প্রশ্নঃ আইন কাকে বলে? আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর।
[What is Law? Distinguish between Law and morality.] 

উত্তরঃ আইনের কোন সর্বজন স্বীকৃত সংজ্ঞা নাই। এর পরিধি এবং ক্ষেত্রের ব্যাপকতা লক্ষ্য করে কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দ্বারা এর ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করা সম্ভব হয় নি। আইনের প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে মোটামুটি সকলেই ঐকমত্য পোষণ করলেও এর সংজ্ঞা সম্পর্কে আইনবিজ্ঞানীরা ভিন্নমত পোষণ করেন। সাধারণভাবে কোন কার্যের বিধিকেই আইন বলা হয়। মানুষ সামাজিক জীব হিসেবে তার বাহ্যিক আচরণের বিধিমালাকে আইন বিজ্ঞানের ভাষায় আইন বলে।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিজ্ঞানী জন অস্টিন (John Austin) সর্বপ্রথম আইনকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করে এর সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মতে, “আইন বলতে এমন এক ধরনের আদেশকে বুঝায় যা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ কর্তৃক জারী করা হয় এবং বলপ্রয়োগ বা শাস্তি প্রদানের দ্বারা কার্যকরভাবে বলবৎ করার ব্যবস্থা করা হয়। সার্বভৌম শক্তির আদেশকেই অস্টিন প্রকৃত আইন বলে অভিহিত করেন এবং আইনের প্রায়োগিক শক্তির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।

অস্টিনের আদেশমূলক সংজ্ঞাটিকে নীতিগতভাবে গ্রহণ করে অধিকতর গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদান করেন আরস্কিন হল্যাণ্ড (Erskine Holland)। তিনি বলেন, “আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রণ বিধি এবং ইহা সার্বভৌম রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বলবৎযোগ্য হয়ে থাকে।

[Law is general rules of external human action, enforced by a sovereign political authority.]

হল্যাণ্ডের মতে, সার্বভৌমের আইন মানুষের বাহ্যিক আচরণের সহিত সম্পর্ক যুক্ত।

আই হেরিং (I hering) আইনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “ব্যাপক অর্থে আইন হলো সমাজ জীবনের এ সকল অবস্থার সমষ্টি যা বাধ্যতামূলক বাহ্যিক পন্থা অবলম্বনে রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক সংরক্ষিত হয়।

নিউজিল্যাণ্ডের অধিবাসী প্রখ্যাত আইনবিশারদ জন স্যামণ্ড (John Salmond) বলেন যে, “আদালতে স্বীকৃত ও অনুসৃত নিয়মাবলীর সমষ্টি হচ্ছে আইন।” 

[The law consists of the rules recognized and acted upon by the courts of Justice.]

সাম্প্রতিককালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কিন আইনবিজ্ঞানী : জন চিপম্যান গ্রে (Gray) এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, নাগরিকদের বৈধ অধিকার ও কর্তব্য নির্ধারণের জন্যে আদালত যে সকল বিধিবিধান মেনে চলেন, তা হচ্ছে আইন ৷

অতি সম্প্রতি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এইচ, এল, হার্ট (Hart) The concept of Law বইতে আইনের প্রকৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে একে বিধি ব্যবস্থা বিশেষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আইন ও নৈতিকতার মধ্যে পার্থক্যঃ আইন ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক এমন নিবিড় যে, অনেক ক্ষেত্রেই একটিকে অপরটি হতে পৃথক করা যায় না এবং তারা প্রায়ই পাশাপাশি চলে। এতদসত্ত্বেও এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্যগুলি নিম্নরূপঃ 

(১) আইন হচ্ছে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের বাহ্যিক আচরণের নিয়ন্ত্রণ বিধি,  নৈতিকতা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আচরণের আদর্শ।

(২) সামাজিক মূলাবোধই হচ্ছে আইনের দিক নির্দেশনার ভিত্তি। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা বা অন্যের ক্ষতি না করা কিংবা প্রণীত আইন লংঘন না করা আইনের নির্দেশ যা সামাজিক মূল্যবোধ হতে উদ্ভূত।

পক্ষান্তরে, নৈতিক মূল্যাবোধই হচ্ছে নৈতিক আদর্শের দিক নির্দেশনা যা নীতিবোধ বা আদর্শ হতে উদ্ভূত। অন্যের ক্ষতি না করে বরং উপকার করা নৈতিকতার নির্দেশ।

(৩) দেশের ও জনগণের মঙ্গল ও শান্তি প্রতিষ্ঠা হচ্ছে আইনের লক্ষ্য; কিন্তু নৈতিকতা মূলতঃ বিবেক-প্রসূত যুক্তি ও আবেগ যার লক্ষ্য বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ স্থাপন। 

(৪) রাষ্ট্র কর্তৃক আইন বলবৎ করা হয়। তাই এক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ করা হয় এবং আইন ভঙ্গকারীকে শাস্তি পেতে হয়।

অপরদিকে, মানুষের বিবেক বা বিবেকের তাগিদই নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করে। সেখানে বলপ্রয়োগ বা শাস্তির ব্যবস্থা নেই।

(৫) অধিকার, কর্তব্য ও প্রায়োগিক শক্তির প্রাধান্য আইনের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে কাজ করে। কিন্তু নৈতিকতার উপাদানগুলি হচ্ছে, সততা, সদাচার, ন্যায়পরায়ণতা, পরোপকার ইত্যাদি।

(৬) আইন মূলতঃ আইনসভা কর্তৃক প্রণীত হয়ে থাকে এবং প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। কিন্তু নৈতিকতা যেহেতু মানুষের আদর্শ ভিত্তিক এবং বিবেক নির্দেশিত সেহেতু ইহা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সৃষ্টি করা যায় না বা পরিবর্তন করা যায় না।

(৭) আইন যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি লক্ষ্য রেখে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ কর্তৃক প্রণীত হয়ে থাকে এবং অপর অঙ্গ কর্তৃক বলবৎ করা হয় সেহেতু বিভিন্ন দেশের আইনবিভিন্ন হতে পারে। কিন্তু নৈতিকতা যেহেতু নৈতিক মূল্যবোধ হতে উদ্ভূত, সকল. দেশেই ইহা মোটামুটি একই ধরনের বা মানের হয়ে থাকে।

(৮) আইনগত বিরোধগুলি আদালাত কর্তৃক আইনের বিধান অনুসারে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে, কিন্তু, নৈতিকতার মাঝে সাধারণত কোন বিরোধ থাকে না এবং আইনগত ভিত্তি ব্যতিরেকে এককভাবে নৈতিক আইন ভঙ্গ করলে তা আদালত কর্তৃক মীমাংসাযোগ্য নয়।