প্রশ্নঃ পৌরনীতিতে নৈতিকতা কি? আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক বর্ণনা কর। 

ভূমিকাঃ পৌরনীতি ও নাগরিকতা, নগর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র, নাগরিকের জীবন সব কিছু নিয়ে আলোচনা করে। নাগরিকের মর্যাদা, অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ জাতীয়, আইন সাম্য, স্বাধীনতা, নীতি নৈতিকতা আদর্শ ইত্যাদি সকল দিক এর অন্তর্ভূক্ত। পরিধির বিস্তৃতি এ বিষয়টিকে অনন্য করেছে। আধুনিক নাগরিক তৈরির লক্ষ্যে পৌরনীতি ও নাগরিকতা বিষয়ে আরও নতুন নতুন অনেক বিষয় যোগ হচ্ছে।

নৈতিকতা (Morality): নৈতিকতার ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Morality’। ইংরেজি Morality শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ‘Moralitas’ থেকে, যার অর্থ সঠিক আচরণ বা চরিত্র’। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল সর্বপ্রথম নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। সক্রেটিস বলেছেন, “সৎ গুণই জ্ঞান’ (Virtue is knowledge)। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা অন্যায় করতে পারেন না এবং ন্যায় বোধের উৎস, হচ্ছে ‘জ্ঞান’ (knowledge) এবং অন্যায়বোধের উৎস হচ্ছে ‘অজ্ঞতা’ (ignorance)। পরবর্তীতে রোমান দার্শনিকরা প্রথাগত আচরণের অর্থে ‘mas’ কথাটি ব্যবহার করেন। ল্যাটিন এই ‘mas’ শব্দ থেকেই Morals ও Morality (নৈতিকতা) শব্দের উদ্ভব ঘটেছে।

জোনাথান হেইট (Jonathan Haidt) মনে করেন, ‘ধর্ম, ঐতিহ্য এবং মানব আচরণ—তিনটি থেকেই নৈতিকতার উদ্ভব হয়েছে।’

নীতিবিদ ম্যুর বলেছেন, ‘শুভর প্রতি অনুরাগ ও অশুভর প্রতি বিরাগই হচ্ছে নৈতিকতা।’

Cambridge International Dictionary of English-তে বলা হয়েছে যে, নৈতিকতা হলো ‘ভালো-মন্দ আচরণ, স্বচ্ছতা, সততা ইত্যাদির সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি গুণ, যা প্রত্যেক ব্যক্তিই আইন কিংবা অন্য কোনো বিষয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে থাকে।”

নৈতিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Collins English Dictionary-তে বলা হয়েছে যে, ‘Morality is concerned with on negating to, human behavior, esp. the distinction between good and bad and right and wrong behavior.’

নৈতিকতা হলো মানুষের অন্তর্নিহিত ধ্যান-ধারণার সমষ্টি যা মানুষকে সুকুমার বৃত্তি অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করে। নৈতিকতা বা ন্যায়বোধ মানসিক বিষয়। এটি হলো মানবমনের উচ্চ গুণাবলি। নৈতিকতা বা নীতিবোধ একান্তভাবেই মানুষের হৃদয়-মন থেকে উৎসারিত। নৈতিকতা বা নীতিবোধের বিকাশ ঘটে মানুষের ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত বোধ বা অনুভূতি থেকে।

শুধুমাত্র আইন বা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধানই নাগরিক জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথেষ্ট নয়। আর. এম. ম্যাকাইভার এ জন বলেছেন যে ‘Law, does not and can not cover all grounds of morality’।

নৈতিকতা বা ন্যায়নীতিবোধের ধারণা বা এর প্রতি যে দেশের জনগণের শ্রদ্ধাবোধ বেশি, যারা জীবনের চলার পথে নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত হন, তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে লিপ্ত হন না। আইন অপেক্ষা বিবেক দ্বারা তারা পরিচালিত হন। নীতিবান মানুষ ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির মানদণ্ডে নিজেরাই চলার চেষ্টা করে।

নৈতিকতার পিছনে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন বা কর্তৃত্ব থাকে না। কেননা নৈতিকতা বিবেক ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। রাষ্ট্র নৈতিকবিধি প্রয়োগ করে না। নৈতিকতা বিরোধী ব্যক্তিকে রাষ্ট্র কোনো প্রকার দৈহিক শাস্তি প্ৰদান করে না। বিবেকের দংশনই নৈতিকতার বড় রক্ষাকবচ।

নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার। নৈতিকতা মানুষের মানসিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ সাধনই নৈতিকতার লক্ষ্য। যে রাষ্ট্রের মানুষের নৈতিক মান সুউচ্চ, সেদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ। কেননা সেদেশের নাগরিকগণ নিজেরাই অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকেন, ঘুষ দুর্নীতিকে ঘৃণা করেন।

আইন ও নৈতিকতা (Law and Morality): অতীতে নীতিবিজ্ঞান ছিল পৌরনীতিরই অংশবিশেষ। নৈতিকতার কষ্টিপাথরে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও আচার-আচরণকে তখন বিচার করা হতো। প্লেটো এবং এরিস্টটল তাদের আদর্শ রাষ্ট্রের পরিকল্পনায় নৈতিক আদর্শের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ইতালির প্রখ্যাত রাষ্ট্র দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি সর্বপ্রথম আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেন।

পার্থক্যঃ আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্যগুলো নিম্নরূপঃ 

ক. পরিধি ও বিষয়বস্তুগত পার্থক্যঃ আইন মানুষের বাহ্যিক আচার-আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। মানুষের মন বা মানসিক অনুভূতির সাথে আইনের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। আইন মানুষের গোপন চিন্তা বা উদ্দেশ্যকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে না। অপরদিকে নৈতিকতা মানুষের বাহ্যিক ও মানসিক আচরণসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং নৈতিকতার পরিধি আইনের পরিধি অপেক্ষা অনেক বেশি ব্যাপক।

খ. নির্দিষ্টতা ও স্পষ্টতা সম্পর্কিত পার্থক্যঃ আইন নির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট, কিন্তু নৈতিকতা অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট। আইন সর্বজনীন। দেশের সর্বত্র একই রকম আইন কার্যকর হয়। নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আইন কার্যকর ও ব্যাখ্যা করে থাকেন। অপরদিকে নৈতিকতা আইনের মতো সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়। দেশ-কাল-পাত্রভেদে নৈতিকতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক সময়ে ভারতবর্ষে বিধবা বিবাহ অনৈতিক মনে করা হতো কিন্তু এখন তা মনে করা হয় না। অস্পৃশ্যতাকে ও বর্ণ প্রথাকে এক সময় অনৈতিক মনে করা হতো না। কিন্তু বর্তমানে অস্পৃশ্যতা, বর্ণপ্রথাকে অনৈতিক বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া নৈতিকতা মূলত ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ব্যাপার, অপরদিকে আইন রাষ্ট্রীয় ব্যাপার।

গ. উচিত-অনুচিতের মানদণ্ডগত পার্থক্যঃ নৈতিকতা কোনো কাজকে ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদির মানদণ্ডে বিচার করে। আইন সেভাবে বা সে মানদণ্ডে বিচার করে না। আইনের মানদণ্ড ভিন্ন। আলো ছাড়া গাড়ি চালানো কিংবা রাস্তার বামদিক দিয়ে না চলে ডানদিক দিয়ে চলা নৈতিকতা বিরোধী নয়, কিন্তু বেআইনি । অন্যদিকে মিথ্যা কথা বলা, অকারণে কারো মনে কষ্ট দেয়া, গালমন্দ করা বেআইনি নয়, কিন্তু নৈতিকতা বিরোধী। সুতরাং আইনবোধ সব ক্ষেত্রে এবং সব সময় এক হতে পারে না।

ঘ. বলবৎকরণের ক্ষেত্রে পার্থক্যঃ আইনের পিছনে রয়েছে সার্বভৌম রাষ্ট্র কর্তৃত্বের সমর্থন; কিন্তু নৈতিকতা সামাজিক বিবেক ও মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আইন প্রয়োগ করে থাকে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগকারী শক্তি। আইন ভঙ্গকারীকে আইনের আলোকে শাস্তি পেতে হয়। অপরদিকে, নৈতিকতার পিছনে রাষ্ট্রের মতো কোনো বলপ্রয়োগকারী শক্তি নেই। রাষ্ট্র নৈতিক বিধি প্রয়োগ করে না । নৈতিকতা বিরোধী কাজে লিপ্ত থাকলে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট দৈহিক শাস্তিও ভোগ করতে হয় না। নৈতিকতা বিরোধী ব্যক্তিকে বড় জোর বিবেকের দংশন সহ্য করতে হয় এবং জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।

সাদৃশ্যঃ আইন ও নৈতিকতার মধ্যে মিল বা সাদৃশ্য নিম্নরূপঃ 

১. লক্ষ্যের অভিন্নতাঃ আইন ও নৈতিকতার লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। উভয়ের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মানুষের আচরণ। আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং নৈতিকতা মানুষের মনোজগতকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণ সাধন করাই উভয়ের লক্ষ্য।

২. ঘনিষ্ঠতাঃ আইন ও নৈতিকতার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। আইন হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বোধের প্রতিফলন। যে দেশের নৈতিক মূল্যবোধের মান খুব নিচু, সে দেশের আইন কখনো উচ্চমান সম্পন্ন হতে পারে না। মানুষের নৈতিকতাবোধ রাষ্ট্রীয় আইনকে প্রভাবিত ও সাহায্য করে। সমাজ জীবনে উৎকর্ষতা সাধনে আইন ও নৈতিকতা ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।

৩. একে অপরকে প্রভাবিত করেঃ ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা যেমন অনেক সময় আইনে পরিণত হয়, তেমনি আইনও অনেক সময় কুনীতিকে দূর করে সুনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে। সতীদাহ বা সহমরণ প্রথাকে এক সময় ভারতে নীতি বা ধর্মের অঙ্গ মনে করা হতো। ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে। বর্তমানে প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই অস্পৃশ্যতা ও বর্ণ প্রথার বিরুদ্ধে সাংবিধানিক আইন রচিত হয়েছে। অস্পৃশ্যতা ও বর্ণ প্রথা এখন তাই শুধু নৈতিকতা বিরোধীই নয়, বরং প্রায় সব রাষ্ট্রে এখন তা বেআইনি। সুতরাং আইনের কার্যকারিতা যেমন মানুষের নৈতিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল, তেমনি সময় ও পারিপার্শ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্যহীন নৈতিক বিশ্বাসও আইনের দ্বারা পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত হয়। রাষ্ট্র সাধারণত নৈতিক আদর্শকে অনুসরণ করে।

৪. সমাজ ও রাষ্ট্র নির্ভরতাঃ আইনের মতোই নৈতিকতাও সমাজ এবং রাষ্ট্র-নির্ভর। সমাজব্যবস্থা এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে নৈতিক ধারণা ও আদর্শেরও পরিবর্তন ঘটে। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সম্পত্তি অর্জন এবং প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবাধ ও নির্মম প্রতিযোগিতা চলে। স্বার্থপরতা ও লোভই সেখানে প্রতিষ্ঠালাভের ভিত্তি। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নৈতিক ভিত্তি হলো সামাজিক স্বার্থকে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া।

পরিশেষঃ উপরোক্ত আলোচনার সূত্র ধরে বলা যায় যে, আইন ও নৈতিকতার মধ্যে কিছু কিছু পার্থক্য থাকলেও উভয়ের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ও মধুর। উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। যখন কোনো আইন-নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে তখনই তা জনগণ কর্তৃক সমাদৃত হয়। নৈতিকতা বিরোধী আইন কোনো দিনই জনসমর্থন লাভ করেনি এবং টিকেও থাকেনি।