ঘাঅ বাঁশীর সান॥ (পদ-৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দন ও চাঁদকে কে অতি সুশীতল বলে, আমার কাছে সবকিছু বিষ মনে হয়। নব কিশলয় আমার কাছে আগুনের সমান। সেখানে বাঁশির সুর যেন আঘাতের উপর আঘাত।
৯. আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন
ঝরএ নয়নের পাণী।
আল বড়ায়ি
সংপুটে প্রণাম করি কুইলোঁ সব সখিজনে
কেহো নান্দোকাহ্নঞিকে আণী॥ (পদ-৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মেঘ থেকে যেমন বৃষ্টি ঝরে তেমনি আমার নয়ন থেকে জল ঝরে। ওগো বড়ায়ি, কর জোড় প্রণাম করে সব সখীকে বললাম কিন্তু কেউ আমার কৃষ্ণকে এনে দিল না।
১০. কাহ্নঞি বিহাণে মোর সকল সংসার ভৈল
দশ দিগ লাগে মোর শূন।
আঞ্চলের সোনা মোর কে না হরি লআঁ গেল
কিবা তার কৈলোঁ অগুণ।॥(পদ-৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ ছাড়া আমার সকল (পদ-৬) সংসার এবং দশ দিক শূন্য মনে হয়। আমার আঁচলের সোনা কে চুরি করে নিল, আমি তার কি ক্ষতি করেছি।
১১. উত্তম গোআলকুলে তোহ্মার জরম।
তোহ্মাকে জুগত নহে এ সব করম॥
দুচারিণী যার মা তার হেন গতী।
সেসি পর পুরুষের বাঞ্ছএ সুরতী॥(পদ-৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: উত্তম গোপীকুলে তোমার জন্ম। এসব কাজ তোমার সাজে না। যার মা দ্বিচারিণী তারই এমন অবস্থা হয়। সেই পর পুরুষের সঙ্গে রতি বাসনা কামনা করে।
১২. দূতা তোক লয়িআঁ কাহ্নের মুখ দেখিবো।
মো জে কস্তুরী কফুর খাইবোঁ।
কিশলয় শয়ন বিছাইবো।
কাহ্ন আলিঙ্গিআঁ সকল দেহ জুড়ায়িবোঁ॥ (পদ-৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: দূতি, তোকে সঙ্গে নিয়ে আমি কৃষ্ণের মুখ দর্শন করব। আমি কস্তুরী কর্পর খাব। কচি পাতার শয্যা বানাবো। কৃষ্ণকে আলিঙ্গন করে শরীর জুড়াব।
১৩ . আল রাধা।
বৃন্দাবনে কাহ্নাঞি আণিবোঁ।
তোর সঙ্গে সুরতী করায়িবোঁ।
যত দুখ দেখিলোঁ তোহ্মারে।
একে একে কহিবোঁ কাহ্নেরে॥
আবসি সোঁঅরি তোর নেহে।
কাহ্নাঞি আসিব কুঞ্জগেহে॥ (পদ-৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো রাধা, কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে এনে তোর সঙ্গে রতি-ক্রিয়া করাব। তোমার যত দুঃখ দেখলাম সব কৃষ্ণকে বলব। অবশ্যই তোর প্রেম স্মরণ করে কৃষ্ণ কৃষ্ণ গৃহে আসবে।
১৪. রাধা তোওঁ মুগধী আবালী গোআলী
না জাণ কহ্নের শুধী।
তোহোর অন্তরে চতুর কাহ্নাঞি
পাতএ আশেষ বুধী॥ (পদ-১০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: রাধা, তুই মোহমুগ্ধ বুদ্ধিহীন গোয়ালিনী। কৃষ্ণের ব্যাপারে কিছুই জানিস না। তোর কারণেই চতুর কৃষ্ণ নানা প্রকার ছলনা বিস্তার করে।
১৫. ঘরেত বাহির হইআঁ নাগর কাহ্নাঞি
কোণ দিগে সার ণীসারে।
বাঁশির শব্দে চিত্ত বেআকুল বড়ায়ি
জাইবোঁ তার আনুসারে॥(পদ-১১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ঘর থেকে বের হয়ে নাগর কৃষ্ণ কোনদিকে বাঁশি বাজাচ্ছে। ওগো বড়াই, বাঁশির সুরে আমার চিত্ত ব্যাকুল হলো। আমি তার সন্ধানে বের হব।
১৬. বৃন্দাবন পসিআঁ সুন্দুর কাহ্নাঞি
বাঁশী বাএ সুললিত ছান্দে।
হার কঙ্কন পসিআঁ সব তেআগিবোঁ
সুণী তাক বুক কে বা বান্ধে॥ (পদ-১১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বৃন্দাবনে প্রবেশ করে সুন্দর কৃষ্ণ সুললিত সুরে বাঁশি বাজায়। ওগো বড়াই, আমি হার কঙ্কন সব ত্যাগ করব। বাঁশির শব্দ শুনে আমি বুক বেঁধে রাখতে পারছি না।
১৭. আগর চন্দনে বড়ায়ি শরীর লেপিআঁ।
কেলি কৈল যেই বৃন্দাবনত পসিআঁ॥
নাগর কাহ্নাঞি সমে বিবিধ বিধানে।
এবে লআঁ চল বড়ায়ি সেই বন্দাবনে॥ (পদ-১৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই, অগুরু চন্দনে শরীর লেপন করে কানাই যে বৃন্দাবনে প্রবেশ করে নগরের সাথে বিবিধ খেলা করছে, সেই বৃন্দাবনে আমাকে নিয়ে চলো।
১৮. বড়ার বৌহারী আহ্মে বড়ার ঝী।
কাহ্ন বিনি মোর রূপ যৌবনে কী৷৷
এরূপ যৌবন লআঁ কথাঁ মো এঁ জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ৷৷ (পদ-১৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি মানী লোকের বৌ এবং মানী লোকের কন্যা তাই কৃষ্ণকে ছাড়া আমার রূপ যৌবন দিয়ে কী হবে। এরূপ যৌবন নিয়ে আমি কোথায় যাই। মেদিনী (পৃথিবী) বিদীর্ণ হও, প্রবেশ করে নিজেকে লুকাই।
১৯. তোহ্মাত লাগিআঁ এত কৈল দামোদরে৷৷
তভোঁ তাক দোষ দেসি তোওঁ বারে বারে৷৷
এখন বোলহ রাধা আহ্মার মরন।
এবেঁ কথাঁ পাইব আহ্মে নান্দের নন্দন ৷৷ (পদ-১৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার জন্যই দামোদর (কৃষ্ণ) এতো করল, তবুও বারে বারে তাকেই দোষ দিচ্ছ। রাধা তুমি এখন বলছ আমার মরণ হোক। আমি এখন নন্দের নন্দকে কোথায় পাব।
২০. রান্ধনের জুতি হারায়িলোঁ বড়ায়ি
সুণিআঁ বাঁশীর নাদে॥
নান্দের নান্দন কাহ্ন আড়বাঁশী বাএ
যেন রএ পাঞ্চরের শুআ।
তা সুণিআঁ ঘৃতে মো পরলা বুলিআঁ
ভাজিলোঁ এ কাঁচা গুআ ৷৷ (পদ-১৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়ায়ি, বাঁশির শব্দ শুনে রান্নার জো হারালাম। নন্দের নন্দন কৃষ্ণ আড়বাঁশি বাজায়। মনে হয় যেন পিঞ্জরের শুকপাখি রব করে। আমি তা শুনে বিভ্রান্ত হয়ে পটল বলে এই কাঁচা সুপারি ঘিয়ে ভাজলাম।
২১. আপণার সুখে কাহ্নঞি ভ্রমে বৃন্দাবনে।
লাজ না বাস বুলিতে হেন বচনে।
তাহাক আণিতে তোক্ষে নাম্বায়িলে আম্বলে।
ছোলঙ্গ চিপিআঁ রস দিলে নিমঝোলে ৷৷ (পদ-১৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ মনের সুখে বৃন্দাবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব কথা বলতে তোমার লজ্জা হয় না। তাকে (কৃষ্ণকে) আনবার জন্যই তুমি অম্বল নামালে এবং টক লেবু চিপে রস দিলে নিমঝোলে।
২২. কাখেত কলসী বড়ায়ি জাওঁ ধীরে ধীরে।
চতুৰ্দ্দিশ চাহো বড়ায়ি যমুনার তীরে ৷৷
বাঁশী নাদ সুণী কাহ্ন দেখিতে না পাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিঞাঁ লুকাওঁ ৷৷ (পদ-১৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়াই কাঁকে কলসী নিয়ে ধীরে ধীরে চলছি। যমুনার তীরে চারদিকে দেখছি। বাঁশির সুর শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কৃষ্ণকে দেখতে পাচ্ছি না। মেদিনী (ধরণী) দ্বিধাবিভক্ত হোক, তার মধ্যে প্রবেশ করে লুকাই।
২৩. যমুনার তীরে বড়াই কদমের তলে।
পূর্ণ ঘট পাতী বড়ায়ি চাহি ত মঙ্গলে ৷৷
মঙ্গল পায়িলে হয়ে চিত্তের সোআপ্লে।
তবেসি মেলিব এখাঁ প্রিয় জগন্নাথে ৷৷ (পদ-১৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই, যমুনাতীরের কদমতলে পূর্ণঘট পেতে মঙ্গল কামনা করি। মঙ্গল পেলে চিত্ত স্বস্তি পাবে। তবেই প্রিয় জগন্নাথের (কৃষ্ণের) সঙ্গে মিলন হবে।
২৪. কোপছলে পরিখে তোহ্মার মতি কাহ্নে।
এখন পায়িবাক তাক না কর যতনে।।
বিরহে বিকল হআঁ তোহ্মার থানে।
আপণে মেলিব আসি নাগর কাহ্নে ৷৷ (পদ-১৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কৃষ্ণ রাগের ছলে তোমার মন পরীক্ষা করছে, এখন তাকে পাবার জন্য চেষ্টা করোনা। বিরহে ব্যাকুল হয়ে নাগর কানাই (কৃষ্ণ) নিজে এসে তোমার (রাধার) সঙ্গে মিলিত হবে।
২৫. শ্রীনন্দনন্দন গোবিন্দ হে।
অনাথী নারীক সঙ্গে নে ৷৷
দুঅজ পহরে নিন্দে আকুল আইহন।
নাছে গিআঁ চাহে রাহী নান্দের নন্দনা ৷৷
চারি পাশ চাহে রাহী চমকিত মনে।
কথাঁহো না পায়িল কাহ্নের দরশনে ৷৷ (পদ-১৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হে নন্দনন্দন গোবিন্দ অনাথী নারীকে সঙ্গে নাও। দ্বিতীয় প্রহরে আইহন নিদ্রায় অভিভূত হলে রাধা পথে বেরিয়ে নন্দের নন্দনকে (কৃষ্ণকে) খুঁজতে লাগল। চমকিত মনে রাধা চারদিকে খুঁজতে লাগল কিন্তু কোথাও কৃষ্ণকে দেখতে পেল না।
২৬. তোহ্মার বচনে যমুনাক আহ্মে জাইব।
তথাঁ গেলে কেমনে কাহ্নঞির লাগ পাইবা ৷৷
তথাঁ বাঁশী চোরায়িতে করিউ যতনে।
যমুনার তীরে সব খন থাকে কাহ্নে ৷৷ (পদ-২০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার কথায় আমি যমুনাতে যাব কিন্তু সেখানে গেলে দেখা পাব কিভাবে। সেখানে গিয়ে কৃষ্ণের বাঁশিটি চুরি করতে চেষ্টা করো। কৃষ্ণ সারাক্ষণ যমুনার তীরেই থাকে।
২৭. যমুনার তীরে কদম তরুতলে
বাঅ বহে সুশীতলে
তথাঁ বশিআঁ সে দেবরাজ
পুরিল বাঁশীত শরে ৷৷
নিদ্রাহো আসিআঁ চাপিল কাহ্নে
তেঁসি না গেলা ঘরে।
নব কিশলয় শয়নে সুতিল
বাঁশীত দিআঁ সিারে ৷৷ (পদ-২১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: যমুনাতীরে কদমগাছের তলায় সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। সেখানে বসে দেবরাজ বাঁশিতে সুর দিল। অতঃপর তাঁকে নিদ্রা পেয়ে বসলো। সেজন্য সে (রাধা) ঘরে গেল না। নব (কৃষ্ণ) কিশলয় শয়নে মাথার কাছে বাঁশিটি রেখে ঘুমিয়ে গেল।
২৮. বাঁশী হারায়িলো বড়ায়িল
আল গোকুলে আসিআ।
হাকান্দ করুণা করোঁ ভূমিত লোটায়িআঁ ৷৷
এবে কে বা নীল মোহন বাঁশে।
মুকুতার ঝারা পাটখোপ দুআ পাশে ৷৷
মাণিকে খঞ্চিল তথি সোনার পাতা।
সুরপতী জাণে মোর বাঁশীর বারতা ৷৷ (পদ-২২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো বড়াই, গোকুলে এসে বাঁশি হারালাম। এই দেখো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ব্যাকুল হয়ে বিলাপ করছি। এমন মোহন বাঁশিটি কে নিল। তার দু’পাশে মুক্তার ঝালর, পাটের গুচ্ছ। মানিকে খচিত সোনার পাতে তা মোড়ানো। সুরপতি আমার বাঁশির বৈশিষ্ট্য জানে।
২৯. সুণহ সুণহ কাহ্ন না কর আতোষে।
আহ্মে সব কহিআঁ দিব বাঁশীর উদ্দেশে।
আহ্মার বচনে তোক্ষে কর অবধান।
গোপীকুলের তোক্ষে কৈলে আপমান ৷৷
তেকারণে এবে আহ্মে করি অনুমান।
তে সঙ্গে চোরায়িল বাঁশী তোর কাহ্ন ৷৷(পদ-২৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: শোন কানাই (কৃষ্ণ), দুঃখ করো না। আমি তোমার বাঁশির সন্ধান বলে দেব। আমার কথা তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি গোপীদের অপমান করেছ। সে জন্য আমি অনুমান করছি তারা সকলে মিলে তোমার বাঁশি চুরি করেছে। হে মুরারী (কৃষ্ণ) বাঁশির সন্ধান তোমাকে বললাম। গোপীদের মধ্যে কেউ তোমার বাঁশি চুরি করেছে।
৩০. মোরে বাঁশীগুটি দিআঁ মেণ দানে।
আল হে রাধা
বারেক রাখহ সমানে ল॥
বাঁশী পাইল হর গৌরী বরে।
দেখিতে আতি মনোহরে।
যার নদে গোকুল রহে ৷৷ (পদ-২৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ওগো রাধিকা আমাকে বাঁশিটি দান করে অন্তত একবার আমার সম্মান রাখ। দেখতে অতি মনোহর এ বাঁশি হরগৌরীর বরে পেয়েছি। যার সুরে গোকুল স্থির থাকে।
৩১ . গলাত পাথর বান্ধি দহে পইসওঁ
কিবা মরোঁ আনলে পুড়িআঁ।
তবে বা মোওঁ কাহ্নের ঝগড় এড়াওঁ
কিবা মরোঁ খরল খায়িআঁ ৷৷ (পদ-২৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: গলায় পাথর বেঁধে দহে প্রবেশ করব। কিংবা আগুনে পুড়ে মরব। তবেই বুঝি আমি কৃষ্ণের কলহ এড়াতে পারব, না হয় আমি বিষ খেয়ে মরব।
৩২. হরি হরি।
কে না পরাণে দুখ দিল।
আল হের।
বিরহবিনোদ বাঁশী নিল হে ৷৷
মোর বাঁশী ত্রিভুবনে জাণী।
খিঞ্চিল মাণিকে হিরা মণী ৷৷
বাঁশী নিআঁ রাধা নাহি মানে।
সে নিল জাণো আনুমানে ৷৷ (পদ-২৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হায় হায় ভগবান, কে আমার প্রাণে এতো দুঃখ দিল। ওগো দেখ, বিরহ বিনোদ আমার বাঁশিটি চুরি করে নিল। ত্রিভুবনে আমার বাঁশির কথা কেনা জানে। হীরা- মণি-মানিকে তা খচিত। বাঁশি নিয়ে রাধা স্বীকার করছে না। অনুমানে জানি সেই (রাধা) বাঁশি নিয়েছে।
৩৩. বড়ার ঝিআরী বড়ার বৌহারী
আহ্মে আইহণের রাণী।
আহ্মে বাঁশী তোর চোরায়িল কাহ্নাঞি
মুখে আন হেন বাণী ৷৷(পদ-২৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমি আইহনের স্ত্রী, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে, সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ। আমি তোমার বাঁশি চুরি করেছি। এমন কথা কানাই, মুখে আন।
৩৪. নাটকী গোআলী ছিনারী পামরী
সত্যে ভাষ নাহি তোরে।
তোএঞ নিলী বাঁশী (পদ-২৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নাটুকে গোয়ালিনী ছিনালপাপীয়সী। তোর কি সত্য কথা বলতে মানা। তুই-ই (রাধা ) নিয়েছিস বাঁশি।
৩৫. কোণ আসুভ খনে পাঅ বাঢ়ায়িলো।
হাঁছী জিঠী আয়র উঝট না মানিলোঁ।
শুন কলসী লই সখী আগে জাএ ৷৷ (পদ-২৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কোন অশুভ ক্ষণে পা বাড়ালাম। হাঁচি, টিকটিকি, হোঁচট মানলাম না। শূন্য কলসী নিয়ে সখী আগে যাচ্ছিল। বাঁয়ের শিয়াল আমার ডান দিকে যাচ্ছিল।
৩৬. ঘৃত দধি দুধ বড়ায়ি দহতে পেলায়িবোঁ ৷৷
যোগিনীরূপে মো দেশান্তর লইবোঁ।
আনলকুণ্ডত কিবা তনু তেআগিবোঁ।
কাহৃত লাগিআঁ কিবা বিষ খাইআঁ মরিবোঁ ৷৷ (পদ-২৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বড়াই ঘি, দই, দুধ জলে ফেলে দেব। যোগিনী হয়ে দেশান্তরে যাব। অগ্নিকুণ্ডে দেহ ত্যাগ করবো। কিংবা কৃষ্ণের জন্য বিষ খেয়ে মরবো।
৩৭. আপণা চিহ্নিআঁ বাঁশী দেহ মোরে আণী।
যবে তোর পরাণ না লৈব চক্রপাণী ৷৷
সব আভরণ তোর কাঢ়িআঁ লইবোঁ ৷৷
বাঁশীত লাগিআঁ তোক রান্ধিআঁ রাখিবোঁ ৷৷
জীবার আশ যবে আছএ তোহ্মার।
ঝাঁট করী বাঁশীগুটী দিআর আহ্মার ৷৷ (পদ-২৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: নিজের মঙ্গল চেয়ে আমার বাঁশিটি এনে দাও। নইলে চক্রপাণি তোমার প্রাণ নেবে। তোমার সব অলঙ্কার কেড়ে নেবে। বাঁশির জন্য তোমাকে বেঁধে রাখব। যদি তোমার বাঁচার ইচ্ছা থাকে তবে তাড়াতাড়ি আমার বাঁশিটি শিয়া দিয়ে দাও।
৩৮ . হারায়িল তোহ্মার বাঁশী তেঁসি বাড়ায়িতে হাসি
মোর বোল সুণ চক্রপাণী।
বুলী চৌর পৈসে ঘরে গিহীক সত্বর করে
হেন দুঠ বড়ায়ির বাণী ৷৷ (পদ-৩০)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: তোমার বাঁশি হারিয়ে গেল সেজন্য বড়াই হাসছে। হে চক্রপাণি আমার কথা শোন। একদিকে চোরকে ডেকে ঘরে ঢোকায় অন্যদিকে গৃহীকে সতর্ক করে, এমনি ধূর্ত বড়ায়ির কথাবার্তা।
৩৯. কেহ্নে আমান করসি।
আক্ষে জাণী তোক্ষে নিলে বাঁশী ৷৷
তোরে বোলোঁ চন্দ্রাবলী আকুল মো বনমালী
তোহ্মে কৈল চুরী মোর বাঁশী।
কথাঁ নিআঁ বাঁশী এড়ি মিছাঞি দোষসি বুড়ী
হৃদয়ত ভয় না মানসী ৷৷ (পদ-৩১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: কেন অস্বীকার করছ। আমি জানি তুমিই বাঁশি নিয়েছ। চন্দ্রাবলী তোমাকে বলছি আমি বনমালী আকুল। তুমি আমার বাঁশি চুরি করেছ। কোথায় লুকিয়ে রেখেছ। এখন মিছেমিছি দোষ দিছে বুড়িকে। তোমার মনে ভয় হয় না।
৪০. চান্দ সুরুজ বাত বরুণ সাখী।
যে তোর বাঁশী নিল সে খাউ দুয়ি আখী।
যবে মোর চুরী কৈলো হআঁ নারী সতী।
তবে কালসাপ খাইএ আজিকার রাতী। (পদ-৩২)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দ্র, সূর্য, বাতাস, বরুণ * সকলই সাক্ষী, যে তোর বাঁশি নিয়েছে সে তার দু’চোখের মাথা যাক। আমি সতী নারী হয়ে যদি চুরি করে থাকি তবে আজ রাতেই যেন আমাকে কাল সাপে খায়।
৪১. চান্দ সুরুজ মোর আছে দুয়ি সাখী।
আহ্মা মিছা দোষ কাহ্ন খাইবি দুঈ আখী ৷৷
সপ্ত লাখের মোর বাঁশী করী চুরী।
আহো গালী দেহ মোরে রাধিকা নাগরী। (পদ-৩৩)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চন্দ্র, সূর্য উভয় সাক্ষী আছে আমার তাই কানাই (কৃষ্ণ) আমাকে মিছেমিছি দোষ দিলে দু’চোখের মাথা যাবে। নাগরী রাধা, আমার সাত লাখ টাকার বাঁশি চুরি করে আমাকে আবার গালি দিচ্ছে।
৪২. অপ্রাণ ধরণ না জাএ সুন্দরি রাধে।
কে না নিল মোহন বাঁশী ৷৷
ঋগ যজু সাম আথর্ব্ব
চারী বেদ পাওঁ মোর বাঁশীর সরে।
সুণী সব দেবগণে কি বুলিহে আক্ষারে
কে না নীল বাঁশী সিঅরে ৷৷ (পদ-৩৪)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হায় সুন্দরী রাধা, প্রাণ যে আর ধরে রাখতে পারি না। কে নিল আমার মোহন বাঁশি। বাঁশি দিয়ে আমি ঋক-সাম-যজু-অথর্ব এই চারি বেদের গান করি। শিয়র থেকে কে আমার বাঁশি নিয়ে গেল। এ কথা শুনে দেবতারাইবা আমাকে কি বলবে।
৪৩. শিঅরে হারায়িত তোক্ষে বাঁশী।
মিছা কেহ্নে আহ্মারে দোষসি।
হয়িল মোর এতেক বএসে।
কেহো নাহি দিল চুরীদোষে ৷৷
সব লোক মোরে ভালে জাণে।
চুরিণী হয়িলাহোঁ তোর থানে ৷৷ (পদ-৩৫)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: হে কানাই, তুমি শিয়র থেকে বাঁশি হারিয়ে কেন আমাকে দোষ দিচ্ছ। আমার এত বয়স হলো, কেউ আমাকে চুরির অপবাদ দেয়নি। সব লোকেই আমাকে ভালো জানে। কেবল তোমার কাছেই আমি চোর হলাম।
৪৪. পান্তরে হারাআঁ বাঁশী মোর থানে খোজসি
এহা না সহে মোর পরাণে।
হেন যবে বোলে আন কাটো তার নাক কান
তোহ্মা তেজোঁ ভাগিনা কারণে ৷৷ (পদ-৩৬)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: মাঠে বাঁশি হারিয়ে আমার কাছে খোঁজ করছ, এ আমার প্রাণে সহ্য হয় না। এমন কথা যদি অন্যে বলত তবে তার নাক, কান কেটে নিতাম । কেবল ভাগনে বলেই ছেড়ে দিলাম।
৪৫. এত বড় মোর আপমাণে।
সুণি কি বুলিব দেবগণে।
সুণ তোক্ষে নান্দের কুমার।
নিজ কাজে বিকল সংসার ৷৷
যোরহাতে বুলিহ বচনে।
সুখী হইব রাধার মণে। (পদ-৩৭)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমার এত বড় অপমান। দেবতারা শুনলে কি বলবে। হে কানাই তুমি নন্দের নন্দন। শোন সংসারের সকলেই নিজের কাজে ব্যস্ত। তুমি হাত জোড় করে কথা বলো, রাধা মনে মনে খুশী হবে।
৪৬. মেঘ যেহ্ন আষাঢ় শ্রাবণে।
ঝরে তার পাণী নয়নে, গো ৷৷
কান্দিআঁ মলিন কৈল মুখে।
কত তার দেখিবোঁ দুখে গো ৷৷ (পদ-৩৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের মেঘের মতো তার চোখের জল ঝরছে। কাঁদতে কাঁদতে মুখ মলিন হলো। ওগো তার দুঃখ আর কত দেখব।
৪৭ . বাঁশরী শোকে চক্রপাণী।
এবে তাক দেহ আণী ৷৷
যোড়হাথ কৈল দেব কাহ্নে।
এবে তাক বাঁশী দেহ দাণে ৷৷
নাহি পিন্ধে উত্তম বসনে।
শরীরে দুবল ভৈল কাহ্নো ৷৷ (পদ-৩৮)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বাঁশির শোকে কাতর। এবার তাকে বাঁশিটি এনে দাও। দেবতা কৃষ্ণ জোড় হাত করছে, এবার তার বাঁশি দিয়ে দাও। সে (কৃষ্ণ) ভালো কাপড় পরে না, শরীর তার দুর্বল হয়েছে।
৪৮. কভোঁ কি না দিবে আহ্মাক দুখে।
এহা বোল আপণ মুখে ৷৷
তবে কহিবোঁ মো বাঁশী উদ্দেশে। (পদ-৩৯)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: আমাকে আর কখনো দুঃখ দেবে কি না নিজের মুখে তা বল। তাহলেই আমি তোমার বাঁশির সন্ধান বলে দেব।
৪৯. বিরহে আকুলী যবে চাহোঁ মো তোহ্মারে।
তখন আসিহ তোক্ষে আতি অবিচারে ৷৷
হের ভালমতে চাহি নেহ কাহ্নাঞি বাঁশী।
আজি হৈতে চন্দ্রাবলী হৈল তোর দাষী ৷৷ (পদ-৪১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: বিরহে আকুল হয়ে যখন তোমাকে আহ্বান করব তখন তুমি অবিলম্বে আসবে। কানাই ভালোভাবে বাঁশি দেখে নাও। আজ থেকে চন্দ্রাবলী তোমার দাসী হইল।
রাধাবিরহ
১. আইল, চৈত মাস।
কি মোর বসতী আশ ৷৷
নিফল যৌবনভারে।
বিরহে আন্তর জলে।
সুতিলোঁ কদমতলে।
আধিক আন্তর মোর পোড়ে (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: চৈত্র মাস এল, নিষ্ফল যৌবন ভার নিয়ে আমার বেঁচে থাকার আশা কোথায়। বিরহে অন্তর জ্বলছে। কদমতলায় শয়ন করলাম। তাতে আমার অন্তর আরো বেশি জ্বলে।
২. ডালী ভরী ফুল পানে।
মোরে পাঠায়িল কাহ্নে।
তাক মো না ছুয়িলোঁ হাথে ৷৷
তাম্বুল না লেলোঁ করে।
তোক মাইলোঁ চড়ে।
তেঁসি কাহ্ন আসুখিল মোরে ৷৷ (পদ-১)
আধুনিক বাংলায় অনুবাদ: ডালা ভরে কৃষ্ণ আমার কাছে ফুল, তাম্বুল পাঠাল। সেসব আমি হাতেও ছুলাম না। তাম্বুল হাতে নিলাম না। তাকে (বড়ায়িকে) চড় মারলাম। তাই কৃষ্ণ আমাকে, দুঃখ দিল।