আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস বর্ষাকাল। বর্ষাকালে নদী-নালা, খাল, বিল পানিতে ভরে
যায়। আর এই সময় মানুষ ঘরে পানি বন্দী থাকে। তাই এই সময় মানুষ বিভিন্ন উৎসব করে
থাকে আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের শিক্ষার্থীদের  বর্ষার উৎসব
– বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা পরীক্ষায় লিখতে আসে। তাই আমি  বর্ষার
উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা যথাযথভাবে লেখার চেষ্টা করেছি। যারা
পরীক্ষায়  বর্ষার উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা লিখতে চাও আমার
পোস্ট তাদের জন্য।

আমি বর্ষার উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখার
চেষ্টা করেছি। আমি আশা করি তোমরা এই বর্ষার উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব
রচনা যদি পরীক্ষার খাতায় লিখ তাহলে বেশ ভালো নম্বর পাবে । নিচে 
বর্ষার উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা বিস্তারিত লেখা হলো –

পোস্ট সূচীপত্রঃ বর্ষার উৎসব – বর্ষামঙ্গলা উৎসব রচনা 

ভূমিকা

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ঋতু হল বর্ষার ঋতু। আর এর অন্যতম কারণ হলো বর্ষা হল
উৎসব মুখর ঋতু। বলা যায় এটি প্রকৃতির অসামান্য এক দান। বর্ষার ঋতুকে বলা হয়
বাংলার নন্দিত বন্দিত্ব ঋতু। কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার বৈশিষ্ট্য নিহিত
রয়েছে এই বর্ষা ঋতুতে। বর্ষা ঋতু যেন প্রকৃতির অনির্বাচনীয় প্রকাশ। বসন্ত কে
ঋতুরাজ বলা হলেও বর্ষা হলো ঋতুর রানী। বৃষ্টি, বর্ষা ও বর্ষাকাল নিয়ে কবিতা,
গান, নাটক কোন কিছুর যেন শেষ নেই। বর্ষাকাল মানে যেন বাঙালির কাছে উৎসব।

বর্ষা অপরূপ ঋতু আর এই বর্ষা ঋতুতেই বাঙালির হৃদয় যেন প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে
উৎসব মুখর হয়ে ওঠে প্রবল আনন্দে। আর বাংলাদেশের অধিবাসীরা উৎসবের আয়োজনে মেতে
ওঠে। মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে যে সম্পর্ক আর এর মধ্যে ফুটে উঠে দেশের প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য। বর্ষা মানবজীবনকে করে সরস এবং কাব্যময়। বর্ষা অর্থনৈতিক জীবনের
পাশাপাশি সাংস্কৃতিক জীবনে ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তাই বাঙালি মেতে উঠে
বিভিন্ন উৎসবে।

বর্ষার উৎসব

বাংলাদেশে বর্ষা কালকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন উৎসব। ঋতু
চক্রে গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষা ঋতু। গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে জুন মাসের ১৫
তারিখে আষাঢ় মাস শুরু হয় এবং এই দিনেই বর্ষা উৎসব বা বর্ষামঙ্গলা উৎসব পালন করা
হয়। এই দিনটি কবিতা, গান, নাটক, আবৃতি, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, ইলিশ উৎসব, পুতুল
নাচ প্রভৃতি আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষা উৎসব উদযাপন করা হয়।

আরো পড়ুনঃপড়াশোনায় মনোযোগী হওয়ার ২০টি উপায় – ব্রেন ভালো হওয়ার দোয়া জেনে নিন

বর্ষাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য বাঙ্গালী মেয়েরা নীল শাড়ি পরে। এছাড়াও এই সময়
নৌকা বাইচ, যাত্রাপালা, ধামাইল উৎসব এবং গীত পরিবেশন, মনসা পূজা, শাওনের ডালার
উৎসব ইত্যাদি পালন করা হয়।

নৌকা বাইচ

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তাই বাংলাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য ও
খেলাধুলায় নদনদীর উপস্থিতি রয়েছে প্রবল। নৌকা বাইচ এ দেশের সংস্কৃতি ও লোকালয়ের
এক সমৃদ্ধ ফল। বর্ষাকালে বাংলার নদী – নালা, খাল – বিল পানিতে ভরে যায় আর এই
সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আয়োজন করা হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার। 

নৌকা বাইচের সময় প্রতিযোগীরা এক সুরে গান গায় আর হেইয়ো হেইয়ো শব্দ করে তারা
যেন প্রকৃতি থেকে শক্তির সঞ্চয় করে নেয়। সেই সাথে তারা নৌকার অনেক সুন্দর
সুন্দর নাম দিয়ে থাকে যেমন -পঙ্কিরাজ, সাইমন, ঝড়ের পাখি, ময়ূরপঙ্খী, সাইমন,
সোনার তরী, দ্বীপ রাজ, অগ্রদূত ইত্যাদি।

ধামাইল উৎসব

বর্ষাকালে সিলেট অঞ্চলের লোকজন বিশেষ করে মহিলারা অবসর সময়ে তারা একসঙ্গে বসে
হাসি – ঠাট্টা ও গল্প – গুজব করতো। আর তাদের এই আড্ডার সময়টাকে বলা হত ধুম্বইল।
আর এই আড্ডা এক সময় নাচে গানে রূপ নেয় যাকে বলা হয় ধামাইল। বাংলাদেশ ছাড়া ও
ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই ধামাইল গানের প্রচলন রয়েছে। আর এই ধামাইল গানকে
সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করে তোলেন  রাধারমন দত্ত। এছাড়াও ভরতচন্দ্র সরকার,
প্রতাপ রঞ্জন তালুকদার, শিখা রানী দাস, 

আরো পড়ুনঃ কানাডায় স্কলারশিপ কত – কানাডায় পড়াশোনার মাসিক খরচ ২০২৩/২৪

সুনীল চন্দ্র সরকার, আব্দুল করিমসহ এর মত গুণী শিল্পীগণ রচনা করেন ধামাইল
গান।ধামাইল নাচ ও রয়েছে তবে ধামাইল নাচ শুধু মেয়েদের জন্য। আর এই ধামাইল উৎসবে
অংশ নেয় সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা,
ব্রাক্ষনবাড়িয়ার বিভিন্ন গুণী শিল্পীগণ। এছাড়া এই অঞ্চলে ধামাইল অনুষ্ঠানের
পাশাপাশি বিভিন্ন লোকনৃত্য, কেচ্ছা পালা, সীমিস্যা গান, গাজীর গীতি, পুথি পাঠের
আসর ও বসে থাকে।

যাত্রাপালা

যাত্রাপালা বাংলার মানুষের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। বর্ষাকালে বাংলার নিম্নাঞ্চল
বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে যায় যার কারণে এই অঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী হয়ে ঘরে
অবস্থান করে। আর অবসর সময় কাটানোর জন্য তারা আয়োজন করে বিভিন্ন যাত্রাপালার।
রাত জেগে মানুষ উপভোগ করে এই যাত্রাপালা। বিখ্যাত যাত্রাপালা গুলোর মধ্যে রয়েছে
বেহুলা লক্ষিন্দর, সোহরাব রুস্তম, রূপবান, নসিমন, সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ইত্যাদি।
সারারাত নির্ঘুম চোখে তারা এইসব যাত্রাপালা উপভোগ করে থাকে।

গীত পরিবেশন

বর্ষাকালে ভাটি অঞ্চলে গীত পরিবেশনের উৎসব বসে। বিশেষ করে গ্রামের কৃষকের বাড়িতে
এইসব উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আর এই গীত উৎসব চলে কখনো একা একা আবার কখনো বা
দল বেঁধে, বর্ষার সময় মেয়েরা বসে কয়েকজন মিলে নকশি কাঁথা সেলাই করে এবং গীত
পরিবেশন করে।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা

বৌদ্ধদের একটি অন্যতম উৎসব হলো আষাঢ়ী পূর্ণিমা ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ
থেকে বৌদ্ধ ধর্মাম্বলীদের কাছে আষাঢ়ী পূর্ণিমার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।

ঘাটু গান

ঘাটু গান এক প্রকারের লোকগীতি। বর্ষার পানিতে যখন নদী – নালা, খাল – বিল ভরে যায়
তখন নৌকা চলে আর ঘাটে ঘাটে নৌকা ভেড়ানোর সময় নৌকার মাঝিরা এক ধরনের লোকগীতি গান
গায় আর একে ঘাটু গান বলা হয়। বিশেষ করে কিশোরেরা নাচের মাধ্যমে এই গান করে থাকে।
এই ঘাটু গানের মূল বিষয়বস্তু হলো রাধা কৃষ্ণের প্রণয় লীলা।

ঢপ বা ঢপ কীর্তন

বর্ষার উৎসবের মধ্যে ঢপ বা ঢপ কীর্তন অন্যতম। এটা মূলত রাধাকৃষ্ণের কাহিনী নির্ভর
একটি পরিবেশনা। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে শ্রাবণ মাসের পূজার সময় ঢপ যাত্রার
আঙ্গিকে মনসামঙ্গলের পরিবেশনা হয়ে থাকে। আর এই ঢপ যাত্রা অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা
সিলেট অঞ্চলেই বেশি হয়ে থাকে।

মনসা পূজা

বর্ষাকালে সনাতন হিন্দু সম্প্রদায় দেবী মনসা বা পদ্মা দেবীর নামে এক ধরনের পূজা
অনুষ্ঠিত হয় এটি মূলত পদ্মা পূরণের আখ্যান ভিত্তিক অনুষ্ঠান। এটি বিভিন্ন
শিল্পীদের দ্বারা পরিচালিত পদ্মা নামক এক ধরনের নাট্য পরিবেশনা। সনাতন হিন্দু
সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করে দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পারলে তবেই তাদের মঙ্গল
সম্ভব।

শাওনে ডালার উৎসব

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার কিছু এলাকার লোকজন শ্রাবণ মাসের শেষের তিন দিন বংশাইল
নদীতে শাওনে ডালার উৎসব করে থাকে। এই উৎসব সাধারনত মুসলমান পুরুষরাই করে থাকে।
বিশেষ করে মুসলমান সাপুড়েরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে, যদিও মুসলমান
সাপুড়েরা এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে তথাপি এই অনুষ্ঠান মূলত মনসামঙ্গল বা
বেহুলা লখিন্দর এর প্রচলিত কাহিনী অনুসারে হয়ে থাকে।

রথের মেলা

আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয় তিথিতে রথের মেলা নামক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জগন্নাথ
দেবের স্মরণে জগন্নাথ, তার ভাই বলরাম ও বোন শুভ্রদার মূর্তি স্থাপন করে শত শত
ভক্ত এই রথযাত্রার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। তাদের এই রথ প্রথম দিন যেখান থেকে
টেনে নিয়ে যাওয়া হয় আট দিন পর আবার সেখানেই এনে রাখা হয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে
বড় রথযাত্রা এবং রথের মেলা ধামরাই এর জগন্নাথ মন্দিরে হয়ে থাকে।

বর্ষার বিভিন্ন কবিতা ও গান

বাংলার কবি ও শিল্পীরা বর্ষাকে ঘিরে লিখেছেন বিভিন্ন কবিতা এবং গান। বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন –

“নীল নবঘনে আশার গগনে

তিল ঠাঁয় আর নাহিরে

ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে”।

“এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘনঘর বরিসায়”।

আরো পড়ুনঃ একটি ঝড়ের রাত – রাত্রি রচনা সম্পর্কে জানুন

হুমায়ূন আহমেদ এর মনে ভেসে উঠেছে-

“যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো এক বরষায়, যদিও তখন আকাশ থাকবে বইরি কদম গুচ্ছ হাতে
নিয়ে আমি তৈরি”।

এছাড়াও বর্ষাকালে বর্ষার পানিতে যখন হাঁস গুলো ভেসে বেড়ায় তখন সন্ধ্যাবেলা
মেয়েরা হাঁসগুলো ঘরে তোলার জন্য ছন্দের সুরে বলে – আই আই হাঁসগুলো তই তই তই।

উপসংহার

বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্যতম একটি জনপ্রিয় ঋতু হলো বর্ষা ঋতু। এই ঋতু যেন
প্রকৃতির এক অসামান্য দান। বর্ষাকালে আমাদের পূর্বপুরুষদের ঘরে বসে সময় কাটানো
ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই তারা আয়োজন করতেন বিভিন্ন উৎসবের। গ্রামের
মেয়েরা ঘরে বসে রঙিন কাঁথা সেলাই করে আর কেচ্ছা করে সিমিস্যা গান করে। সমাজের সব
ধরনের মানুষের আনন্দময় উপস্থিতিতে বর্ষার উৎসব সার্বজনীন। তাই তো কবি রফিক আজাদ
বলেছেন-

বর্ষনে আনন্দে যাও মানুষের কাছে

নিরন্তর ঝরে যাও অঝোর ধারায়;

করুনায় আদ্র হয়ে মানব মঙ্গলে

এই ঋতু মাঙ্গলিক ময়ূর – আনন্দে মাতো

কৃষি সভ্যতার সকল সন্তান…..

বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে।