বর্তমানে মাদকাসক্তির কড়ালগ্রাসে আমাদের তরুণ সমাজ ধ্বংস হচ্ছে তাই আমাদের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ – রচনা লিখার প্রয়োজন হয়। এর জন্য আমি মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ – রচনা যথাযথভাবে লিখার চেষ্টা করেছি। তোমরা যারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চাও মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ – রচনা তাদের জন্য।
প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, মাদকের কড়ালগ্রাস থেকে বাঁচতে হলে তোমাদের মাদক সম্পর্কে যথাযথ ভাবে জানতে হবে। আর তোমরা যদি সঠিকভাবে জানতে পারো তাহলে মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ গড়া সম্ভব। নিচে তোমাদের জন্য মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ – রচনা বিস্তারিত ভাবে লিখা হলো –
মাদক মুক্ত বাংলাদেশ রচনা
ভূমিকা
একটি দেশকে সুস্থ ভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন সুস্থ পরিবেশ আর এই পরিবেশের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারে সেই দেশের তরুন সমাজ কারণ তরুণরাই হলো দেশ, জাতি ও সমাজে গড়ার কারিগর। তরুণ সমাজ হলো আগামী দিনের কর্ণধার। তরুনরা দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল চালিকা শক্তি। প্রাচীনকাল থেকেই দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তরুনরায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও পালন করবে।
কিন্তু আমাদের এই তরুণ সমাজ আজ বিভিন্নভাবে মাদক নামক ভয়ংকর নেশার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে যার কারণে ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের এই চালিকা শক্তি তরুণ প্রজন্ম। চোরাচালানের মাধ্যমে যেমন একটি দেশের সম্পদ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিক তেমনি সেই দেশে তরুণ সমাজ যখন পথভ্রষ্ট হয় এবং নেশাগ্রস্ত হয় তখন সেই দেশের উন্নতি ও বাধা গ্রস্ত হয় এবং ভেঙ্গে যায় দেশের মেরুদন্ড।
মাদকদ্রব্য কি
মাদকদ্রব্য বলতে সে সব দ্রব্য কে বোঝানো হয়ে থাকে যেসব দ্রব্য সেবন করলে বা গ্রহণ করলে মানুষ তার মানসিকও শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করে এবং মানুষের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ যেসব দ্রব্য গ্রহণ করলে বা প্রয়োগ করলে মানবদেহে তার অস্তিত্ব হ্রাস পায় তাকে মাদকদ্রব্য বলা হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য রয়েছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – মদ, গাঁজা, আফিম, ভাঙ ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে আধুনিক প্রজন্মের মাদকদ্রব্য গুলো হল –
ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, কোকেন, মরফিন, মারিজুয়ানা, প্যাথেডিন, এলএইচডি, স্মাক, হাসিস, পপি, ক্যানবিস ইত্যাদি। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী নিকোটিন যুক্ত তামাক দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে জর্দা, চুরুট, সিগারেট, নস্যি ইত্যাদি।
মাদকাসক্ত কি
মাদকাসক্ত বলতে বোঝানো হয় মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়া বা নির্ভর হয়ে পড়া। যখন কোন ব্যক্তি নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং যেসব দ্রব্য সামগ্রী প্রাণ করলে বা ব্যবহার করলে নেশার সৃষ্টি হয় সেগুলো পর্যায়ক্রমে সেবন করে তাকে মাদকাসক্ত বলে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, “মাদকাসক্ত বা নেশা এমন একটি শারীরিক বা মানসিক প্রক্রিয়া যার মিথস্ক্রিয়া কেবলমাত্র জীবিত মানুষের মধ্যেই সৃষ্টি হয়” অর্থাৎ মাদকাসক্তি হল মানুষের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া।
আর এই মাদকাসক্ত হলো এমন একটি নেশা যার কবল থেকে মানুষ সহজে বের হতে পারে না আর এর পরিণতি হল অকাল মৃত্যু। মাদকের নেশা এত ভয়াবহ যে মানুষ ইচ্ছে করলে এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা। দিন দিন মানুষ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়, অভ্যাসগত চেতনার উর্ধ্বে কারী দ্রব্যের ব্যবহার করে এবং মানুষের নৈতিক ও মানসিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয় ফলে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
মাদকের প্রকারভেদ
বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য রয়েছে। তবে এই মাদকদ্রব্য গুলোকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন –
প্রাকৃতিক ও
রসায়নিক
প্রাকৃতিক
প্রাকৃতিকভাবে যেসব মাদকদ্রব্য উৎপাদিত হয় তাকে বলা হয় প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য। তবে এই প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য সাধারণত বিভিন্ন প্রকার গাছ থেকে উৎপাদন হয়ে থাকে যেমন – গাঁজা, তাড়ি, আফিম, ভাঙ,চরস ইত্যাদি।
রাসায়নিক
বিভিন্ন পরীক্ষাগারে রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে যেসব মাদকদ্রব্য উৎপাদন করা হয় তাকে বলা হয় রাসায়নিক মাদকদ্রব্য। প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য থেকে রাসায়নিক মাদকদ্রব্য স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ক্ষতিকর এবং এই মাদকদ্রব্য বেশি নেশা সৃষ্টি করে থাকে। রাসায়নিক মাদকদ্রব্য গুলোর মধ্যে রয়েছে – হেরোইন, ইয়াবা, মরফিন, কোকেন, প্যাথডিন সহ বিভিন্ন প্রকার অ্যালকোহল সঞ্জীবনী, সুরা ইত্যাদি। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিকোটিনযুক্ত বিভিন্ন উৎপাদিত দ্রব্য কে মাদকদ্রব্য হিসেবে অভিহিত করা হয় যেমন – জর্দা, সিগারেট, নস্যি, চুরুট ইত্যাদি।
মাদকের উৎস
বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বব্যাপী মাদক দ্রব্য বিস্তৃত রয়েছে কারণ মাদক দ্রব্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত হয়ে থাকে আর এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মুনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। যারা দেশের চোরা চালান, বিতরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ করে থাকে প্রধান অঞ্চলগুলো হিসাবে পরিচিত হলো – গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল. গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এবং গোল্ডেন ওয়েজ। মায়ানমার ব্লাউজ ও বার্মার পরিধি জুড়ে রয়েছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। পাকিস্তান আফগানিস্তান ইরান তুরস্ক জুড়ে রয়েছে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট।
তবে গোল্ডেন ক্রিসেন্ট পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয় আর নেপাল ও ভারত সীমান্ত জুড়ে রয়েছে গোল্ডেন ওয়েজ। নেপাল ও ভারত সীমান্তে উৎপাদিত হয় প্রচুর পরিমাণে গাঁজা, হেরোইন, আফিম, কোকেন ইত্যাদি। আর মাদক উৎপাদনের একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে ব্রাজিল, ইকুয়েডর, কলম্বিয়া ও বলিভিয়া। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে এসব মাদকদ্রব্যের নেটওয়ার্ক।
মাদকাসক্তির কারণ
একজন ব্যক্তি মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে বিভিন্ন ধরনের কারণ রয়েছে তবে প্রধান কারণগুলো হলো –
- পারিবারিক অশান্তি
- বেকারত্ব
- নৈতিক শিক্ষার অভাব
- মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদের প্ররোচনা
- হতাশা ও বন্ধুত্বের প্ররোচনা
- পাশ্চাত্য জীবনের অন্ধ অনুকরণ
- প্রেমে ব্যর্থতা
- রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা
- মাদকের সহজলভ্যতা
- অসৎসঙ্গ
- আইন শৃঙ্খলা ও প্রশাসনের অনিশ্চয়তা
- হতাশা ও বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনা
- মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদের প্ররোচনা
- সামাজিক ও অসচেতনতা
- মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
- দেশের বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
- পাশ্চাত্য জীবনের অন্ধ অনুকরণ
- আদর্শ বিচ্যুত হওয়া
- মাদকের সহজলভ্যতা
- প্রেমে ব্যর্থতা
- অনৈতিক কর্মকান্ড
- সৌখিনতা এবং কৌতূহলবশত।
মাদকের উৎসভূমি
বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মাদক উৎপন্ন হয়ে থাকে। আর আফিম হল মাদকের সবচেয়ে প্রাচীন মাদক। পপি ফুলের নির্যাস থেকে কৃষকেরা আফিম তৈরি করে থাকে এবং এই নির্যাস থেকে তৈরি হয় মরফিন বেস আর সর্বনাশা হিরোইন তৈরি হয় এই আফিম থেকে। মারিজুয়ানা নামক মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় যুক্তরাষ্ট্র, মরক্কো, পাকিস্তান, কলম্বিয়া, জামাইকা, আফগানিস্তান, ব্রাজিল, গুয়েত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, কেনিয়া, ঘানা প্রভৃতি দেশে। আর হাসিস উৎপন্ন হয় জামাইকা, মরক্কো, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, জর্ডান, ভারত এসব দেশে।
মাদকদ্রব্যের চোরা চালান
মাদকদ্রব্য চোরাচালানের সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক ব্যক্তি সম্পর্ক এছাড়াও অনেক ব্যবসায়িক দিক রয়েছে ভারত ও পাকিস্তান আর এগুলো পাচার হয়ে থাকে এসব দেশ থেকে আর এই মাদকদ্রব্য পশ্চিম ইউরোপে। যেসব দেশে পাচার হয় সেগুলো হল – ইতালি, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন আর শ্রীলঙ্কাকে ব্যবহার করা হয় চোরাচালানের কেন্দ্রস্থল হিসাবে। তবে চোরা চালানের ট্রানজিট পয়েন্ট বাংলাদেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশকেও চোরাচালানের কারবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মাদকদ্রব্য সেবনের ক্ষতিকর দিক সমূহ
বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মাদকদ্রব্য এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমিকম্প করা অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি এবং যুদ্ধবিগ্রহের চেয়েও এই মাদকাসক্তি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে যুদ্ধের ফলে একটি দেশ যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয় মাদকাসক্তির ফলে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার কারণে মারকেএস গোল্ড মাদকদ্রব্যের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন মাদকদ্রব্য সেবনে যে ক্ষতিগুলো হয় তা হলো –
শারীরিক ক্ষতি
একজন মানুষ যখন মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে তখন সবচেয়ে বেশি লক্ষণ প্রকাশ পায় তার শরীরে কারণ মাদকাসক্তর ফলে মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আর মাদকাসক্ত হওয়ার ফলে মানুষের যে শারীরিক ক্ষতিগুলো হয় তা হল –
- মুখমন্ডল ফুলে যাওয়া, বিকৃত হওয়া।
- মুখমন্ডল সহ সারা শরীরে কালশিটে পড়া।
- লিভার নষ্ট হওয়া এবং প্রসারিত হওয়া।
- মুখমণ্ডল লাল হয়ে যাওয়া।
- স্মৃতিশক্তির কোষ ধ্বংস হওয়া।
- ফুসফুসও মুখ গহব্বরে ক্যান্সার হওয়া।
- হঠাৎ শিউরে ওঠা।
- অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
- হজম শক্তি হ্রাস পায় ও খাবারের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়।
- দীর্ঘ সময় ধরে ঠান্ডা লেগে থাকা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়া।
- সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পায়।
- যৌন ও চর্মরোগ বৃদ্ধি পায়।
- স্ত্রীর গর্ভের সন্তান বিকলাঙ্গ বা নানা রোগে আক্রান্ত হয়।
- সংক্রামক রোগ বৃদ্ধি পায়।
- ব্রংকাইটিস রোগবৃদ্ধি সহ বুকে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
- নাকের জিল্লি ফুলে ওঠে।
- হঠাৎ চোখে কম দেখে।
- যৌবন শক্তি কমে যায়।
- স্মরণ শক্তি কমে যায়।
- বুক ও ফুসফুস নষ্ট হয়।
- মাদক গ্রহণের ফলে অন্যান্যভাবে ২৫ প্রকারের রোগ সৃষ্টি কর হয়।
- ধূম পায়ের জন্য অধুমপায়ের ক্ষতি হওয়া।
- মাদকাসক্তির ফলে বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে ১ জন করে মানুষ মারা যায়।
- ১৩ টি সিগারেট এ মৃত্যুর ঝুকি সাত গুণ।
- ২০টি সিগারেট ফুসফুস ক্যান্সারে ঝুঁকি ২0 গুণ।
- জাতিসংঘের সংস্থা মতে ধূমপানের ফলে সাড়ে ছয় সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যায়।
মানসিক ক্ষতি
মাদকাসক্তের ফলে একজন মানুষের যেসব মানসিক ক্ষতি হয় সেগুলো হল-
- মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়
- খাবারের প্রতি অনীহা দেখা দেয়
- অলসতা বৃদ্ধি পায়
- পরিবারের আপনজনের প্রতি ভালবাসা কমে যায়
- অসংলগ্ন কথা বলে
- অনিদ্রা
- দৃষ্টিভ্রমে হওয়া
- সিক্ত বই করল
- মাথা ঘোরানো
- সব বিষয়ে অমনোযোগী হওয়া
- মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এবং হতাশাগ্রস্থ ও উদ্বিগ্ন প্রকাশ করা।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
একজন মানুষ মাদকাসক্ত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনৈতিক দিক থেকে। মানুষ প্রতিনিয়ত কোটি কোটি টাকা নষ্ট করছে এই মাদকের জন্য। মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত এমনকি পথ শিশুরাও এই মাদক সেবনের সঙ্গে যুক্ত। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, পুরো বিশ্বব্যাপী মানুষ তামাক ব্যবহারেই ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতি করছে আর আন্তর্জাতিক বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমানে মানুষ সিগারেট কিনতে যে টাকা ব্যয় করে তা যদি স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করতো তাহলে মানুষের স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনীয় সকল কিছু পূরণ হয়ে যেত। আর এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারলেই সম্ভব মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ।
বাংলাদেশে মাদক গ্রহণ
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে তরুণ তরুণীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সময়ে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা ও মাদক গ্রহণে বেশ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মাদক গ্রহণের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত এর মধ্যে রয়েছে পুরুষের সংখ্যা ৮৪ ভাগ এবং নারীর সংখ্যা ১৬ ভাগ।
আবার ২০১৩ সালের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মাদকাসক্ত। আবার ২০১৭ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে বলা হয়েছে বাংলাদেশের শতকরা ৮৮.৩৯ শতাংশ মাদকাসক্ত এর মধ্যে রয়েছে ১৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী মানুষ। তবে বাংলাদেশের সেসব মেয়েরাই বেশি মাদক গ্রহণ করে যাদের বাবা-মা অনেক বিত্তশালী। এছাড়াও বাংলাদেশের নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোর মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত যার কারণে বাংলাদেশে মাদকের হার বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন ৩ লাখ তরুণ তরুণী এবং জনসংখ্যা মাদকের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও অন্য এক তথ্যে বলা হয়েছে মাদকাসক্তের সংখ্যা বাংলাদেশে ৭৫ লাখ এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ তরুণ তরুণীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ ভাগ বেকার ও ৬৫ ভাগ মানুষ রয়েছে আন্ডারগ্রাজুয়েট আর ১৫ ভাগ রয়েছে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ। অন্য একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মাদক সেবীরা গড়ে অন্তত প্রতিদিন ২0 কোটি টাকার মাদক সেবন করে সেই হিসেবে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
আর এই টাকার শতকরা ১0 হাজারের কোটিরও বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয় এর মধ্যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা এবং এর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৫ ভাগ। আর যারা ইয়াবা সেবন করে তার অধিকাংশই নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে এর মধ্যে রয়েছে কিডনি, লিভার, মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কর্ম ক্ষমতা নষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগ আর এর প্রধান কারণ হচ্ছে মাদক। ইয়াবার মত মাদকদ্রব্য তৈরি হচ্ছে ভেজাল উপাদান দিয়ে যার কারণে মানুষ আরো বেশি অন্যান্য কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
আর সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা। বাংলাদেশের যে খুনগুলো হয় তার মধ্যে শতকরা ৮0 ভাগ খুন করে থাকে মাদকাসক্তের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে তাদের কন্যা ঐশী একাই খুন করে আর এই খুন সংঘটিত হয় মাদক সেবনের কারণে। আমাদের সমাজে এরকম হাজারো ঐশী রয়েছে যারা মাদক গ্রহণের জন্য নিজেদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, হারিয়ে ফেলেছে তাদের মানবিক দিকগুলো।
বয়সের সাথে নেশার সম্পর্ক
বাংলাদেশে নেশার সাথে সম্পর্কিত শতকরা ১০০ জনের মধ্যে বৃদ্ধ এবং শিশুর হার ৩৭ ভাগ এবং কিশোর ও তরুণের ভাগ ৬৩ জন। আর আঠারো ১৮ বছর বয়সী মাদক সেবী রয়েছে ৩.৩৩ শতাংশ এবং ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী যাদের কিশোর বলা হয় তাদের সংখ্যা ১.৫ ভাগ। যারা মাদক সেবন করে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন করা মানুষের থেকে অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করে অথবা বাধ্যকে পৌঁছে যায়। তবে বর্তমানে তরুণ সমাজের মাঝে সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত দেখা যায়।
মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ
বাংলাদেশকে যদি মাদক মুক্ত করতে হয় এবং সুস্থ দেশে সুস্থ জীবন গড়তে হয় তাহলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়াও আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ১৯৯0 সালে বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য আইন প্রতিষ্ঠিত হয় আর এই আইন প্রতিষ্ঠার পর থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। আর এই মাদকাসক্ত থেকে আমাদের দেশ তথা যুব সমাজকে যদি মুক্ত রাখতে হয় এবং মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ গড়তে হয় তাহলে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা হলো –
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- সীমান্ত এলাকায় মাদক প্রচারে জড়িত অতি দরিদ্রদের বিকল্প কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
- যারা মাদকাসক্ত তাদের সেফটি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
- মাদক পাচার রোধে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
- সরকারি, বেসরকারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এমনকি এনজিও সকল সহ সকল কমিউনিটি নেতাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
- কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগার আধুনিককরণ করতে হবে।
- সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাদক বিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- মাদক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক আদালত গঠন করতে হবে।
- অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তা কর্মচারীদের জন্য রেশন ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।
- স্কুল কলেজে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে।
- শিশু এবং কিশোরদের জন্য খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
- অধিদপ্তরে এন ফোর্সমেন্ট শক্তিশালী করার জন্য বিভাগীয় শহর এবং সিটি কর্পোরেশন সমূহের স্ট্রাইকিং কোর্স তৈরি করতে হবে।
- মাদকাসক্তের চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
মাদকাসক্তি নিরাময়ে পরিবারের ভূমিকা
মাদকাসক্তি নিরাময়ে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ একজন সন্তান কিশোর বয়সে কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে সে জীবন যাপন করছে ,সে কত টাকা ব্যয় করছে এবং কোথায় থেকে কত টাকা আয় করছে প্রত্যেকটি বিষয়ে তার অভিভাবককে নজরদারি করতে হবে। তার সন্তান হতাশাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা বা কোথায় খেলাধুলা করছে সবকিছু তার পরিবারকে নজরদারি করতে হবে। সন্তানকে সব সময় সময় দিতে হবে তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে তবেই একজন সন্তান মাদক থেকে ফিরে আসতে পারবে। এভাবেই মাদকমুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ গড়া সম্ভব।
মাদকাসক্তির প্রতিরোধ চিন্তা
মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ গড়তে হলে বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে মাদকের যে ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে তা থেকে যুবকদের উদ্ধার করতে হবে বা রক্ষা করতে হবে। মাদকবিরোধী জনমত তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে এছাড়াও এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
সমাজে নেতাদের কর্তব্য
মাদকাসক্তের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক অস্থিরতা এক্ষেত্রে সমাজের নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে যেন মাদকদ্রব্যের ব্যবহার না হয়। সমাজে মাদকদ্রব্য ব্যবহার বন্ধে যদি নেতারা সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেন তাহলে মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ গড়া সম্ভব।
আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তব্য
মাদক পাচার রোধে এবং মাদক সেবনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে সকল দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মাদকমুক্ত সুস্থ জীবন এবং সুস্থ দেশ গড়তে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। তবেই হবে মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ।
উপসংহার
মাদকাসক্তির কারণে সমাজের শুধু এক জায়গায় অশান্তি বিরাজ করে না এই সর্বনাশা নেশা পুরো দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তাই আমাদের দেশকে এই সর্বনাশা নেশার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। তরুণরা দেশের ভবিষ্যৎ, তারা জাতির কর্ণধার, তরুণদের যদি রক্ষা করতে না পারা যায় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অন্ধকার। মাদকাসক্তের হাত থেকে আমাদের দেশ তথা সমাজকে বাঁচাতে হলে সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে এবং সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবেই সম্ভব হবে গড়ে তোলা মাদক মুক্ত বাংলাদেশ সুস্থ জীবন সুস্থ দেশ।
Leave a comment