বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব ও বিকাশ এবং তার স্রষ্টা সম্পর্কে কবিদের কথা এখানে অপরিহার্যভাবে এসে পড়ে। সাধারণ বিশ্বাস, পাশ্চত্য গীতিকাব্যের প্রভাবেই বাংলা গীতিকবিতার সূচনা হয়। এই মত কত শতাংশে সত্য হলেও, সবটাই তা কিন্তু নয়।
পাশ্চাত্য গীতিকাব্যের প্রভাবের সঙ্গে দেশীয় সাহিত্যের এই দিকগুলিকে স্বীকার না করলে ইতিহাসকেও অস্বীকার করা হবে। মাইকেল মহাকাব্যের ধারার সূচনা করলেও সেই মহাকাব্যের মধ্যেই কোথাও কোথাও গীতিকবিতার আভাস ছিল। পরে আত্মভাবমূখ্য সনেট –‘আত্মবিলাপ’, ‘বলগভূমির প্রতি’ এবং কবিতার মাধ্যমে তিনি গীতিকাব্যের পূর্ণ প্রবর্তন করেন।
বিহারীলাল চক্রবর্তীই বাংলা গীতিকবিতার বিশিষ্ট সুরটিকে প্রথম অনুধাবন করেন। রবীন্দ্রনাথ এই জন্যেই তাকে ‘ভোরের পাখি’ বলেছেন।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন এঁরা হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের কবি। শ্রেষ্ঠ গীতিকবি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ।
এই যুগের অপর বিশেষত্ব হল, বাঙালি মহিলা কবিদলের গীতিকবিতা রচনা। গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, মানকুমারী বসু, বিনয়কুমার ধর, কামিনী রায় প্রমুখের নাম এবিষয়ে উল্লেখযোগ্য। গার্হস্থ্য জীবনকেই এই মহিলা কবিদল বিশেষভাবে গ্রহণ করেছিলেন।
পুরুষ কবিগণ নিসর্গ জগৎ এবং রোমান্টিক জগৎকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করে বিচিত্র বিষয়ের গীতিকবিতা রচনা করতে থাকেন। ফলে বাংলা গীতিকবিতা বিশেষ উন্নত ও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। গীতিকবিতার সঙ্গে বাঙালির গানও উল্লেখযোগ্য।
অন্যান্য কবিরাও তখন নানা ভাবের গান লিখেছেন এবং সেগুলিও কাব্যগত দিকটিও ছিল সবিশেষ সমৃদ্ধ। এই কাব্যের দিকটির কথা মনে রেখেই এইসব গানকে বলা হত—’কাব্যগীতি’।
বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গীতিকাব্য অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করে। বাংলা নাট্যসাহিত্যকে আশ্রয় করেও গান-গীতিকবিতার বিকাশ ঘটেছে। বাংলা গীতিকবিতার পরিণতির দুটি দিকে : এক, গদ্যকবিতায়; দুই কাব্যনাট্যে। দুটি ক্ষেত্রেই বাঙালি কবিরা উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
গীতিকবিতার ইতিহাস :-
উনিশ শতকে এদেশে যে নবজাগরণের সূত্রপাত হয়েছিল তা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। কাব্যের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন কাহিনিকাব্য ও গীতিকবিতার বিকাশে সহায়ক হয়েছিল। দুটি ধারা পাশাপাশি চললেও গীতিকবিতার ধারাটি অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। কাহিনিকাব্য রচনার প্রবণতা বিলুপ্ত হয়েছে।
আধুনিক বিশ্বের চাঞ্চল্যে প্রভাবিত কবিরা গীতিকবিতার মধ্যেই প্রতিভা বিকাশের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেছেন। আধুনিক কালে গীতিকবিতা উপজীব্য বিষয়ের বৈচিত্র্যে বর্ণাঢ্য হয়ে উঠেছে। আধুনিক মানুষের জীবনের নানা রকম দিক, মনো জগতের নানা রকম ভাবনা অবলম্বনে গীতিকবিতা তৈরি হয় বলে এতে অন্তহীন বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিষয় বৈচিত্র্যের হাত ধরেই বৈচিত্র্য এসেছে আঙ্গিকে, ভাষা ব্যবহারে ক্ষেত্রে, রূপ-ছন্দে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে।
গীতিকবিতা কি ও কাকে বলে :-
রবীন্দ্রনাথ গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন যে –
‘একটু খানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ’
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর গীতিকাব্যা নামক প্রবন্ধে গীতিকবিতা সম্পর্কে বলেছেন-
“বক্তার ভাব উচ্ছাসের পরিস্ফুটন মাত্র যার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।”
R. J. Rees-এর কথায় গীতিকবিতা—
‘the poems in question are reasonably short, and have a definite unity of thought and feeling’
ইংরেজ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন –
“Poetry is the spontaneous overflow of powerful feelings, it takes its origin from emotion recollected in tranquility.”
অন্যদিকে পি. বি. শেলি বলেছেন-
“Poetry is indeed something divine”
গীতিকবিতা কয় প্রকার ও কি কি :-
গীতিকবিতা কয় প্রকার এই প্রশ্নের উত্তর অনেক রকম ভাবে দিয়েছে। তবে যেই দিকদিয়ে গীতিকবিতার শ্রেনীবিভাগ করা হোক না কেন তা নিন্মোক্ত গীতিকবিতার অন্তর্ভুক্ত হবে।
১ – ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-
নাম থেকেই বোঝা যায়, ভাবকেন্দ্রিক গীতিকবিতা (Subjective Poetry) হল সেই ধরনের গীতিকবিতা, যা কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ভাবানুভুতিকে ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ বিষয়ের চেয়ে বিষয়ী যেখানে বড় বস্তুর চেয়ে বস্তুকে (বিষয়কে) আশ্রয় করে গড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিগত ভাবনাই যেখানে প্রধান হয়ে উঠে। এই ধরনের গীতিকবিতা হল :
i) আত্মচিন্তামূলক (Reflective) গীতিকবিতা।
ii) ভক্তিভাবমূলক (Devotional) গীতিকবিতা ।
iii) স্বদেশপ্রেমমূলক (Patriotic) গীতিকবিতা।
iv) প্রকৃতি বা নিসর্গকে আশ্রয় করে রচিত গীতিকবিতা।
v) প্রেমমূলক গীতিকবিতা।
vi) শোককাব্য (Elegy)।
২ – রূপকেন্দ্রিক গীতিকবিতা :-
কেবল ভাবকে ভিত্তি করে যেমন গীতিকবিতার শ্রেণীবিভাগ করা যায়, তেমনি রূপ বা Form কেও ভিত্তি করে এই বিভাগ করা যায়।
i) ‘ওড’ (Ode) কবিতা।
ii) সনেট কবিতা।
গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য :-
নিন্মে গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করা হলো –
১ – ভাবগত বৈশিষ্ট্য :
গীতিকবিতা নির্জন এককের গান। একলা কবির ব্যক্তি অনুভূতির চিত্রলিপি গীতিকবিতা। কবি নিজেকে উন্মুক্ত করে দেন এখানে। হৃদয়ের উৎসমুখ থেকে বাণী নিঃসৃত হয়। কবির হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা, হতাশা-আক্রোশ, অভিমান – অভিযোগ, ক্ষোভ-ঘৃণা, চাওয়া-পাওয়া না পাওয়া- সবকিছু শব্দের অক্ষরে ছন্দোবদ্ধ হয় গীতিকবিতায়।
২ – অঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্য :
গীতিকবিতা হবে সংহত, সংযত। অল্প একটুর মধ্যে বৃহতের ইশারা ধ্বনিত হবে। কবিতা হবে সংগীতধর্মী। প্রাচীনকালে Lyre বা বীনাজাতীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন Lyric এর সঙ্গী ছিল। তেমনি আজও গীতিকবিতার অন্তরে একটা সুর ধ্বনিত হয়। আখ্যানকাব্য বা মহাকাব্যের মতো বৃহদায়তন তো নয়ই, এমনকী আদি-মধ্য-অন্ত্য বিশিষ্ট হবে না।
অন্য ভাবে বললে উপরোক্ত গীতিকবিতার বৈশিষ্ট্য সমূহ ছাড়াও আরো কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
১ – কবির হৃদয়ের একান্ত ব্যক্তিগত ভাব আবেগের প্রকাশ হলো গীতিকবিতা।
২ – গীতিকবিতার একক আত্মমগ্ন অনুভবের তীব্রতা, সংবেদনশীল ভাষা ও সুরের অন্তর্লীন স্পর্শ পাঠক চিত্তকে অভিভূত করে। অর্থাৎ কবি ও পাঠকের নিবিড় রস সংযোগই গীতিকবিতার প্রধান আকর্ষণ।
৩ – কবির ব্যক্তিগত অনুভূতি ও সংবেদনের মন্ময়তা সত্ত্বেও গীতি কবিতার এক সর্বজনীন আবেদন ও মূল্য থাকে।
8 – গীতিকবিতা যতটা আবেগ অনুভূতি মূলক, সাধারণ ভাবে ততটা চিন্তা মূলক নয়।
৫ – সংহত ও সংক্ষিপ্ত অবয়ব বিন্যাসে সার্থক গীতিকবিতা শব্দ-ছন্দ-সুর-তান-ব্যঞ্জনায় এক সুসমন্বিত শিল্পরূপ। প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ প্রীতি, ধর্মীয় বা ভক্তিমূলক ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়েই গীতিকবিতা রচিত হতে পারে।
এই ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান আলোচনা করো।
বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যচর্চা– আধুনিক বাংলা কাব্যের প্রথম গীতিকবি হলেন ‘ভোরের পাখি’ বিহারীলাল চক্রবর্তী। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল– ‘সংগীত শতক’(1862), ‘বঙ্গসুন্দরী’(1870), ‘নিসর্গসন্দর্শন’(1870), ‘বন্ধুবিয়োগ’(1870), ‘প্রেমকাহিনী’(1871), ‘সারদামঙ্গল’(1879), ‘সাধের আসন’(1889)। ‘সংগীত শতক’ কাব্যে কবি তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবনের অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য ভাবনা অস্ফুটভাবে প্রকাশ করেছেন। বিহারীলাল ‘নিসর্গসন্দর্শন’ কাব্যের কবিতাগুলিতে নিসর্গ প্রকৃতিতে ব্যক্তিসত্ত্বা আরোপ করে সচেতন কবি হৃদয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে নবতম কাব্যশৈলীর উদ্ভাবন ঘটিয়েছেন, তা গীতিকবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জননী-জায়া-কন্যা-ভগিনি– প্রভৃতি বিবিধ মূর্তিধারিণী নারীর স্নেহ-মায়া-মমতায় রূপ এ সৌন্দর্যের সন্ধান করেছেন কবি ‘বঙ্গসুন্দরী’ কাব্যে। কবি নিজের এবং বন্ধুবর্গের জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এবং নিজের প্রেমানুভূতিকে কাব্যাকারে রূপদান করেছেন তাঁর ‘বন্ধুবিয়োগ’ ও ‘প্রেমকাহিনী’ কাব্যদুটিতে। তবে বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘সারদামঙ্গল’, যেখানে কবির সৌন্দর্যচেতনা, গীতিবৈশিষ্ট্য পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথের নতুন বউঠান কাদম্বরীর অনুরোধে কবি বিহারীলাল ‘সাধের আসন’ কাব্যটি রচনা করেন। এখানে কবি সৌন্দর্যতত্ত্বের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা করেছেন।
Leave a comment