উচ্চ আদালতের যে অংশটুকু সকলের জন্য অবশ্য প্রতিপালনীয় সেই অংশকে আইনের ভাষায় ‘রেশিও ডিসিডেন্ডি[Ratio decidendi]’ বলা হয়। বাংলায় আমরা উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের অবশ্য পালনীয় অংশকে নজির[precedent] বলি। আমাদের দেশে ইংরেজ আমলের আগে নজির অনুসৃত হতো না। ইংরেজরা আমাদের দেশে আসার পর তাদের দেশের এই নীতি আমাদের দেশে আমদানি করে। ১৭৭৩ সালের রেগুলেশনে এই বিষয়ের উল্লেখ দেখা যায়। ১৯৩৫সালের ভারত শাসন আইনের ২১২ অনুচ্ছেদে অবশ্যপালনীয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৫০ সালে ভারতীয় সংবিধানের ১৪৪ ধারায় অনুরূপ বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের সকল সংবিধানে এই বিধান বিদ্যমান। বাংলাদেশের সংবিধানে রেশিও ডিসিডেন্ডি এর স্বীকৃতি বিদ্যমান যেখানে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতার কথা বলা আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদে বলা আছে যে,“আপীল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন হাইকোর্ট বিভাগের জন্য এবং সুপ্রীম কোর্টের যে কোন বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত আইন অধঃস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় হইবে।” মোটকথা, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে উচ্চ আদালত আইনের উপর যে ব্যাখ্যা দেবেন, পুনর্বার সেই আইনের উপর নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না।
নিষ্পত্তি নীতি
[RATIO DECIDENDI ]
ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ ‘রেশিও ডিসিডেন্ডি[Ratio decidendi]’ একটি যার বাংলা আভিধানিক অর্থ কোন মােকদ্দমায় বস্তু নিরপেক্ষতা বা উহার ভাষাত্মক বিষয়। ব্যাপক অর্থে ‘রেশিও ডিসেনডি[Ratio decidendi]’ হলো আইনের এমন এক নীতিগত প্রশ্নকে বুঝায়, যার ওপর ভিত্তি করে আদালত তার রায় প্রদান করে থাকে। অর্থাৎ, রেসিও ডেসিডেন্ডি হলো এমন একটি আইন, যাকে কেন্দ্র করে বস্তু নিরপেক্ষ বা বাস্তব বিষয়টির মীমাংসা হয়ে থাকে। এরূপ আইনকে আদালত প্রকাশ্যভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে। এরূপ আইনের শক্তি কেবলমাত্র বস্তু নিরপেক্ষ বা মূলতত্ত্ব বিষয়ক আইনের মধ্যে নিহিত।
এভাবে যে কোন প্রার্থিত, মােকদ্দমায় মৌলিক অংশগুলিকে যা হতে অপ্রাসঙ্গিক এবং সম্পর্কবিহীন উপাদানগুলো পৃথক করে রাখা হয় এবং যার ওপর কেবলমাত্র বিদ্যমান দলদূলির অর্থ জড়িত থাকে, তাকেই মােকদ্দমার ‘রেসিও ডেসিডেন্ডি বা বস্তু নিরপেক্ষ বিষয়[Ratio decidendi] অংশ বলা হয় ।
প্রাসঙ্গিক মন্তব্য[OBITER DICTA]
Obiter dictum হলো একটি ল্যাটিন শব্দগুচ্ছ যার বাংলা ‘প্রাসঙ্গিক মন্তব্য’ বলতে কোন পূর্ববর্তী মামলার কর্তৃত্ববিহীন প্রসঙ্গত বিবরণীকে বুঝায়। এরূপ কর্তৃত্ববিহীন প্রসঙ্গত বিবরণীপূর্ণ মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বলে বিবেচিত হয় না। অর্থাৎ যে সকল মন্তব্য দাখিল মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয় না, ইহাকেই প্রাসঙ্গিক মন্তব্য বলা হয় । এরূপ মন্তব্য বাধ্যকর কর্তৃত্বমূলক নয়। বিচারকগণ ইহা পরবর্তীকালের মােকদ্দমায় অগ্রাহ্য করতে পারেন। এরূপ প্রাসঙ্গিক মন্তব্য কতিপয় পারিপার্শ্বিক ঘটনার উপর নির্ভরশীল। বিচারকগণ পরবর্তীকালের কোন মােকদ্দমায় ইহা মেনে চলতে বাধ্য নন কিংবা পরবর্তীকালের মােকদ্দমায় উহার কোন আবশ্যকতা নেই।
অন্যভাবে বলা যায় যে, প্রাসঙ্গিক মন্তব্য হলো এমন প্রকৃতির মন্তব্য, যা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় আইনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে মন্তব্য হতে পারে, ইহা মামলা শুনানীর সময় কৌসুলী বা বিচারকের উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব হতে পারে, কিংবা উপস্থিত মামলার ঘটনা হতে উদ্ভুত সামাজিক বা অন্যান্য বিষয়ের ওপর মন্তব্য হতে পারে। এ ধরণের মন্তব্যের গুরুত্ব প্রবক্তার পদমর্যাদার প্রাধান্য অনুসরণে প্রণিধানযােগ্য।
বিচারের সময় প্রকৃত তথ্য এবং সে বিষয়ে প্রযুক্ত আইনের ওপর সিদ্ধান্ত প্রদানের সময় বিচারকবৃন্দ এমন কিছু উক্তি করতে পারেন যা ওই মামলার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত নয়, এই উক্তিগুলোকেই অবিটার ডিকটাম বলা হয়।অবিটার ডিকটাম কারো উপর বাধ্যকর নয়। তবে বিচারের ক্ষেত্রে কোনটি রেশিয়ো ডেসাইডেন্ডি এবং কোনটি অবিটার ডিকটাম এই প্রশ্নের নিরসন নিতান্তই জটিল। অভিজ্ঞতায় এক্ষেত্রে একমাত্র পথ প্রদর্শক।
নিষ্পত্তি নীতি ও প্রাসঙ্গিক মন্তব্য এর পার্থক্য
[Distinguish between ratio decidendi and obiter dicta]
নিষ্পত্তি নীতি হচ্ছে কোন মামলার সিদ্ধান্তের আইনগত যুক্তি। কিন্তু প্রাসঙ্গিক উক্তি হচ্ছে বিচারক কর্তৃক রায় প্রদানকালে এমন কোন মন্তব্য যা বিবেচ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্তি হিসেবে কাজ করে। মামলায় বিচারকের রায়ে যে সকল বক্তব্য দ্বারা আইনগত বিধি প্রয়ােগ করা হয়। সেগুলি নিষ্পত্তি নীতি এবং এগুলি আইন হিসেবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু প্রাসঙ্গিক উক্তি সিদ্ধান্ত প্রদানের যুক্তি বিশেষ এবং তা আইন হিসেবে গণ্য হবে না।
রেশিও ডেসিডেন্ডি বা নিষ্পত্তি নীতি ভবিষ্যত মামলায় অনুসরণযােগ্য এবং পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু ওবিটার ডিকটামের বা প্রাসঙ্গিক উক্তির যতই প্রেরণামূলক ক্ষমতা থাকুক না কেন এর কোন বাধ্যকরী ক্ষমতা নেই।
ওবিটার ডিক্টাম বা প্রাসঙ্গিক উক্তি পরবর্তী মামলায় বিচারকের ইচ্ছানুসারে রেসিও ডেসিডেন্ডি হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, ডিকটামের ধরণ অনুযায়ী এর গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু রেসিও ডেসিডেন্ডি পরবর্তী মামলায় ওবিটার ডিকটাম হিসেবে কাজ করে না, সর্বদাই রেসিও ডেসিডেন্ডি হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে।
পার্থক্য:
Leave a comment