মন্ময়, আত্মনিষ্ঠ বা গীতিকবিতা (সাবজেকটিভ পয়েট্রি) এক ধরনের ব্যক্তনিষ্ঠ বা আত্মনিষ্ঠ কবিতা। কবির একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি বা ভাব কল্পনা যখন ব্যঞ্জনা রসে সুষমামণ্ডিত হয়ে সহজ ও সাবলীল ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে তখনই গীতি কবিতার জন্ম হয়। এই গীতি কবিতার সাধারণ অর্থ গান ও কবিতার সংমিশ্রণ। ইংরেজি সাহিত্যে গীতি কবিতাকে Lyric বলে।
Lyric বা সংগীতমূলক কবিতাগুলো বীণা যন্ত্রের সাহায্যে গীত হতো বলে একে গীতিকবিতা বলে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়, “বক্তার ভাবোউচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য তাহাই গীতি কবিতা।”
মোহিতলাল মজুমদারের মতে, “যা আমরি অবস্থা, অথচ স্পষ্টগোচর নয়, যে বেদনা ব্যাকুল অথচ স্পষ্ট হয়ে ওঠেনা যে সৌন্দর্যের আভাস পায় অথচ দেখেও দেখিনা-মানুষের সেই আত্মগত গূঢ়বাসনা এইরূপ অন্তসন্ধানী কবির কল্পনায় জাজ্বল্যমান হয়ে ওঠে।”
S. T. Colreidge এর ভাষায়, “Ballad turns upon a single thought and situation.”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মতে, “যাহোক আমরা গীতিকবিতা বলে থাকি: অর্থাৎ যা একটুখানির মধ্যে একটি মাত্র ভাবের বিকাশ, ঐ যেমন বিদ্যাপতি-
“ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।”
যে কবিতায় কবির আত্মানুভূতি বা একান্ত ব্যক্তিগত কামনা-বাসনা ও আনন্দ-বেদনা তার প্রাণের অন্তস্তল হতে আবেগ কম্পিত সুরে অখণ্ড ভাবমূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করে তাকেই গীতিকবিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এই গীতি কবিতায় পরিপূর্ণ মানব জীবনের ইঙ্গিত নেই, এখানে একক ব্যক্তিত্বের একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি আনন্দ-বেদনায় পরিপূর্ণ। কবি হৃদয় এখানে আত্মবিমুগ্ধ, তাই সমগ্র কবিতা জুড়ে কবি হৃদয়ে প্রাণের স্পন্দন প্রকাশিত হয়। যেমন-
“হায়, ওরে মানব হৃদয়
বারবার কারো পানে ফিরে চাহিবার
নাইযে সময়
নাই নাই।” [রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
বাংলা সাহিত্যে সার্থক গীতিকবিতার অভাব নেই। বাংলাদেশের জল-হাওয়ার মধ্যে, এর মাটিতে এমন একটি কোমলতা ও সুরের আবেশ আছে যাতে রামায়ণ মহাভারত হতে আরম্ভ চর্যাপদের কূল ছুঁয়ে বৈষ্ণব পদাবলীর তীর ছুঁয়ে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা স্পর্শ করে, মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কােেব্য’র শরীর জুড়ে বিহারীলাল চক্রবর্তীর হাতে পূর্ণতা পেয়ে আধুনিক গীতিকবিদের হাতে তাঁর সার্থক পদযাত্রা অব্যাহত আছে।
আধুনিক কালের অনেক উৎকৃষ্ট গীতিকবিতা শুধু একতারার একটি গান বা কবির আত্মগত ভাব কল্পনার প্রকাশ মাত্র নয়। কবি এর মধ্যে কখনো নাটকীয়তা, কখনো মহাকাব্যোচিত ব্যঞ্জনার সঞ্চার করেন।
উপরিউক্ত বিভিন্ন আলোচনার প্রেক্ষিতে গীতি কবিতার যে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধ্বনিত বা প্রতিধ্বনিত তা নিচে উপস্থাপনা করা হলো:
১. গীতিকবিতা মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ কবিতা।
২. ভাবের বৈচিত্র্য গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কবি হৃদয়ে বিচিত্র ভাব-ভাবনা গীতি কবিতায় প্রকাশমান।
৩. গীতিকাব্যের কবিরা বহির্মুখী নয়, অন্তর্মুখী-এজন্য গীতি কবিতাতেই সাধারণত ব্যক্তি হৃদয়ে ভাবোচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে।
৪. গীতিকবিতায় ছন্দের বিচিত্রতম প্রকাশ ঘটে।
৫. হৃদয়ের অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলে তা অবলম্বন করে লেখা গীতিকবিতা দীর্ঘ হয় না।
৬. গীতিকবিতায় কবি চরিত্রে নমনীয়তা, কমনীয়তা ও দৃঢ়তা প্রতিফলিত হয়।
৭. বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী গীতিকবিতার এক অনন্য দলিল। যেমন-
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে গুণে মন ভোর।
প্রতি অঙ্গ লাগি-কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর-কান্দে।
পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বান্দে।”
৮. আধুনিক গীতি কবিতায় মানুষের বাস্তব জীবন ও সমাজের চিত্র যথাযথ ভাবে ফুটে ওঠে।
৯. আন্তরিকতাপূর্ণ অনুভূতি, অবয়বের স্বল্পতা, সংগীত মাধুর্য, গতি স্বাচ্ছন্দ্য গীতিকবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
১০. ভাব বা বিষয়বস্তুর দিক থেকে গীতিকবিতাকে ভক্তিমূলক, স্বদেশপ্রীতিমূলক, প্রেমমূলক, প্রকৃতি বিষয়ক, সনেট স্তোত্র কবিতা, চিন্তামূলক, শোক গীতি, কাহিনিমূলক ও লঘু বৈঠকী বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়।
গীতি কবিতা সৃষ্টিলগ্ন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বৈচিত্র্য বিহারী। কবি হৃদয়ে সূক্ষ্মতম অনুভূতির সূক্ষ্মতম প্রকাশ ঘটে গীতি কবিতায়। গীতি কবিতা অনুভূতির প্রকাশ বলে তা সাধারণত দীর্ঘকায় হয়না। কারণ কোন অনুভূতিই দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। কিন্তু কোন কবি যদি গীতিকবিতায় তার ব্যক্তি অনুভূতিকে আন্তরিকতার সাথে অনায়াসে দীর্ঘকারে বর্ণনা করতে পারেন-তবে তার মূল রস ক্ষুন্ন হয় না। অর্থাৎ কবির আন্তরিকতাই শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতার একমাত্র কষ্টিপাথর।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment