মীর মশাররফ হোসেনের রচনা বৈচিত্র্য যুগের জন্য নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতির এটি- একটি বড়ো কারণ। শুধু সংখ্যার দিক থেকে নয়, সাহিত্য গুণের দিক থেকেও অনেক রচনা তাকে স্মরণীয় করে রেখেছেন। মীর মশাররফ হোসেনের একই সাথে সমাজ সচেতনতা সুবিদিত। তাকে আমরা বলতে পারি, উনিশ শতকের বাংলাদেশ তথা হিন্দু ও মুসলমানের সমন্বিত প্রতিনিধি। সাহিত্যগুণের সাথে সাথে তাঁর সবকটি উৎকৃষ্ট রচনায় সমাজ চেতনা সুস্পষ্ট। সমাজকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে নিরীক্ষা করা এবং তাকে প্রকাশ করার মতো শিল্প প্রতিভা তাঁর ছিল। তাঁর ‘বিহাদ সিন্ধুর’ মতো অমর রচনা ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’, ‘আমার জীবনী’র মতো আত্মজৈবনিক রচনার মধ্যেও কিছুমাত্র অভাব ঘটেনি।
‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ মীর মশাররফ হোসেনের আত্মজীবনীমূলক রচনা। এতে রয়েছে সর্বমোট ৪২টি বা তরঙ্গ পরিচ্ছেদ। নীলকর কর্তৃক শোষিত ও অত্যাচারিত গ্রামবাংলার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে এ গ্রন্থে। গ্রন্থটিতে পাশাপাশি দুটি কাহিনি বহমান। একটি কাহিনিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে শালঘর মধুয়ার নীল কুঠিয়াল টি, আই কেনী সাহেবের অত্যাচার। তার অত্যাচারে জর্জরিত অসহায় দরিদ্র চাষিদের চিত্র এবং তাদের পক্ষাবলম্বন করে জমিদার প্যারীসুন্দরীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। অপর কাহিনিতে উপস্থিত হয়েছে মীর পরিবারের বিশেষত মশাররফ হোসেনের পিতা মোয়াজ্জম হোসেন ও তার মাতা দৌলতন নেসার সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা বিজড়িত জীবনের বর্ণনা দুটি কাহিনির ধারা কখনো পরস্পর সংলগ্ন আবার কখনো বিচ্ছিন্ন।
উদাসীন পথিকের মনের কথায় নীলকর কেনীকে মীর মশাররফ হোসেন প্রবঞ্চকরূপে অঙ্কন করেছেন। কিন্তু ইংরেজ শাসনের সাথে কেনীকে তিনি কখনো একাত্ম করেননি। ইংরেজ কমিশনার ও বড়লাট যে নীলকরদের অত্যাচার দমনে দেশের শান্তি বিধানে তৎপর ছিলেন, তার সপ্রশংস বর্ণনা এ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। নীল আন্দোলনকে তিনি দেখেছিলেন কয়েকজন দুষ্কৃতকারী নীলকরের কার্যাবলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে। ইংরেজদের শাসন ও শোষণের সাথে যে তার প্রত্যক্ষ যোগসূত্র বিদ্যমান তা তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতাই হয়ত এজন্য দায়ী। তাই নীলকরদের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেও ইংরেজ শাসনব্যবস্থার মাহাত্ম্য প্রচার করেছেন তিনি। ইংরেজ শাসনের মাহাত্ম্য কীর্তনের পাশাপাশি মাতৃভূমিকে যথার্থ ভালোবাসার প্রেরণাটিও এতে বর্ণিত হয়েছে।
উদাসীন পথিকের মনের কথায় নীলকর আন্দোলনের চিত্রাঙ্গন করতে গিয়ে লেখক কিছুটা মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছেন। নীলকরদের হাতে নিপীড়িত প্রজাদের চিত্রাঙ্কনই ছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু ঘটনা চক্রে তাদের পারিবারিক শত্রু সাগোলাম নিপীড়িত প্রজাসাধারণের পক্ষাবলম্বন করেন ও নেতৃত্ব দেন। এক্ষেত্রে লেখক কিছুটা দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হন। মীর মশাররফের পিতা মোয়াজ্জম হোসেন কেনীর বিশিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তবুও এ গ্রন্থে কেনীকে প্রবঞ্চক হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইংরেজ শাসনের সাথে কেনীকে তিনি কখনো একাত্ম করেননি। নীলকরদের অত্যাচার নিরোধ এবং দেশের শাস্তি বিধানে যে ইংরেজরা তৎপর ছিলেন তার বিস্তৃত ও সপ্রশংস বর্ণনা এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক।
ভারতবর্ষে ইংরেজরা তাদের শাসন শোষণকে চিরস্থায়ী করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদার মহাজন শ্রেণিকে তাদের প্রধান মিত্ররূপে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেছেন। এ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তই ভারতের বিশেষকরে বাংলার জন্য চিরস্থায়ী অভিশাপ বয়ে এনেছিল। কৃষকদের শোষণ ও নির্যাতনের জন্য জমিদার মহাজনরাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। এ জমিদাররাই টাকার লোভে নীলকরদের কাছে জমি বিক্রয় করে এদেশে নীলকরদের ঘাঁটি স্থাপনে সহায়তা করেছিল। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথায়’ কৃষকদের লাঞ্ছনার কাহিনি বর্ণিত হলেও মূলত জমিদার প্যারীসুন্দরীর আন্দোলন এবং আক্ষেপের কথাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে। প্যারীসুন্দরী একজন ছোটো জমিদার। মীর মশাররফ হোসেন তাকে চিত্রিত করেছেন একজন প্রজাবৎসল জমিদাররূপে। ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাথে এ চরিত্র একেবারেই সঙ্গতিহীন। হাজার জমিদারদের মধ্যে একজন প্যারীসুন্দরী পাওয়া গেলেও যেতে পারে। কিন্তু জমিদার ও কৃষকের পারস্পরিক সম্বন্ধে চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ মীর মশাররফ হোসেনের অন্যতম আত্মজীবনীমূলক রচনা। লেখকের কর্মস্থল দেলদুয়ারের তিক্ত অভিজ্ঞতা ‘বস্তানী’ রচনার প্রধান উৎস বলে ধরে নেওয়া যায়। গ্রন্থে বর্ণিত ‘যমদ্বার’ হলো দেলদুয়ার আর পয়জারন্নেসার হলেন করিমুন্নেসা চৌধুরানী। মশাররফ হোসেন এর অধীনে দেলদুয়ার এ স্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। সুতরাং, স্পষ্টই প্রতীয়মান হয়, এ গ্রন্থের কাহিনি ও ঘটনাংশের পটভূমি দেলদুয়ার এ স্টেট এবং এর বর্ণিত সমাজ হিন্দু- মুসলমানের মিশ্র সমাজ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশের তথাকথিত জমিদার সমাজে যতদূর নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক দুর্নীতি প্রবেশ করেছে তা ‘গাজী মিয়ার বস্তানীতে’ লেখক উপস্থাপন করেছেন। এ গ্রন্থে অঙ্কিত হয়েছে এক বিধবা জমিদারের আমলা কর্মচারীদের জাল জুয়াচুরির চিত্র, একজন অত্যাচারী জমিদারের পরস্ত্রী অপহরণের কাহিনি, মামলা মোকদ্দমায় হাকিম উকিলদের পক্ষপাতিত্ব, বিপদের দিনে বন্ধুর চরম বিশ্বাসঘাতকতা, পুলিশ, জেলে কর্মচারী জেল ডাক্তার ও দারোগাদের মধ্যে অসাধু উপায়ে অর্থোপার্জন, মানুষে মানুষে বিশ্বাসহীনতা ইত্যাদি।
তৎকালীন মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার বাস্তব চিত্রটিও লেখক সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। যেমন- “মুসলমান রমণীর মধ্যে বিদ্যাচর্চাও শিখিবার সুপ্রশস্ত পথ নাই, জ্ঞানলাভের কোন উপায় নাই। ভালোমন্দ বিবেচনা করিবার শক্তি নাই, সংসার ক্ষেত্রে বিচরণ করিবার বুদ্ধি নাই।…… প্রথম বয়সে খেলাধুলা, তাহার পর বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এক প্রকার বন্দিনী। কিছু বেশি বয়স হইলে অবিবাহিতা অবস্থায় জন্মদাতা পিতার সহিত দেখা পর্যন্ত হয় না…… এ প্রথা অদ্র সমাজেই প্রচলিত।” [একাদশ নথি]
এ গ্রন্থে মীর মশাররফ হোসেন হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ যেমন তুলে ধরেছেন, ঠিক তেমনি ইংরেজদের জয়গানও গেয়েছেন। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ চিত্রায়ণের পাশাপাশি ইংরেজদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, মাহাত্ম্য বর্ণনার সাথে সাথে আইন ব্যবস্থার দৈন্যদশার সমালোচনাও করেছেন তিনি। “মনি বিবির পক্ষের লোকেরা পুলিশের সম্মুখে দিনে দুপুরে ডাকাতি করিল। পুলিশ নিবারণ করা দূরে থাকুক, চক্ষেই যেন দৃষ্টি হইল না, কথাও সরিল না। ধন্য বিচার, ধন্য শান্তি রক্ষা, ধন্য রে পুলিশ, ধন্য হাকিমের হুকুম।”
গাজী মিয়ার বস্তানীতে লেখক সমাজব্যবস্থার চিত্রাঙ্কনে একেবারে নির্মোহ হতে পারেননি। এতদপ্রসঙ্গে মুনীর চৌধুরী বলেছেন, “গাজী মিয়া জগৎকে বর্ণনা করেছেন সমাজ সচেতন মহৎ শিল্পীর নিরপেক্ষ বেদনাবোধ নিয়ে নয়।” গাজী মিয়া ব্যক্তিগত কারণে যার বিরুদ্ধে যত বেশি উত্তেজিত হয়েছেন, ‘বস্তানীর মধ্যে তাকে তত বেশি কদর্য করে এঁকেছেন। (তিনি) বলবান ও আবেগপ্রবণ আহত পুরুষ। একবার রোষে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলে বাণীকে শিল্পকলার নিজস্ব নিয়মে নিয়ন্ত্রিত করার আবশ্যকতা আদৌ গ্রাহ্য করেন না।” [মীর মানস]
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায়, মীর মশাররফ হোসেন ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ এবং ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’তে তাঁর সমকালীন সমাজব্যবস্থার চালচিত্র অঙ্কন করেছেন। এ চিত্রাঙ্কনে লেখক যে সর্বত্র নির্মোহ ও নিরাসক্ত থাকতে পেরেছেন, তা হয়ত নয়। তবুও যা কিছু আমরা এ দুটি গ্রন্থে প্রাপ্ত হয়েছি, তা একেবারে অকিঞ্চিৎকর নয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment