ভূমিকা: উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের চর্চায় যে-কজন মুসলিম সাহিত্য-সাধক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১২) সর্বাধিক খ্যাতিমান। লেখকের দীর্ঘ সাহিত্যিকজীবনে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন এ অঞ্চলের ইতিহাস ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন ভাঙা-গড়া। বিশেষকরে বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, অর্থনীতি প্রভৃতি মানব সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসময় বহুবিধ বিবর্তন, সংঘাত ও পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। সমাজ ও স্বকালের বিবিধ বিষয় তাই সহজেই প্রযুক্ত হয়েছে তাঁর সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাতে তাঁর বিচরণ ছিল সব্যসাচী লেখকের মতো। তাই বাঙালি মুসলিম লেখকদের অগ্রপথিক হিসেবে তাঁর নাম স্মরণীয়।

মীর মশাররফ হোসেন একাধারে গদ্য, পদ্য, নাটক, প্রহসন এবং আত্মজীবনীমূলক রচনা করেছেন। ফলে ধীরে ধীরে তাঁর রচনায় ক্ষুরধারাভাব প্রকাশ হতে থাকে। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘গোরাই ব্রিজ’ ও ‘গৌরী সেতু’র ভাষা সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন:

“গ্রন্থখানি পদ্য। পদ্য মন্দ নহে। এই গ্রন্থকার আরও বাঙ্গালা গ্রন্থ প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার রচনার ন্যায় বিশুদ্ধ বাঙ্গালা অনেক হিন্দুতে লিখিতে পারে না। ইহার দৃষ্টান্ত আদরণীয়। বাঙ্গালা হিন্দু-মুসলমানের দেশ- একা হিন্দুর দেশ নহে। কিন্তু হিন্দু মুসলমান এক্ষণে পৃথক- পরস্পরের সহিত সহৃদয়তাশূন্য। বাঙ্গালার প্রকৃত উন্নতির জন্য নিতান্ত প্রয়োজনীয় যে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য জন্মে। যতদিন উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে এমত গর্ব থাকিবে, যে তাঁহারা ভিন্নদেশীয়, বাঙ্গালা তাঁহাদের ভাষা নহে, তাঁহারা বাঙ্গালা লিখিবেন না, কেবল উর্দু ফারসীর চালনা করিবেন, ততদিন সে ঐক্য জন্মিবে না। মীর মশাররফ হোসেন সাহেবের বাঙ্গালা ভাষানুরাগিতা বাঙ্গালীর পক্ষে বড় প্রীতিকর। ভরসা করি, অন্যান্য সুশিক্ষিত মুসলমান তাঁহার দৃষ্টান্তের অনুবর্তী হইবেন।”

মীর মশাররফ হোসেনের ভাষা সম্পর্কে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন:
“মীর সাহেবের পূর্বে মুসলমান লিখিত বঙ্গসাহিত্যে কবিতা ছিল, পড়িবার মতো গদ্য ছিল না। মুসলমান গদ্যলেখকবর্গের মধ্যে এখন পর্যন্তও মীর মশাররফ হোসেন সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক।”

এটা উল্লেখ্য যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের ভিত্তি নির্মাণে বন্ধন-শৃঙ্খলার ব্যবহার করেছিলেন। তখন তার প্রয়োজন ছিল। সেই ভিত্তির উপর বঙ্কিমচন্দ্র গদ্যের শ্রী ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মীর মশাররফ হোসেন সেই শ্রীসম্পন্ন গদ্যপটভূমিতে তাঁর গদ্যরচনাকে উপস্থিত করেছিলেন। তাই তাঁর বাক্য সজ্জায়, পদগুচ্ছের অবস্থানে, খণ্ডবাক্যের সজ্জায়, উক্তিধর্মী বাক্য রচনায়, নিত্যসম্বন্ধী ও শব্দযুগলের ব্যবহার বিদ্যাসাগরীয় গদ্যরীতি তথা বঙ্কিমী গদ্যরীতির সফল অনুসৃত লক্ষ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে মীর মশাররফ হোসেনের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য।

ক্রিয়াপদের ব্যবহারে মীর মশাররফ ছিলেন অনেকটা আধুনিক। যেমন- “তোমরা আমার সঙ্গে আইস, কোন চিন্তা নাই, আমি তোমাদিগকে রক্ষা করিব। ইহাতে আমার অদৃষ্টে যাহা থাকে হইবে। আইস, আমার সঙ্গে আইস।” (বিষাদ-সিন্ধু)

গদ্য রচনাকার হিসেবে মীর মশাররফ হোসেনের প্রধান সফল স্থান বাংলা নাটক এবং প্রহসন রচনায়। ‘রত্মবর্তী’ (১৮৬৯), ‘বসন্তকুমারী’ (১৮৭৩) এবং ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য নাটক। এছাড়াও তাঁর গদ্য ভাষার নমুনা পাওয়া যায় ‘এর উপায় কি’, ‘বিষাদ-সিন্ধু’ (রচনাকাল ১৮৮৫-৯১), ‘সঙ্গীত লহরী (১৮৮৪), ‘গো-জীবন’ (১৮৮৯), ‘বেহুলা গীতাভিনয়’ (১৮৮৯), ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯০) ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ (১৮৯৯) ‘মৌলুদ শরীফ’ (১৯০৩), ‘বিবি খোদেজার বিবাহ’ (১৯০৫), ‘আমার জীবনী’ (১৯১০) প্রভৃতি গ্রন্থে।

‘বসন্তকুমারী’ নাটকের কাহিনি দৃঢ় সংবদ্ধ, চরিত্র সৃষ্টি অধিকতর বাস্তবধর্মী এবং সুস্পষ্ট, সংলাপের ভাষা আরো নাট্যধর্মী এবং সমুন্নত। রূপকথার রোমান্টিক জীবনের মধ্যেও যে আধুনিক নাটকীয় ভাষায় সংলাপ রচনা সম্ভব হতে পারে এবং রূপকথার মতো একান্ত কল্পনাভিত্তিক রচনাও যে জীবনের চিরন্তন সমস্যার বিষয় প্রকাশ করতে পারে। ‘বসন্তকুমারী’ নাটক তার প্রমাণ। এ নাটকের বিশেষ গুণ অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি। এই সুমহান এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গি ‘বসন্তকুমারী’ নাটকের অলংকার। এ নাটকের মধ্যে যে বৃত্তিগুলো প্রাধান্য লাভ করেছে, তা নরনারীর চিরন্তন হৃদয়বৃত্তি। নীচতা, স্বার্থপরতা, অতৃপ্ত জীবন তৃষ্ণা, রূপজমোহ, উদ্দাম লালসা, প্রবৃত্তির উন্মাদনা যা চিরদিন মানুষের জীবনে অনিবার্য ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করে।

বাংলার জমিদারদের অত্যাচারের এক জ্বলন্ত কাহিনি মীর মশাররফ হোসেনের বহুল পঠিত, আলোচিত ও নন্দিত নাটক ‘জমীদার দর্পণ’ (১৮৭৩) এ উচ্চকিত। জমিদারের অত্যাচারের ভয়ংকর স্বরূপ প্রকাশ করে খুব স্বল্প রচনাই প্রকাশ পেয়েছে। এ নাটকে লেখকের যে দুঃসাহসিক সত্য ভাষণের প্রয়াস, তা সত্যি বিস্ময়কর। লম্পট জমিদার হারওয়ান আলী উচ্ছৃঙ্খল, নারীলোলুপ। তার বাঘের থাবা নারী মাংসেই তৃপ্ত। দরিদ্র প্রজা আবু মোল্লার সুন্দরী যুবতী স্ত্রী নুরুন্নেহারের প্রতি তার লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। সহযোগীদের দিয়ে নুরুন্নেহারকে ধরে এনে তাকে ভোগ করে হত্যা করে। জমিদার অর্থ দ্বারা সাক্ষী বশ করে ফাঁসি হতে রেহাই পায়, আবু মোল্লা স্ত্রীশোকে উন্মাদ হয়ে গ্রাম ত্যাগ করে। অসাম্প্রদায়িক শিল্পী সাম্প্রদায়িকতার তর্ক এড়াতে জমিদার ও প্রজা উভয়ই মুসলমান সমাজ হতে গ্রহণ করেছেন। এ নাটক চরিত্রের বর্ণাঢ্য আয়োজনে সমৃদ্ধ। ভালো আর মন্দ, নিপীড়ক ও দলিত, ভণ্ডও বিদ্রোহী, স্বদেশি ও বিদেশি ইত্যাদি বিচিত্র মানব-মানবীর আনাগোনা ও কর্মকাণ্ডে নাটকটি ভরপুর। নৃশংস জমিদার, বিদ্রোহে আবু মোল্লা এবং সারল্যে নুরুন্নেহার চরিত্র সৃষ্টিতে শিল্পীর সমাজ বিশ্লেষণী দৃষ্টি পরিলক্ষিত হয়।

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে যে সমস্ত সামাজিক অনাচার সমাজ জীবনকে কলুষিত করে তুলেছিল মদ্যপান ও গণিকা-গমন তাদের অন্যতম। এদেশে প্রাচীনকাল থেকেই এর প্রভাব পরিরক্ষিত হলেও ইংরেজ আমলে তা প্রবল ও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এ অবস্থার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনের আগেই সাহিত্যে এর প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। পানাসক্তি ও লাম্পট্য দোষ নিয়ে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি অনেকগুলো নাটক প্রহসন রচিত হয়। এই ধারায় ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় মশাররফ হোসেনের প্রথম প্রহসন ‘এর উপায় কি?’ (১৮৭৫)। চার দৃশ্যের এ একাঙ্কিকা তথা প্রহসনটির পটভূমি উনবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজ। মদ্যাসক্ত ও বেশ্যাসক্ত পুরুষের অনাচার ও উচ্ছৃঙ্খলতার চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। প্রহসনটি রাধাকান্ত ও মুক্তকেশীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রাধাকান্ত বিত্তবান যুবক। সে গণিকাসেবী এবং মদ্যপ। তার এ চরিত্র সমকালীন বিত্তবানদের ঐতিহ্যসূত্রে প্রাপ্ত।

মুক্তকেশী তার স্বামীকে সুপথে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ, সে বান্ধবীর কৌশলকে ব্যবহার করেছে। মুক্তকেশী চরিত্রটি পুরুষের লাম্পট্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্র। মাঝেমাঝে মুক্তকেশীর কণ্ঠে যেন ভবিষ্যতের নারী মুক্তির ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে নয়নতারা বহুবল্লভা। বড়োদিনে একটি শাড়ি কিনে পাঁচ জনের কাছ থেকেই টাকা আদায় করে। নাম গো এনে নয়নতারা। তার মার বিয়ে হয়েছিল কিনা শোনেনি, বাবাকে সে দেখেনি, শঠতা-ছলনাই আর জীবন কেনার মা গোত্র কোলকাতার টালা অঞ্চলে পাথুরিয়া ঘাটার জমিদারের একখণ্ড জমিকে কেন্দ্র করে ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান যে দাঙ্গা হয় তারই বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত ‘টালা-অভিনয়’ (১৮৯৭) গ্রহসনা করে মতে মুসষ্টাব্দে হিন্দু-মুসলমান যে নির্মাণ করে মসজিদ হিসেবে চালানোর চেষ্টা চালায়। মামালা হয়, আদালতে মুসলমানের দাবি অগ্রাহ্য হয়। অতঃপর মহারাজার লোকের সাথে মুসলমানের দাঙ্গা। পুলিশের গুলিতে হাঙ্গামাকারিরা এগারজন নিহত হয়, আহত হয় কুড়ি জন। পুলিশ ৩৪জন আহত হয়ে হাসপাতালে যায়।

‘টালা-অভিনয়’ প্রহসনে লেখক হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়েরই ধর্মের মুখোশপরা কাণ্ডজ্ঞানহীন স্বার্থপর ব্যক্তিদের কটাক্ষপাত করেছেন। তাদেরই উস্কানি ও চক্রান্তে সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ছদ্মবেশী ইবলিশ মুন্সী এবং নারদ ঠাকুরের দল ধর্মের দোহাই দিয়ে ও ধোকাবাজির আশ্রয় নিয়ে নানা কৌশলে অশিক্ষিত সরল মানুষের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। টালা হাঙ্গামায় মুসলমানদের দায়িত্ব ছিল বেশি। গ্রহসনটিতে শিল্পীর নিরপেক্ষতার পরিচয় মেলে। হিন্দু-মুসলমানের মিলন কামনা করে লেখা প্রহসনটি সত্যি উল্লেখযোগ্য।

মশাররফ হোসেনের ‘রত্নাবতী’ আধুনিক মুসলমান সাহিত্যিকের রচিত প্রথম উপন্যাস। তাঁর ‘বসন্তকুমারী’ নাটক মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রথম বাংলা নাটক এবং তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ বাংলা ভাষার একটি শ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে স্বীকৃত। এছাড়া তিনি ‘আজীজন নেহার’ পত্রিকাও মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রকাশ করেন ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। এতসব প্রথম রচয়িতা বলেই তাঁকে মুসলমানদের অগ্রপথিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না; মূলত এটি একটি প্রবণতার বিষয়।

মশাররফ হোসেন মুসলিম সাহিত্য সমাজে অন্যতম প্রতিভাবান ব্যক্তি। তিনি লিখেছেন- কবিতা, উপাখ্যানধর্মী রচনা, উপন্যাস, নাটক, জীবন কাহিনী প্রভৃতি। ‘রত্নাবতী’র ভাষায় অন্যের ভাষার অপূরণ নেই। তৎসম শব্দের প্রয়োগের সাবধানতা নিঃসন্দেহে সমকালে প্রচলিত শ্রেষ্ঠ গদ্যকারদের প্রভাব ঘটেছে। কিন্তু পরবর্তীতে শিল্প-সাহিত্য যখন আত্মস্থ হয়েছে তখনই নিজস্ব স্টাইল ধরা পড়েছে। যেমন-

“মনের কথা অকপটে মুখে প্রকাশ করা বড়ই কঠিন। বিশেষ সংসারির পক্ষে নানা বিঘ্ন, নানাভর, এমনকি জীবনে সংশয়। সংসারে আমার স্বামী বসতি স্থান নই।”

এ ভাষা অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি তা বুঝতে অসুবিধা সন্দেহ নেই। মশাররফ হোসেনের শিল্পীচেতনা ছিল স্বভাবপুট; উচ্চশিক্ষা কিংবা দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের পরিমার্জনা এবং অনন্য স্বাতন্ত্র্যে তাঁর নিজস্ব স্টাইলটি পূর্ব বিকশিত হতে পারেনি, যেখানে তা সম্ভব হয়েছে সেখানে পল্লি বাংলার মাটির গন্ধ ভাষা এবং ভাবে পরিশ্রুত আকারে ধরা পড়েছে।

মশাররফ হোসেনের শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বিষাদ-সিন্ধু’। মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’র কাহিনি মহররমের ধর্মীয় আখ্যান অবলম্বনে মহাকাব্যিক ব্যপ্তিতে রচনা করেছেন। এটি প্রকাশের পর ‘ভারতী’ পত্রিকার সমালোচনায় বলা হয়েছিল ‘ইহা মহরমের একখানি উপন্যাস ইতিহাস’। বস্তুত ইসলাম ধর্ম কথাকে সর্বজনীন সাহিত্যরসে সঞ্জীবিত করেছিলেন শিল্পী; ভাবে ভাষায় ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ পরিচয় বহন করে। লেখক নিজে বলেন-

“শাস্ত্রানুসারে পাপ ভয়ে ও সমাজের দৃঢ় বন্ধনের বাধ্য হইয়া বিষাদসিন্ধুর মধ্যে কতকগুলি জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিতে হইল।”

এখন বুঝা যায় ইসলামের ধর্মকথা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করতে বসেও শিল্পী প্রাগ ইসলামিক আদর্শের বদলে নিখিল বাঙালির রসচেতনার প্রতিই অধিকতর আগ্রহী ছিলেন। আর সেই জন্যই বাংলা ভাষায় সাধারণভাবে অপ্রচলিত, অমুসলমান বাঙালির অজ্ঞাত ইসলামি ধর্মীয় শব্দ প্রয়োগেরও সাহিত্যিক কৈফিয়ত দিয়েছেন। কেবল বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের, বাংলা সাহিত্যে এই মাটির ভাব গন্ধভরা ভাষা শিল্পের স্বভাব রূপকার ছিলেন মশাররফ হোসেন। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর রসাবলি এই অদ্বিতীয় মূল্যে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

এ যুগের প্রাবন্ধিকরূপে মীর মশাররফ হোসেনও অবশ্য স্মরণীয়। তাঁর ‘গো-জীবন’ প্রবন্ধ বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে। গোলক্যাপ উপলক্ষ্য করে হিন্দু-মুসলমানে তখন ভারত জোড়া সাম্প্রদায়িক উত্তাপ প্রখর হয়ে ওঠেছে। মশাররফ হোসেন গো বধ রহিত করার পক্ষে এই গ্রন্থে অভিমত দিয়েছেন। আসল কথা ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করলেও যুক্তি, মানবিক মূল্যবোধ ও বিচার সাম্যের এক দুর্লভ পরিচয় সরল-সাবলীল ভাষায় দূত হয়েছে। এই প্রবন্ধে বাকভঙ্গি যেমন বলিষ্ঠ, স্থানে স্থানে তেমনি কটাক্ষপূর্ণ। নব বাঙালি জাতীয়তার জাগরণ চেতনা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিকশিত।

ধর্মনিরপেক্ষ এই মানবিক প্রীতির সচেতনতাবশেই মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের মুসলমান বাঙালির নবজাগরণের অগ্রদূত হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন। তাঁর আরো অনেক প্রবন্ধধর্মী রচনা নানা পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে আছে। বিষয়ের কথা বাদ দিলেও ভাষা ও মানসিক প্রবণতার মূল্যে ‘গো-জীবন’ প্রবন্ধে অন্যতম বিচার্য বিষয়। মশাররফ হোসেন জীবনী ও আত্মজীবনী ধর্ম কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলো হচ্ছে-

‘হজরত বেলালের জীবনী’ (১৯০৫), ‘হজরত ইউসোফ’ ধর্মমূলক মহাপুরুষ জীবন কথা। বারো খণ্ডে ‘আমার জীবনী’ (১৯০৮-১০) শিল্পীর নিজের জীবনী রচনা করেন।

বাংলা গদ্যের সাধু রূপটির শিল্পমূর্তি বিদ্যাসাগরের হাতের রচনা। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, সে ভাষা সংস্কৃত পণ্ডিত সমাজে প্রচলিত কথোপকথনের গদ্য কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে এমনকি বঙ্কিমের রচনাতেও সংস্কৃত তৎসম শব্দের আতিশয্য পরিপাটি রূপ পাওয়া যায়। ‘দুর্গেশনন্দিনীর’ প্রারম্ভিক ছত্রগুলো এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। রমেশচন্দ্র দত্তও এই ভাষার অনুকরণ করেছিলেন তাঁর উপন্যাসে। কিন্তু মশাররফ হোসেনের বাংলা গদ্য যেমন সরল, তা বাংলা গ্রামাঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ বাঙালির মুখের ভাষার কাঠামোর উপরে গড়া-তারই পরিমার্জিত লেখ্যরূপ। যেমন-

“গুজরাট নগরে রাজপুত্রের সহিত সেই রাজ্যের মন্ত্রিপুত্রের অভেদ্য প্রণয় ছিল। রাজপুত্রের নাম সুকুমার এবং মন্ত্রিপুত্রের নাম সুমন্ত। সুমন্ত বিদ্যাবুদ্ধিতে রাজ তনয় অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন। তাহারা বাল্যকালাবধি যৌবনকাল পর্যন্ত একত্র ভোজন, একত্র শয়ন এবং এক সঙ্গে ক্রীড়াদি করাতে বিশেষ আধিক্য জন্মিয়াছিল।”

সবশেষে বলা যায়, উপন্যাস- কথাকে অবলম্বন করেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্তের আভাস সঞ্চারিত হয়েছিল; বাংলা সাহিত্যে মুসলিম নবজাগরণের পথিকৃৎ মীর মশাররফ হোসেনের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ পরিচয় পেয়েছিল ‘কৌতুকাবহ উপন্যাস’ এটির নাম ‘রত্নবতী’। বস্তুত উপন্যাস লেখক হিসেবে মশাররফ হোসেনের যা কিছু স্মরণীয় তা ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’কে ঘিরেই। উপন্যাসের চেয়ে বরং নাটক এবং সর্বোপরি তিন পর্বে সম্পূর্ণ গদ্য মহাকাব্য ‘বিষাদসিন্ধু’ তাঁর সাহিত্যকীর্তির শ্রেষ্ঠ রচনা। তাহলেও শিল্পীর কাঁচা হাতের ঐ প্রথম কৌতুক রচনায় বাংলা সাহিত্যে মুসলমান মানসিকতার যে সম্ভাবনার উন্মোচন ঘটেছিল তা গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।