“কু-সংস্কারমুক্ত মানবীয় চেতনাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র রচনার মূল কথা।”

ভূমিকা: মনস্তত্ত্বের জটিল জিজ্ঞাসার অভিমুখী যে কথাশিল্প- বাংলাকথা সাহিত্যের সেই বিশিষ্ট শিল্প বলয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর [১৯২২-১৯৭১] অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টি তিনি অতিবাহিত করেছেন বিদেশে। এই প্রবাস জীবন তাঁর সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। সেই প্রভাব তাঁর রচনাশৈলী ও প্রকরণে উৎকর্ষের উপরে পড়েছে। কিন্তু তাঁর বিষয়বস্তু অনিবার্য আহরণ ঘটেছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন বৃত্তে লালিত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সংঘাত, অপরাধ, লোভ-লালসা, ভণ্ডামী ভরা বিচিত্র বৃত্তীয় চাহিদার তীক্ষ্ণ অনুভব থেকে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের বিভিন্ন থিওরী ও ইজমের দ্বারা সমৃদ্ধ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মনন ও মানসিকতা। তাঁর স্বদেশ অন্বেষা তাঁর কথাসাহিত্যের চিত্র-চরিত্রকে করেছে জীবন্ত ও অকৃত্রিম। কেননা বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁর ? মানসলোকে বিচরণ ছিল স্বদেশ সাহিত্যের সাধনায় তাঁর অন্বিষ্ট নিজের জন্মভূমি বাংলাদেশ। তাই লেখকের কথা সাহিত্যের অভ্যন্তর থেকে বাংলাদেশের পল্লি অঞ্চলের বিচিত্র পেশার মানুষগুলো অবলীলায় আত্মপ্রকাশ করেছে এবং ঘোষণা করেছে নিজেদের চারিত্রিক স্বাতন্ত্র্য। বস্তুত স্বদেশের অন্তঃলোকে প্রবেশ করেছেন বলেই তাঁর শিল্পনির্মাণ সার্থক হয়েছে।

‘লালসালু’ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ভাগ্যন্বেষী মজিদের জীবনের প্রতিষ্ঠা, প্রাপ্তি ও সংগ্রামের কাহিনি নির্মাণ করতে গিয়ে পূর্ব বাংলার একটি গ্রামের (মহব্বতনগর) সমাজচিত্র অঙ্কন করেছেন- যার সাথে মিশে আছে অন্ধ ধর্মসংস্কার। মজিদ খেয়ে পরে বাঁচার তাগিদে আপন এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নেয় দূরবর্তী মহব্বত নগর গ্রামে। যেখানে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি। সেই শস্য শূন্য মরার দেশের মানুষেরা। তারা বিদেশে গিয়ে পোকায় খাওয়া মস্ত মত্ত কেতাব খতম করে। কিন্তু কেতাবে যে বিদ্যা লেখা থাকে তা কোনো এক বিগত যুগে চড়ায় পড়ে আটকে গেছে। এরকম ধর্মাশ্রিত এলাকায় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, সংস্কার এবং ধর্মভয়কে পুঁজি করে সর্বনাশা খেলায় মেতে ওঠে। এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির কবরকে আশ্রয় করে মজিদ মাজার নির্মাণ করে এবং এর মাধ্যমে মানুষের ধর্মভয় জাগিয়ে তোলা তার পক্ষে সম্ভব হয়। মজিদের ভাষায়: ‘আপনারা জাহেল, বেএলেম, আনপাড়হ। মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করে ফেলে। রাখছেন।’ ধীরে ধীরে মজিদ শাসন-শোষণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং উপভৌগিক মানসিকতা তার ফেলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মজিদ বিবাহ করে এক প্রশস্ত ব্যাপ্ত যৌবনা রহিমাকে।

ক্রমে ক্রমে মজিদ ক্ষমতার একচ্ছত্র দণ্ডের অধিকারী হয়। প্রতিপক্ষকে কঠিন প্রক্রিয়ায় দমন করে। তাহেরের বাপ, আওয়ালপুরের পীর, আক্কাস আলীকে ক্ষমাহীনভাবে জব্দ বরে মজিদ। এতো কিছুর পরেও ভাবিত হয় মজিদ। সন্তান কামনায় ২য় বিবাহ করে তরুণী জমিলাকে। কিন্তু যে ধর্মভয় ও মাজার ভীতিকে ব্যবহার করে সমগ্র মহব্বতনগর নিয়ন্ত্রণ করেছে মজিদ, জমিলার ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে। মজিদের সংস্কারবাদ অনুশাসনকে প্রত্যাখ্যান করে তার অস্তিত্বের গভীরেই ভয় ও পরাভব চেতনা সঞ্চার করেছে জমিলা। মোদাচ্ছের পীরের তার মেহেদি রঞ্জিত পদাগাত মানব জাতিকে শাসন-শোষণ করা অপশক্তির উৎস ধ্বংসের যেমন ইঙ্গিত দেয়, তেমনি ধর্মশক্তি ও সমাজ শক্তির প্রতিভূ মজিদরূপ অস্তিত্বের অপচেষ্ট! বিনাশেরও দিক নিদর্শন করে। এভাবে ‘লালসালু’তে কুসংস্কার মুক্তির ইঙ্গিত ধ্বনিত হয়। উপন্যাসের পরিসমাপ্তিতে জমিলার নীরব প্রতিবাদ সেই কুসংস্কার মুক্ত সমাজ নির্মাণেরই ইঙ্গিত বহন করে। সমাজের কুসংস্কারের অন্ধ বিষবৃক্ষটি জমিলা পদদলিত করেই মৃত্যুর পথ ধরে। যেমন- “মেহেদি দেওয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে।”

এরপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্য’তে কুসংস্কারের চেয়ে মানুষের মনোজাগতিক ভাবনার প্রতিফলনই উদ্ভাসিত। ধর্মের লেবাসধারী শোষক চরিত্রের বেহমিয়ান জীবন চিত্রের পরিচয় বিধৃত। উপন্যাসে যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হয় ধর্মের ধর্মধারী ভণ্ডতাপস কাদেরের আঁধার জীবনের ইতিবৃত্ত। কাদের বাড়ির মুরব্বি দাদা সাহেবের কাছে দরবেশ, এ ধারণা ছিল আরেফ আলীরও। কিন্তু একদা চাঁদনী রাতে আরেফ আলী আবিষ্কার করে কাদেরের গর্হিত জীবন। গভীর রাতে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে আলু থালু বেশ মৃতদেহ এবং মৃতদেহ প্রতিবেশী পর স্ত্রী করিম মাঝির বউ। যুবক শিক্ষক ভ্রান্ত মুরগি মুখে হালকা তামাটে রঙের শেয়াল দেখেছেন, কিন্তু কখনো বিজন রাতে বাঁশ ঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখেনি। আজ প্রতীকী অর্থে সে সেটাই আবিষ্কার করল। আবিষ্কার করল এ লোলুপ হত্যাকারী দরবেশবেশী কাদেবেরই অপকর্মের ইতিবৃত্ত। কাদের নিজেও স্বীকার করে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, কি আর করা যায়? কুসংস্কারের চেয়ে এ উপন্যাসে ছদ্মবেশী ধার্মিকদের আঁধার জীবন চিত্রই অধিকতর প্রস্ফুটিত।

চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসটি মূলত আরেফ আলীর প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাহিনি উপস্থাপিত হয়েছে। প্রচলিত কায়েমি স্বার্থ, প্রথা, আভিজাত্য ও ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে তার অনুচ্ছ অথচ প্রত্যয়ী কন্ঠের অনাস্থা এখানে ঘোষিত হয়েছে। ঔপন্যাসিক এভাবেই নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে একটি সাদামাটা, নিরীহ, ভীরু,, দুর্বলচিত্তের মানুষের মধ্য দিয়ে সুগভীর জীবনবোধকে উদ্বোধিত করেছেন। সত্যপ্রকাশে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই একদা প্রকাশ করে প্রকৃত ঘটনা- যা সবাইকে ঝাখুনি দিতে না পারলেও ঝাকুনি দিয়েছে সমাজব্যবস্থাকে আর এখানেই লেখকের সার্থকতা।

“কাঁদো নদী কাঁদো” কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে কুসংস্কারে বন্দি একটি জনপদের অধিবাসীদের জীবন ভাবনা উন্মোচিত। অস্তিত্বের অভীপ্সায় কাতর কুমারডাঙ্গার অধিবাসীদের শংকাতুর জীবন, নদীর কান্নার আওয়াজ শুনে ভীতবিহ্বল হয়ে পড়ে সে এলাকার জনগণ। ক্রমে বাঁচার আশায় তাদের কুসংস্কারের রূপটি হয়ে পড়ে উন্মোচিত। একদিন সন্ধ্যার দিকে দর্জিপাড়ার রহমত শেখ একটি নবজাত বাছুরকে বুকে জড়িয়ে এবং হাতে একটা ধারালো ছুরি নিয়ে নদীর দিকে ছুটতে শুরু করে। তার পর প্রথমে সে ধারালো ছুরি দিয়ে বাছুরটির গলা কাঁটে এবং নদীতে উৎসর্গ করে ভীতি বিহ্বলতার থেকে মুক্তি চায়। ক্রমে ক্রমে কুমারভাঙ্গার অধিবাসীরা দলে দলে নদীর তীরে উপস্থিত হতে শুরু করে, হাতে এটা-সেটা। যে যা পারে যা যার কাছে মূল্যবান মনে হয় তাই নিয়ে আসে হাঁড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, চাল-ডাল, টাকা-পয়সা, এমনকি সোনা-রুপার গহনাও। এসব তারা নদীর পানিতে ছুঁড়তে শুরু করে। মোল্লা-মৌলভীরাও বিশেষ আজান ও নামাজের ব্যবস্থা করে। মূলত ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে কুসংস্কারের আড়ালে বাঁচার তাগিদে মানুষের গভীর উদ্বেগ আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশিত।

মূলত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আধুনিক জীবনবোধকে ধারণ করেছিলেন তাঁর লেখা-লেখিতে। শুধু উপন্যাসে নয় তার রচিত নাটক এবং গল্পসমূহেও একই চিন্তা বিকশিত হতে দেখা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যে এক নবধারার জন্ম হয়। গল্পকবিতা, উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ সমস্ত ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সে ধারার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিলেন সযত্নে।

পূর্ববাংলার মানুষের জীবন যাপনের ধারায় এ ধরনের কুসংস্কার পেরেছিলো মূলত দুটি কারণে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সে সত্য যথার্থই স্পষ্ট করেছেন তাঁর লেখাতে। কারণ দুটির মধ্যে একটি অর্থনৈতিক সংকট যেটাকে অস্তিত্বের সংকট নামে লেখক দেখিয়েছেন প্রথমদিকে এবং অন্যটি নৈতিক শিক্ষা বা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবার অভাব। যেকারণে তাদের মধ্যে চেতনাবোধ প্রবাহিত হয়েছে। যে কারণে স্থির কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে তাদের সময়ক্ষেপণ হয়েছে। যে কারণে যুক্তি বিচার করে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেরী করেছে বা পৌঁছতে পারেনি।

মজিদের প্রথম পরিচয় সে একজন মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর অধিকার তার আছে। আর প্রথমত যে অন্যায়পথ সে বেঁছে নিয়েছে সেখানে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ কাজ করেনি। এক সময় সে নিজেই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। আরেফ আলি প্রথমত কিছুটা হাবা-বোকা হলেও ক্রমান্বয়ে অস্তিত্ববান হয়ে উঠেছে, কিন্তু লেখক সংস্কারের জ্বালে জুলিয়ে মুহম্মদ মুস্তফাকে মরে যেতে বাধ্য করেছেন- যেনো মৃত্যুতে সব দেনা শোধ করতে মুহম্মদ মুস্তফার এ হটকারী সিদ্ধান্তের খুব বেশি প্রয়োজন ছিল।

তাঁর “দুই তীর ও অন্যান্য গল্প” গ্রন্থের ‘গ্রীস্মের ছুটি’ গল্পে সেলিনার অবকাশকালীন অভিজ্ঞতার কাহিনী। গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল সেলিনা। তার আসার দু’দিন পরই একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঘটনার প্রতিক্রিয়ার পর দিনই সেলিনার ভীষণ জ্বর হয়। তার দাদার আশ্রিত ‘আম মৌলবী, তার জ্বর সারানোর কাজে নিয়োগ পায়। সাত দিন পর সেলিনার জ্বর ছাড়লেও সেলিনার স্বভাব পরিবর্তিত হয়, সে গম্ভীর ও স্বল্পভাষী হয়ে ওঠে একাকী বিচরণ করে অথবা নিঃসঙ্গ বসে থাকে। পরে গল্পকার সেলিনাকে স্থাপন করেছেন দিগন্ত প্রসারিত এমন এক মাঠের সামনে যেখানে সে অশ্বারোহীদের সশব্দ আগমন প্রত্যক্ষ করেছেন। একদা আম মৌলবী তাকে আম বাগানে নিয়ে যায় আম পেড়ে দেওয়ার জন্য। আমের ডালে কেটে যায় সেলিনার গালের এক পাশ। তখন আম মৌলবী গাছ থেকে নেমে এসে প্রকাশ করে তার বিভৎস রূপ:

“তারপর সহসা যেন মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে সে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে। ক্ষিপ্রভঙ্গিতে সেলিনার সামনে উবু হয়ে বসে তার গালের ক্ষত স্থানে মুখ দিয়ে চুষতে থাকে ক্ষত স্থানটি। তার গালে আম মৌলবীর কর্কশ ঠোটের স্পর্শ পেয়ে সেলিনা হঠাৎ নিথর হয়ে পড়ে।”

আলোচ্য গল্পটির মধ্য দিয়ে লেখক মৌলবী নামী জীবদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। সেলিনার শিশু মনস্তত্ত্ব বার বার আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে যা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।

সুতরাং সার্বিক আলোচনা থেকে বলা যায় যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সারা জীবনে মাত্র তিনটিা উপন্যাস এবং দুটি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর লেখালেখির প্রেক্ষাপট ছিল ধর্মমিশ্রিত ও সংস্কারাশ্রিত জীবন। অশিক্ষা, কুশিক্ষা আর অর্থনৈতিক সংকটে পূর্ব বাংলা জনজীবনে সংস্কারাচ্ছন্ন বোধের জন্ম হয়েছিল তা তিনি সূক্ষ্ম ও সুনিপুণভাবে লেখায় স্থান দিয়েছেন এবং সেখান থেকে সাধারণ মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করুক ও তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন থেকে এ ধরনের তত্ত্ব পরিত্যাগ করুক এ স্বপ্নে স্বপ্নীল হয়েছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর উপন্যাস এবং গল্পসমূহে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।