হরপ্পা সভ্যতায় যে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের বাণিজ্য চলত তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। জন মার্শাল, মর্টিমার হুইলার, ব্রিজেট অলচিন, রেমন্ড অচিন প্রমুখ হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যের বিভিন্ন প্রমাণ তুলে ধরেছেন।
[1] প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান: সিন্ধু সভ্যতার যুগে নগরের চারিদিকের গ্রামগুলিতে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য ও কাঁচামাল নগরগুলিতে আসত। এই পণ্য সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে ও দেশে-বিদেশে পৌঁছে যেত। সম্ভবত স্থলপথে পশু-টানা গাড়িতে এবং জলপথে নৌকা ও জাহাজের মাধ্যমে মালপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানাে হত।
[2] লােথাল বন্দরের অস্তিত্ব: গুজরাটের লােথালে একটি বন্দরের ধ্বংসাবশেষ, পাথরের বস্তু নােঙর ও বহু সিলমােহর এবং মহেনজোদারােতে পােড়ামাটির একটি জাহাজের মডেলও পাওয়া গেছে। এসব তথ্যপ্রমাণ থেকে সিন্ধু উপত্যকার সঙ্গে মেসােপটেমিয়ার নিয়মিত সামুদ্রিক বাণিজ্যের অনুমান করা যায়।
[3] সীলমােহর: হরপ্পার বণিকরা বাণিজ্যিক কাজে সীলমােহর ব্যবহার করত। সীলমােহরগুলিতে ব্যবসায়ীর নাম ও ঠিকানার উল্লেখ থাকত বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। সুমের, মেসােপটেমিয়া ও অন্যান্য স্থানে হরপ্লার সীলমােহর আবিষ্কৃত হয়েছে।
[4] আক্কাদের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রমাণ: পশ্চিম এশিয়ায় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, আক্কাদের রাজা সারাগনের আমলে তিলমুন বা দিলমুন, মগন ও মেলুহার সঙ্গে আক্কাদের বাণিজ্য চলত। অনেকে মেলুহাকে নিম্নসিন্ধু অঞ্চল বলে চিহ্নিত করেছেন।
[5] মেসােপটেমিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য: সি. জে. গ্যাড মেসােপটেমিয়ার উর নামক স্থানে হরপ্লায় তৈরি সিলের সন্ধান পেয়েছেন। আবার লােথাল, মহেনজোদারাে প্রভৃতি স্থানে মেসােপটেমীয় ধরনের কিছু সিল পাওয়া গেছে। এ থেকে মেসােপটেমিয়া ও নিকটবর্তী সুমেরের সঙ্গে সিন্ধুর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে মনে করা হয়।
[6] সুমেরের সঙ্গে বাণিজ্য: সুমেরিয়ার লাগাস, সুসা প্রভৃতি অঞ্চলে হরপ্পা সভ্যতার সীলমােহর আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত বাহরিন (তিলমন) ও ওমান (মাকান)-এর সমুদ্রপথে সুমেরের সঙ্গে হরপ্পার বাণিজ্য চলত।
[7] অন্যান্য স্থানের সঙ্গে বাণিজ্য: উপরিউল্লিখিত স্থানগুলি ছাড়াও মিশর ও ক্রীটের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বলে অনুমান করা হয়।
ভারতে এবং ভারতের বাইরে বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।
[1] আমদানি: [i] হরপ্পা সভ্যতায় কর্ণাটক থেকে সােনা, রাজস্থান ও বেলুচিস্তান থেকে তামা, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত থেকে সিসা এবং রাজস্থান ও গুজরাট থেকে দামি পাথর আমদানি করা হত। [ii] আফগানিস্তান থেকে রুপাে ও ল্যাপিস লাজুলি, আরব থেকে তামা, ইরান থেকে রূপা ও নীলকান্তমণি, মধ্য এশিয়া থেকে জেড পাথর প্রভৃতি আসত।
[2] রপ্তানি: সােনা, রুপাে, তামা, হাতির দাঁত, কাঠ, ল্যাপিস লাজুলি, দামি পাথর, পশুপাখির মূর্তি প্রভৃতি নিম্ন সিন্ধু অঞ্চল থেকে সুমের ও মেসােপটেমিয়ায় রপ্তানি হত।
উপসংহার: হরপ্পার নগর সভ্যতার পতনের পরবর্তীকালে ভারতে গ্রামীণ বৈদিক সভ্যতা গড়ে ওঠে। পশুপালক ও কৃষিজীবী বৈদিক সমাজে বাণিজ্যকে বহুলাংশে অবহেলা করা হয়। ফলে সিন্ধু সভ্যতার যুগের সমৃদ্ধ বাণিজ্য বৈদিক যুগে অনেকটাই শ্রিয়মাণ হয়ে পড়ে।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের বা পতনের কারণ :-
সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান বা বস্তুর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনুমান, হরপ্পা সভ্যতা আনুমানিক ২৩০০ থেকে ১৭৫০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে গড়ে উঠেছিল । হরপ্পা সভ্যতা ছিল এক বিশাল প্রাণবন্ত সভ্যতা এবং এই প্রাণবন্ত সভ্যতা কি কারণে বিলুপ্ত হয়েছিল, তা সঠিক ভাবে জানা যায় না । দীর্ঘ ছয়শো বছর উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত অস্তিত্বের পর আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের কিছুকাল পরে এই সভ্যতার অবসান ঘটেছিল একথা সর্বজনস্বীকৃত । এই সভ্যতার ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে পুরাতত্ত্ববিদ, ভূ-তত্ত্ববিদ, আবহাওয়া তত্ত্ববিদ এবং বিভিন্ন ইতিহাসবিদ বিভিন্ন মত প্রকাশ প্রকাশ করেছেন । এঁরা সকলেই বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তাঁরা বিভিন্ন মতকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন । তবে আজ পর্যন্ত এমন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়নি যার ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে, কোন একটি বিশেষ কারণে এই সুমহান সভ্যতার পতন ঘটেছিল । হরপ্পা সভ্যতার বিলুপ্তির কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমাদের কয়েকটি মৌলিক বিষয় মনে রাখতে হবে । (১) সিন্ধু উপত্যকা এবং তার বাইরে যে বিশাল এলাকা জুড়ে এই সভ্যতা বিস্তৃত ছিল, তা কিন্তু সমস্ত এলাকায় একই সাথে বিলুপ্ত হয় নি । হরপ্পা ও মহেনজোদারোর বিলুপ্তির একশো বা দেড়শো বছর পরেও সুরকোটরা প্রভৃতি অঞ্চলে এই সভ্যতা টিকে ছিল । এর পরেও গুজরাট, রাজস্থান ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও অঞ্চলে ভঙ্গুর অবস্থাতেও এই সভ্যতার অস্তিত্ব বজায় ছিল । (২) এই সভ্যতার সকল কেন্দ্রগুলির পতনের পশ্চাতে একই কারণ বা প্রেক্ষাপট ছিল না । দু-একটি নগর বা কেন্দ্রের পতনের কারণ এক হলেও সর্বত্র তা সমান ছিল না । (৩) আকস্মিকভাবে হঠাৎ একদিনে এই সভ্যতার পতন হয় নি । দীর্ঘদিন ধরে ক্রমিক অবক্ষয়ের ফলে সভ্যতাটি অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে এবং তার পরেই আসে চরম বিপর্যয়, যা সভ্যতাটির বিলুপ্তি ঘটায় । হরপ্পা সভ্যতার পতনের সম্ভাব্য কারণগুলিকে মোটামুটিভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায় । যথা— (১) প্রাকৃতিক কারণ, (২) আভ্যন্তরীণ অবক্ষয় এবং (৩) অন্যান্য কারণ ।
(১) প্রাকৃতিক কারণ :- হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য অনেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণগুলিকে দায়ী করে থাকেন । এই প্রাকৃতিক কারণগুলি হল—
(ক) জলবায়ুর পরিবর্তন, (খ) মরুভূমির প্রসার, (গ) সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন, (ঘ) ভূমিকম্প, (ঙ) বন্যা, (চ) খরা প্রভৃতি ।
(ক) জলবায়ুর পরিবর্তন:- মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে, সিন্ধু উপত্যকায় একসময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হত এবং অঞ্চলটি বনজঙ্গলে ভরা ছিল । কিন্তু পরবর্তীকালে এখানে নগর সভ্যতার সম্প্রসারণ এবং ঘরবাড়ি নির্মাণের জন্য প্রচুর ইটের প্রয়োজন হয় । ইট পোড়াতে প্রচুর গাছপালা কাটতে হয় এবং ক্রমে সমগ্র অঞ্চলটি বনশূন্য হয়ে পড়ে । এর ফলে এখানে এক সময় বৃষ্টিপাত কমে যায় এবং কৃষিকার্যের অবনতি ঘটে । জলবায়ু মানুষের বসবাসের প্রতিকূল হয়ে পড়ে । গুরদীপ সিং বলেছেন যে, বৃষ্টিপাতের হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার উত্থান-পতন সরাসরি সম্পর্কযুক্ত ।
(খ) মরুভূমির প্রসার :- নগর সভ্যতার সম্প্রসারণ ও গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে পোড়া ইট তৈরির জন্য ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদনের ফলে সমগ্র অঞ্চলটি বনশূন্য হয়ে পড়লে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমে যায় । এর ফলশ্রুতি হিসাবে নিকটবর্তী স্থানে মরুভূমি থাকায় সিন্ধু উপত্যকায় শুষ্কতা বৃদ্ধি পায় ও ভূগর্ভস্থ লবণ ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসে এবং কালক্রমে সিন্ধু উপত্যকা উষর মরুভূমিতে পরিণত হয় । আবার রাজস্থানের থর মরুভূমিও ক্রমে সিন্ধু উপত্যকার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে । ফলে স্থানটি বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে । সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ প্রসঙ্গে স্যার অরেল স্টাইন -এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য । তিনি ভারত সীমান্তে গেড্রোসিয়া বা বেলুচিস্তানের মরুভূমির উপর সমৃদ্ধশালী বসতির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান । তাঁর মতে বেলুচিস্তানে তাম্র-প্রস্তর যুগ (Chaleolithicage) থেকে এই শুষ্কতার সূচনা হয় । হরপ্পা সভ্যতা পতনের জন্য এই ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা বহুলাংশে দায়ী ছিল ।
বিরোধী যুক্তি : রাইকস (Raikes), ডাইসন (Dison), ফেয়ারসার্ভিস (W.A. Fairservis) প্রমুখ জলবায়ুর পরিবর্তনের বিষয়টি মানতে নারাজ । আবহতত্ত্ব, উদ্ভিদতত্ত্ব ও প্রাণীতত্ত্বের নানা ব্যাখ্যা দিয়ে দাবি করেছেন যে, সিন্ধু উপতাকায় এত বড় ধরনের জলবায়ু পরিবর্তন ঘটেনি ।
(গ) সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন :- কেউ কেউ মনে করেন যে, সিন্ধু নদ, শতদ্রু ও যমুনা নদী এক সময় তাদের গতিপথ পরিবর্তন করলে হরপ্পা সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে । জলের অভাবে সরস্বতী, দৃশদবতি প্রভৃতি নদী মাটিতেই হারিয়ে যায় । সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বন্দর হিসেবে মহেন-জো-দারো তার গুরুত্ব হারায় । বিভিন্ন স্থানে জলসেচের অভাবে কৃষি-ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে । খাল খনন করে হয়তো এই সমস্যার সমাধান করা যেত, কিন্তু মহেঞ্জোদারোবাসী সে পথে অগ্রসর হয় নি, তারা সম্ভাবত নগরটি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় ।
(ঘ) ভূমিকম্প :- মহেন-জো-দারোতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু মৃতদেহ বা কঙ্কাল পাওয়া গেছে । কঙ্কালের গায়ে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে এবং সেগুলির সৎকার করা হয়নি । অনেকে মনে করেন যে, ভূমিকম্পের ফলে ঘরবাড়ি ভেঙে পড়ার ফলেই কঙ্কালে ক্ষতচিহ্নগুলি ছিল এবং সেগুলির সৎকার করাও সম্ভব হয়নি ।
বিরোধী যুক্তি : সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল— এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি । মহেন-জো-দারোতে আবিষ্কৃত নয়টি ও হরপ্পা সভ্যতায় আবিষ্কৃত আটটি স্তরের প্রতিটিতে সিন্ধুর অধিবাসীরা তাদের বসতির পুনর্নির্মাণ করেছিল । তাহলে নদীর গতিপথের পরিবর্তনের পর কেন তারা বসতির পুনর্নির্মাণ করল না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায় । ড. এইচ. ডি. শাসাঙ্খালিয়া এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, মহেন-জো-দারোর অধিবাসীরা নগরটি আগে নয়বার ধ্বংসের পর পুনর্নির্মাণ করলেও শেষবার ভূমিকম্পের পর কেন তারা শহরটি আর পুনর্নির্মাণ করল না ।
(ঙ) বন্যা :- ইতিহাসবিদ রাইকস, জর্জ ডেলস, আরনেস্ট ম্যাকে, এস. আর. রাও, আর.এম. সাহানি প্রমুখ মনে করেন যে, বিধ্বংসী বন্যার ফলেই হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছিল । এম. আর. সাহানী-র মতে “প্লাবন-সিন্ধু সংকৃতিকে ভাসিয়ে দেয় ।” (“Flood may have swept the Indus Culture.”) । বন্যার হাত থেকে মহেঞ্জোদারোর নগরদুর্গকে রক্ষা করার জন্য মহেন-জো-দারোতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল— (i) ৪৩ ফুট চওড়া একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয় । (খ) পয়ঃপ্রণালীর উচ্চতা ১৪ ফুট বাড়ানো হয়েছিল । (গ) বন্যার জল আটকাতে বাড়ির ভিত উঁচু করা হয়েছিল । (ঘ) বাড়ির যে অংশে বন্যার জল লাগতে পারে সেই অংশ পোড়া ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল । কিন্তু সেগুলির কোনোটাই এই সভ্যতাকে বিধ্বংসী বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি ।
বিরোধী যুক্তি : অনেকে বলেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় এই ধরনের বিধ্বংসী বন্যার কোন ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি । তা ছাড়া, মহেন-জো-দারো, লোথাল,চানহুদরো, রংপুর প্রভৃতি স্থানে বন্যার তথ্য কার্যকরী হলেও হরপ্পা বা কালিবঙ্গানে তা কার্যকরী হতে পারে না ।
(চ) খরা:- অনেকে মনে করেন যে, হরপ্পা সভ্যতায় ইট পোড়ানো ও অন্যান্য প্রয়োজনে ক্রমাগত বনভূমি ধ্বংস করার ফলে এখানে বৃষ্টিপাত খুবই কম যায় । এক সময় টানা অনাবৃষ্টি বা খরার ফলে কৃষিকাজ বন্ধ হয়ে যায় । ফলে সিন্ধু অধিবাসীরা অন্যত্র চলে যায় ।
বিরোধী যুক্তি : অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের পাশাপাশি খরার তত্ত্বটি পণ্ডিতদের কাছে খুবই দুর্বল মনে হয় ।
(২) আভ্যন্তরীণ অবক্ষয়:- অনেকে হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংস বা পতনের জন্য এই সভ্যতার অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের বিষয়টিকেই দায়ী করেছেন । তাঁদের মতে অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় হরপ্পা সভ্যতার পতনের পথ প্রস্তুত করেছিল ।
(ক) নাগরিক জীবনের অবক্ষয় :- হরপ্পা সভ্যতার নীচের স্তরগুলিতে যে উন্নত নাগরিক সভ্যতার ছাপ পাওয়া যায় তার তুলনায় ওপরের স্তরগুলিতে নাগরিক জীবনের অবক্ষয়ের চিত্রটি উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ে । তুলনা করলে দেখা যায় (i) বাড়িগুলি রাস্তা দখল করে নিচ্ছে, গলিপথগুলি ক্রমে সরু হয়ে আসছে । (ii) নর্দমাগুলি অপরিষ্কার থেকে যাচ্ছে । (iii) বড়ো অট্টালিকাগুলি পৃথক করে ছোটো ছোটো খুপরি তৈরি হচ্ছে । (iv) কৃষি ও বাণিজ্যের অবনতি ঘটছে । (v) মৃৎপাত্র তৈরিতে মানের অবনমন ঘটেছে । তাই হুইলার মন্তব্য করেছেন যে, পরবর্তীকালে মহেন-জো-দারো ও হরপ্পা ছিল তাদের পূর্ববর্তী যুগের ছায়ামাত্র ।
(খ) রক্ষণশীল মানসিকতা :- হরপ্পা সভ্যতা চরম উৎকর্ষে পৌঁছোলেও এই সভ্যতার অধিবাসীরা তাদের চিরকালীন রক্ষণশীল মানসিকতা ত্যাগ করতে বা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেনি । পুরনোকে আঁকড়ে ধরে থাকার ফলে তারা মিশরীয় বা সুমেরীয় সভ্যতা থেকে কিছু শিক্ষালাভ করেনি । (ক) হরপ্পাবাসীরা জলসেচের জন্য খাল খননের কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি । (খ) গাঙ্গেয় উপত্যাকার উর্বর জমিতে কৃষির সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি । (গ) কৃষিকাজে তারা ভারী লাঙ্গল বা উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কোনো চেষ্টা করেনি । (ঘ) অন্য জাতির আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষার জন্যও তারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র তৈরীর কথা চিন্তা করেনি । (ঙ) বৈদেশিক বাণিজ্য ক্রমে কমতে থাকলেও তারা কোনো বিকল্প পথ খোঁজার কথা ভাবেনি । তাই সিন্ধু অধিবাসীদের রক্ষণশীল মানসিকতার ফলে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল বলে অনেকে মনে করেন ।
(৩) অন্যান্য কারণ :- ইতিহাসবিদদের মতে, হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলি হল—
(ক) বর্বর সংস্কৃতির প্রভাব :- অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, দিনে দিনে হরপ্পা সভ্যতার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে নানান সমস্যা দেখা দেয় । পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়ায় আগেকার বড়ো ঘরগুলি ছোট ছোট খুপরিতে ভাগ করা হয় । ক্রমে অনগ্রসর অঞ্চলে হরপ্পা সংস্কৃতির প্রসার ঘটলে হরপ্পা সভ্যতায় সেখানকার বর্বর সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে । ফলে হরপ্পা সংস্কৃতি দিনে দিনে মলিন ও জীর্ণ হয়ে পড়ে ।
(খ) বহিরাক্রমণ :- সিন্ধু উপত্যকায় খনন কার্যের ফলে রান্নাঘর, সিঁড়ি, কুয়োর ধার, রাস্তা প্রভৃতি স্থানে ইতস্তত ছড়ানো কঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে । এই বিষয়টি থেকে নানা পন্ডিতরা ব্যাখ্যা দেন যে, নানা কারণে যখন হরপ্পা সভ্যতা দুর্বল হয়ে পড়েছিল তখন বৈদেশিক আক্রমণ এই সভ্যতার পতনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল । আক্রমণ তত্ত্বকে জোরালো করার জন্য তাঁরা বলেন যে— (i) কোনো কোনো কঙ্কালের পায়ে, মাথায় অস্ত্রের আঘাত রয়েছে । এতে প্রমাণ হয় যে, শত্রুর আক্রমণেই এদের প্রাণ গেছে । (ii) সিন্ধু সভ্যতার পতনের কাল এবং ভারতে আর্যদের আগমনকাল, এই দুটিকেই মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১৪০০ অব্দ বলে ধরা হয় । অর্থাৎ, সিন্ধু সভ্যতার পতনের কাল এবং আর্যদের আগমনের সময়কাল অদ্ভুতভাবে মিলে যায় । তাই আর্যদেরই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসকারী বলে অনেকে মনে করেন । (iii) হুইলার ও অন্যান্য অনেকেই ঋকবেদে বর্ণিত ‘হরিয়ুপীয়ার যুদ্ধ’ -কে হরপ্পার যুদ্ধ বলে মনে করেন । (iv) ঋগবেদে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ বা নগরের ধ্বংসকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে । আর্যদের ভারতে আগমনকালে হরপ্পা ছাড়া যেহেতু অন্য কোনো নগরসভ্যতা ছিল না, তাই আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস করেছিল বলে অনেকে মনে করেন । (v) চানহুদরোতে তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি যে কুঠার পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ইরানীয় কুঠারের সাদৃশ্য রয়েছে । তাই, আর্যরা ইরানের পথে ভারতে এসেছিল বলে একে অনেকে আর্যদের কুঠার বলে মনে করেন ।
বিরোধী যুক্তি : কোনো বহিরাগত বা আর্য জাতির আক্রমণে হরপ্পা সভ্যতার পতনের তত্ত্বটির বিরুদ্ধেও কিছু যুক্তি তুলে ধরা যায়— (i) কঙ্কালগুলিতে যে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে তা গৃহযুদ্ধ বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণেও হতে পারে । ট্যাডির মতে, এই হত্যাকান্ডের কারণ ছিল গৃহযুদ্ধ । (ii) মহেন-জো-দারোতে আর্য আক্রমণের বিষয়টি মেনে নিলেও অন্যান্য শহরে এরূপ আক্রমণের কোনো চিহ্ন নেই । (iii) এ কথাও নিশ্চিত করে বলা যায় না, যে বিদেশী আক্রমনকারী জাতি আর্যই ছিল ।
উপসংহার :- সিন্ধু সভ্যতার অবলুপ্তির কারণ হিসেবে বিভিন্ন তত্ত্বের উপস্থাপনের পর এ কথাই বলা যায় যে, উল্লিখিত কোনো অভিমতই সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত নয়, তাই সর্বজনগ্রাহ্যও নয় । যদি কখনও সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়, তাহলে এবিষয়ে হয়তো আরও সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে । এখন শুধু এ কথাই বলা যায় যে, ইতিহাসের নিয়মেই একদিন হরপ্পা সভ্যতার যেমন উত্থান ঘটেছিল তেমনি ইতিহাসের নিয়মেই এই সভ্যতার পতনও ঘটেছিল । এ বিষয়ে মহাভারতের স্ত্রী পর্বে উল্লিখিত বাণীই মনে হয় হরপ্পা সভ্যতার পতনের ইতিহাসসম্মত উত্তর হতে পারে—”সকল সঞ্চয়ই পরিশেষে ক্ষয় পায়, উন্নতির অন্তে পতন হয়, মিলনের অন্তে বিচ্ছেদ হয়, জীবনের অন্তে মরণ হয়” ।
Leave a comment