গরম পানি কি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায়?
গরম পানি কি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায় | Image by Wisilife

পানি পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যবহৃত যৌগগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে পানি একটি রহস্যজনক যৌগও বটে। রাসায়নিক বা ভৌত ধর্ম বিশ্লেষণ করলে এর বিভিন্ন ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের কথা জানা যায়। যেমন পানি জমে বরফ হলে এর আয়তন বাড়ে, যেখানে অন্যান্য যৌগের ক্ষেত্রে ঘটনাটি বিপরীত।

আবার যেমন অন্যান্য তরলগুলো শীতল হওয়ার সাথে সাথে ঘন হতে থাকে। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে ঘটনাটি ব্যতিক্রম। একে শীতল করতে থাকলে 4 ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঘনত্ব সর্বোচ্চ হয় এবং তাপমাত্রা কমতে থাকলে পুনরায় এর ঘনত্ব কমতে থাকে।

ফলস্বরুপ পানি যখন জমে বরফে পরিণত হয় তখন এই বরফ পানিতে ভেসে থাকতে পারে।

এমনই অনেক চমৎকার বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অনেকে পানির আরও একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চান। অনেকেই প্রশ্ন করে থাকেন যে, গরম পানি কি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায়?

যদি আপাতভাবে এক কথায় উত্তর দিতে হয়, তাহলে উত্তরটি হবে “হ্যাঁ”, গরম পানি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায়।

তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হ্যাঁ বলা টা ঠিক হবে না। এর কারণ আমরা জানব আলোচনার শেষের গিয়ে। আগে জেনে নেওয়া যাক কেন গরম পানি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায়।

১৯৬০ সালের দিকে তানজানিয়ার এক স্কুল ছাত্র একদিন লক্ষ্য করলেন যে, গরম আইসক্রিমের মিশ্রণ ঠাণ্ডা আইসক্রিমের তুলনায় দ্রুত জমে যায়। তবে এই ঘটনাটি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন মহাজ্ঞানী এরিস্টটল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে। এমনকি রেনে দেকার্ত ও ফ্রান্সিস বেকন এর মত ব্যক্তিরাও এই ব্যাপারটির কথা উল্লেখ করেন।

তানজানিয়ার সে ছাত্রটির নামানুসারে এই ঘটনাটির নামকরণ করা হয় Mpemba effect।

Mpemba effect হল এমন একটি প্রভাব যেখানে গরম জল ঠাণ্ডা জলের চেয়ে দ্রুত জমে যায়। এই প্রভাবটিকে ব্যাখ্যা করার জন্য এখন পর্যন্ত অনেক গবেষণা হয়েছে এবং অনেক মতবাদ প্রদান করা হয়েছে। একটি ব্যাখ্যা এমন যে, উষ্ণ পাত্র ফ্রিজের মধ্যে ভাল তাপ পরিবাহক হিসেবে কাজ করেছিল। ফলে গরম পানি খুব দ্রুত তাপ ছেড়ে দিয়ে শীতল হয়েছে এবং শীতল পানির চেয়ে দ্রুত বরফ হয়েছে।

আবার অন্য একটি ব্যাখ্যা এরকম যে, গরম পানি দ্রুত বাষ্পে পরিণত হয় হয়। আর আমরা জানি বাষ্পে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি তাপগ্রাহী বা এন্ডোথার্মিক। ফলে পানি বাষ্প হতে নিলে পানি দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়ে একে দ্রুত জমতে সাহায্য করে।

তবে, এসব ব্যাখ্যার কোনটিই যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। অনেকদিন পর্যন্তই Mpemba effect এর রহস্য রহস্যই রয়েই ছিল।

তবে সর্বশেষ একটি ব্যাখ্যা এই রহস্যের দ্বার উন্মোচনে বেশ জোরালো দাবি রেখেছিল। এই ব্যাখ্যাটি দিয়েছিল Xi Zhang এর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের Nanyang Technological University –র একদল পদার্থবিজ্ঞানী।

তাদের গবেষণা মতে, এই রহস্যের পেছনে মূল ভূমিকা রাখে পানিতে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বন্ধন।

একটি পানির অণুতে একটি বড় অক্সিজেন পরমাণু দুটি তুলনামূলক ছোট হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে সমযোজী বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে। কিন্তু অসংখ্য পানির অণু যখন একত্রে থাকে তখন হাইড্রোজেন বন্ধন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটি পানির অণু যখন অন্য একটি পানির অণুর নিকটে আসে তখন একটি পানির অণুর অক্সিজেন পরমাণু অন্য পানির অণুর হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে একটি বন্ধন গড়ে ওঠে, যাকে হাইড্রোজেন বন্ধন বলে।

হাইড্রোজেন বন্ধনগুলো সমযোজী বন্ধনের চেয়ে দুর্বল তবে ভ্যান্ডার ওয়ালস বলের চেয়ে শক্তিশালী। এই হাইড্রোজেন বন্ধন পানির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখা থাকে। এমনকি পানির স্ফুটনাংক অন্যান্য তরলের চেয়ে কেন বেশি সেটিও নির্ধারণ করে থাকে।

Xi Zhang এবং তার দলের গবেষণা মতে হাইড্রোজেন বন্ধন পানির অণুগুলোকে পরস্পরের খুব সন্নিকটে নিয়ে আসে। যেহেতু একটি পানির অণু তার আশেপাশের সকল পানির অণুর সাথে হাইড্রোজেন বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে, তাই হাইড্রোজেন বন্ধনের জন্য নিজ নিজ অণুতে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুর মধ্যে সমযোজী বন্ধন (O-H) প্রসারিত হয়। ফলে এই সম্প্রসারিত সমযোজী বন্ধনে শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।

কিন্তু যখন পানি উত্তপ্ত হয়, তখন পানিতে উপস্থিত হাইড্রোজেন বন্ধনগুলো প্রসারিত হতে থাকে। এতে করে পানিতে প্রত্যেকটি অণুর সমযোজী বন্ধন আকর্ষণ বলের কারণে সংকুচিত হতে থাকে এবং সঞ্চিত শক্তি নির্গত হয়ে যায়।

মজার ব্যাপার হল যে, নির্গত এই শক্তির নির্গমন এবং পানির শীতল হওয়া একই কথা। অর্থাৎ উক্ত সঞ্চিত শক্তি নির্গত হওয়ার ফলে পানি দ্রুত শীতল হতে থাকে এবং উপযুক্ত তাপমাত্রায় জমে যায়।

বুঝতেই পারছেন, শীতল পানির ক্ষেত্রে এই ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটতে পারে না। শীতল পানিতে সমযোজী বন্ধনে সঞ্চিত শক্তির নির্গমন উষ্ণ পানির মত দ্রুত ঘটে না। ফলে উপযুক্ত তাপমাত্রায় রাখলে এটি জমে যায়, কিন্তু উষ্ণ পানির মত দ্রুত নয়।

গবেষকরা গাণিতিকভাবেও প্রমাণ করে দেখান যে, পানিতে থাকা সমযোজী বন্ধনের শিথিল হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে গরম পানির ক্ষেত্রে কম সময়ে ঘটে, যে কারণে ঠাণ্ডা পানির তুলনায় গরম পানি দ্রুত জমে যায়।

আর এভাবেই বহুদিনের প্রচলিত ধারণা ‘গরম পানি ঠাণ্ডা পানির চেয়ে দ্রুত জমে যায়’ এর সত্যতা প্রমাণিত হয়।

এবার আসা যাক প্রথমে দেওয়া উত্তরটির প্রসংগে, যেখানে বলা হয়েছিল যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আজকের প্রশ্নটির উত্তরে সরাসরি হ্যাঁ বলাটা ঠিক হবে না।

অনেক ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে পারে যেখানে শীতল পানিই আগে জমে যাবে। যেমন যে পাত্রে গরম পানি ও শীতল পানি রাখা হবে, উভয় পাত্রেরই যদি মুখ বন্ধ থাকে তাহলে Mpemba effect ঘটবে না। কারণ এক্ষেত্রে গরম পানির বাস্পীভবন ঘটবে না। 

এরকম কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে Mpemba effect সত্য। অর্থাৎ গরম পানি ঠাণ্ডা বা শীতল পানির চেয়ে দ্রুত জমে যাবে। 

কমেন্ট বক্সে লেখাটি সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত জানান