পাট রচনা – বাংলাদেশের সোনালী আঁশ
ভূমিকা
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। বাংলাদেশের পরিচিতি কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে সমগ্র
বিশ্বব্যাপী রয়েছে। অনেক ধরনের কৃষি জাত পণ্য এদেশে উৎপন্ন হয়। পাট এর
মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রধান অর্থকারী ফসল হলো পাট। এই পৃথিবীতে যত পাট
উৎপন্ন হয় তার প্রায় শতকরা ৭৫ ভাগ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তাই বাংলাদেশের
উৎপাদিত পাট ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
তাই পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পথকে সুগম
করেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের পাট বাংলাদেশ উৎপন্ন হয়। বিশ্ববাজারে
বাংলাদেশের পাটের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
পাটের আকৃতি
পাট এক ধরনের তৃণজাত উদ্ভিদ।পাট সাধারণত ৭ থেকে ৮ হাত লম্বা হয়। কখনো কখনো আবার
এটি দশ হাত পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তবে পাট গাছ আধা ইঞ্চি বা কখনো এক ইঞ্চি
পর্যন্ত মোটা হয়ে থাকে। পাট গাছের তেমন ডালপালা হয় না বললে চলে। পাট গাছের
মাথায় থাকে এক গুচ্ছ সবুজ পাতা আর পাট গাছ সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পাট
গাছ সাধারণত সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। তবে অনেক সময় এটি লাল বা খয়রি বর্ণের ও
হয়ে থাকে।
পাটের প্রকারভেদ
আমাদের দেশে সাধারণত তিন ধরনের পার্ট জন্মে যথা-
সুতিপাট
বোগিপাট ও
মেস্তা পাট
সুতি পাট
সুতি পাট জলাশয়ে বা নিম্ন জমিতে ভালো জন্মে। আর সুতি পাটের আঁশ বেশ মোটা হয়।
বোগিপাট
বোগিপাট উঁচু জমিতে ভালো হয় আর এ পার্টের আঁশ মসৃণ ও শক্ত হয়।
মেস্তা পাঠ
মেস্তা পাঠ উঁচু জমিতে ভালো হয় তবে এ পাট মসৃণ কিন্তু শক্ত নয়।
পাটের উৎপত্তি স্থান
পাট চাষের জন্য যেকোনো মাটি ও জলবায়ু উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ু
প্রবাহিত হয় আর মৌসুমীর বায়ুর কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। আর এই
জলবায়ু পাট চাষের জন্য বেশ উপযোগী। পাট উৎপাদনের জন্য উষ্ণ আদ্র জলবায়ু
প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে পাট উৎপন্ন হয় তবে রংপুর, রাজশাহী,
ময়মনসিং, টাঙ্গাইল, জামালপুর ,নোয়াখালী, কুমিল্লা, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলায়
প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপাদন হয়।
তবে সব চেয়ে উৎকৃষ্ট মানের পাট জন্মে ময়মনসিংহ জেলায়। বাংলাদেশে পাট উৎপন্ন
হয় প্রায় ৬০ লক্ষ বিঘা জমিতে। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের আসাম, তামিলনাড়ু, বিহার,
উড়িষ্যা জেলায় পাট উৎপন্ন হয়। বর্তমান আমেরিকা, মিশর, চীন ও থাইল্যান্ডে কিছু
কিছু পাট উৎপন্ন হচ্ছে। ভারতে কিছু পরিমাণ পাট উৎপাদন হয় তবে পরিমাণে তা
সামান্য। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ কোটি মন পাট উৎপন্ন হয়।
পাট চাষ পদ্ধতি
পাট চাষ অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার এবং ব্যয় বহুল ও বটে। জমি উত্তমরূপে চাষ করে সার
প্রয়োগ করে তারপর বীজ বপন করতে হয়। বাংলাদেশে সাধারণত ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে
পাটের বীজ বপন করা হয়। উষ্ণ জলবায়ু আর বৃষ্টিপাত পাট চাষের জন্য উপযোগী।
যেসব জমি পানিতে প্লাবিত হয় এবং জমিতে চাষের জন্য এইসব জমি উপযুক্ত। দোআঁস
মাটিতে পাট চাষ অনেক ভালো হয়। পাটের বীজ বপন করার আগে জমিতে ভালো মতো চাষ দিয়ে
মাটি মই দিয়ে সমান করে দিতে হয়।
এরপর মাটিতে সার দিয়ে তারপর বীজ বপন করতে হয়। মাটি উর্বর হলে কয়েকদিনের মধ্যে
চারা বের হয় এবং গাছগুলো ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে। লাল রংয়ের বোগি পার্ট উঁচু
জমিতে ভালো হয়। পাটের জমিতে রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈব সার দিলে পাট গাছ
তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে। বৃষ্টির পানি পেলে পাটগাছ দ্রুত বেড়ে উঠে তবে পাটের ভালো
ফলন পেতে অতিবৃষ্টি এবং অতি খরা দুটোই মারাত্মক।
পাট গাছ একটু বড় হলে আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয়। এভাবে বেশ কয়েকবার আগাছা
পরিষ্কার করে দিতে হয়। পাট গাছ ঘন হলে ভালো ফলনের জন্য কিছু চারা তুলে
ফেলতে হয় এতে পাটের উৎপাদন ভালো হয়। পাটের চারা পাতলা থাকলে গাছ দ্রুত বাড়ে
এবং মোটা হয়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাস পাট কাটার সময়। পাট গাছ কেটে ছোট ছোট আঁটি
আকারে বেঁধে জমিতে রাখতে হয়।
তাহলে দু-একদিনের মধ্যেই পাটের পাতা গুলো জমিতে ঝরে পড়ে যায়। আর পাটের পাতা
জমিতে জৈব সারের কাজ করে থাকে। এরপর পাটগাছ গুলো পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হয় আর
পানিতে পাট গাছ ডুবিয়ে রাখাকে বলা হয় পাট জাগ দেওয়া। এই পাট গাছগুলো পানিতে
সঠিকভাবে পচার জন্য এর উপর কিছু ইউরিয়াসার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
মোটামুটি ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে পার্ট গাছ গুলো পচে যায় এবং পাটের আঁস
ছাড়ানোর উপযুক্ত সময় হয়। এরপর পাটের আঁস গুলো পাট গাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে
পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে শুকাতে হয়। আর এই শুকনো পাটকে সোনালী আঁশ বলা হয়।
পাটের আশ গুলো ভালো মতো শুকিয়ে গেলে গাট বাধা হয় এবং এগুলো বিক্রির জন্য
প্রস্তুত হয়। পাটের আঁশ ছাড়ানোর পরে পাটগাছ থেকে যে কাঠি বের হয় তাকে পাটকাঠি
বলে। এই পাটকাঠি গুলো জ্বালানি, ঘর তৈরি, কাগজের মন্ড, পার্টিকেল বোর্ড তৈরি সহ
নানা কাজে ব্যবহার করা হয়।
পাটের প্রয়োজনীয়তা/পাটের ব্যবহার
পাট বাংলাদেশের একটি অতিপ্রয়োজনীয় সম্পদ। পাটের উপকারিতা কথা বলে শেষ করা যাবে
না। কারণ পাট বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। পাট থেকে দড়ি, কার্পেট,
বস্তা, ব্যাগ প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করা হয়। গৃহস্থের ঘর বানাতে,
গরু চরাতে, জিনিসপত্র বানাতে পাটের প্রয়োজনীয়তা অনিসকার্য।
উৎকৃষ্ট মানের পার্টগুলো যেমন লম্বা হয় তেমনি সুক্ষ এবং রেশমের মতো উজ্জ্বল হয়।
থাইল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশে পাট থেকে বস্ত্র তৈরি করা হয়। পাটের সবচেয়ে
চাহিদা বেড়ে যায় যুদ্ধের সময় কারণ বোমারু বিমান থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বালির
বস্তার প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়ে থাকে আর এই কাজে কোটি কোটি টাকার পাটের বস্তা
প্রয়োজন হয়।
পাট দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়ে থাকে। পাট কাঠি জ্বালানি
হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের গবেষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৯৪ সালে
অন্যতম মানের কাগজের মন্ডপ প্রস্তুত করা হয় সবুজ কাঁচা পাট থেকে। পাটের বহুমুখী
ব্যবহারে ফলে বাংলাদেশের কৃষি ও পাট জাত শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে এক চমৎকার
সম্ভাবনাময়।
বাংলাদেশের পাট শিল্পের ইতিহাস
পাট শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সোনালী ঐতিহ্য। এক সময় পাট বাংলাদেশের প্রধান
চালিকাশক্তি ছিল। বাংলাদেশ যত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত তার শতকরা ৯০ ভাগ আসত পাট
থেকে। স্বাধীনতার পূর্বে পাট উৎপাদনে বাংলা সেরা ছিল। আর এই বাংলাদেশের পাটের উপর
নির্ভর করে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের
পর এদেশে অনেক পাটকল স্থাপন করা হয়। তবে ১৯৫১ সালে বাংলাদেশে স্থাপিত হয়
পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকল।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পাটের স্থান
আমাদের দেশে যুগ যুগ ধরে পাট বেচাকেনা হয় এবং এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। বাংলাদেশ
থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার পাট বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে যা বাংলাদেশের
অর্থনীতিকে অনেকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দেশে পূর্বে কম মূল্যে পাট রপ্তানি
করা হতো আর বেশি মূল্যে পাটজাত দ্রব্য আমদানি করা হতো। আর এতে অপচয়
হতো জাতীয় অর্থের। বর্তমানে আমাদের দেশে পাট জাত দ্রব্য তৈরি হচ্ছে যার কারণে আর
বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে না। পাট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন
করছে।
পাট শিল্পের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে বর্তমানে পাটকলের সংখ্যা ১৫৪টি। এগুলোর মধ্যে সরকারি ২৭টি এবং বেসরকারি
১২৭ টি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমাগত লোকসানের ফলে অনেক পাটকল বন্ধ করে
দেওয়া হয়েছে। ছয় ৬টি সরকারি এবং ১২ টি বেসরকারি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
২০০২ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ পাটকল আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
২০০৭ সালে পহেলা আগস্ট খুলনায় চারটি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আর পাটকল গুলো
বন্ধ হয়ে যাওয়া এইসব পাটকলের হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। আর এইসব
শ্রমিক গুলোর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা। পাট চাষীরাও তাদের উৎপাদিত পাটের দাম
না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ দিন দিন হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশের পাট পরিস্থিতি
বাংলাদেশে বর্তমানে পাট চাষ ও পাট জাতীয় দ্রব্য বাজারজাতকরণ নিয়ে চরম
বিপর্যায়ের মুখে পতিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটকল আদমজী পাটকল বন্ধ হয়ে
যাওয়ার কারণে পাট চাষিরা পাট বিক্রির উন্মুক্ত বাজার পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক
বাজারে পাট নিম্ন মূল্য প্রভৃতি কারণে চাষীরা পাট চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশে পাট শিল্প
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হলো পাট। বাংলার কৃষকেরা নানা সমস্যার
কারণে পাট চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সকল প্রকার সমস্যার সমাধান করে চাষীদের
আবার পাট চাষে আগ্রহ বাড়িয়ে দিতে হবে। আর বাংলাদেশের পাট শিল্পকে বাঁচানোর জন্য
প্রয়োজন ব্যাপক কর্মসূচির।
উপসংহার
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশে পাট শিল্প আর্শিবাদ স্বরূপ। বাংলাদেশের
অত্যন্ত উপকারী কৃষিজাত পণ্য হলো এই পাট। বাংলাদেশ পার্ট ও পাট জাত দ্রব্য
রপ্তানি করে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক
তাদের জীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু নানা সমস্যার কারণে চাষিরা আর পাট চাষ করতে চায়
না।
তাই সরকারের ভুতুরকি প্রদান করে কৃষকদের পাট চাষে আগ্রহী করে তোলা। তবে বাংলাদেশ
ফিরে পাবে তার সোনালী অতীত পাট শিল্প হবে উন্নত বাংলাদেশ ফিরে পাবে তাদের সোনালী
আঁশ। জীবন যাত্রার মান হবে উন্নত আর পাট শিল্প ফিরে পাবে তার ঐতিহ্য।
Leave a comment