বাংলাদেশে তালাক মুসলিম আইনে স্বামী-স্ত্রীর জন্য একমাত্র আইনগত বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার যার মাধ্যমে আইনসিদ্ধভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন। তবে এ ধরনের অধিকার বা ক্ষমতা স্বামী ও স্ত্রীর সমান নয়। তালাকের প্রদানের ক্ষেত্রে স্বামীর একচ্ছত্র অধিকার থাকলেও নির্দিষ্ট কিছু আইনানুগ উপায়ে একজন স্ত্রীও তালাক প্রদান করতে পারেন। যাহোক ইসলামিক আইনের অধীনে বাংলাদেশে মুসলমানদের জন্য মূলত আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতিত বিবাহ-বিচ্ছেদ এবং আদালতের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ রয়েছে। নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো—
১. আদালতের হস্তক্ষেপ ব্যতিত বিবাহ-বিচ্ছেদ
স্বামীর পক্ষ থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution by the husband)
১) স্বামীর ক্ষমতা: তালাক (Talaq)
২) ইলা (Al-Ila/Ila)Talaqএর বিবাহ-বিচ্ছেদ
৩) যিহার/জিহার বা অমর্যাদাকর তুলনা (Zihar) এর বিবাহ-বিচ্ছেদ
স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution by the wife)
১)তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ক্ষমতা: (তালাক-ই-তৌফিজ/talaq al-tafwid or tafwid al-talaq)
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতির মাধ্যমে (By mutual consent) বিবাহ-বিচ্ছেদ
১. খুলা (Khula/Khoola or Khul)
২. মোবারাত (Mubara)
২।আদালতের হস্তক্ষেপের মাধ্যমেবিবাহ-বিচ্ছেদ
বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution by judicial process)
১। লিয়ান/লিয়্যান/লিয়েন (Lian)
২। ফাস্ক (Fask)
বিস্তারিত আলোচনা
১। স্বামীর ক্ষমতা: তালাক
শরিয়তের মাধ্যমে স্ত্রীর তুলনায় স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্রচুর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১ এর ধারা-৭ অনুযায়ী কোন পুরুষ তার স্ত্রীকে যে কোন প্রকারের তালাক দিতে পারেন। কোন সুস্থ মস্তিস্ক সম্পন্ন মুসলিম বয়োপ্রাপ্ত পুরুষ কোনরূপ কারণ না জানিয়ে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে তার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন। স্বামী একবার তালাক উচ্চারণ করলে, ইদ্দতের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর, স্ত্রী যদি ৩ মাসের মধ্যে গর্ভবতী না হয় তবে সেই তালাক কার্যকর হবে।
২) ঈলা/ইলা (lla) তালাক
ইলা (lla) ঘটনা সাপেক্ষে তালাক। যদি কোন স্বামী স্ত্রীর সাথে ইলা (শপথ করা) করেন যে, তিনি তার স্ত্রীর সাথে অন্যূন চার মাস স্ত্রী সহবাস করবেন না, তবে তিনি ঐ সময়ব্যাপী স্ত্রী সহবাস না করলে কোন আইনগত কার্যক্রম ছাড়াই বিবাহ বিচ্ছেদ(Dissolution of Marriage) হয়ে যাবে। যদি তিনি তার শপথ ভেঙ্গে ফেলে তবে বিবাহ বিচ্ছেদ হবে না।
৩। যিহার/জিহার (অমর্যাদাকর তুলনা) (Zihar)এর বিবাহ-বিচ্ছেদ
জিহার ফিকাহ শাস্ত্রের একটি নীতি যেখানে বলা হয়েছে যে স্বামী যদি স্ত্রীর কোন অঙ্গকে মা বা স্থায়ী মাহরামের(বিয়ের নিষিদ্ধ ধাপের মহিলা) পিঠ বা অন্য কোন অঙ্গের সাথে তুলনা করে এবং যদি কোন প্রায়শ্চিত্ত/কাফফারা(০২মাস ধারাবাহিক রোজা রাখা অথবা ৬০ জন অসহায় ব্যক্তিকে খাওয়ানো–সুরা মুজাদালা) না করে তবে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রার্থনা করতে পারেন।
২। স্ত্রীর পক্ষ থেকে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution by the wife)
তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে স্ত্রীর ক্ষমতা: (তালাক-ই-তৌফিজ/talaq al-tafwid or tafwid al-talaq)
বাংলাদেশে নিকাহনামা/কাবিননামার কলাম-১৮এর মাধ্যমে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাকের অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে স্ত্রী স্বামী বা আদালতের আশ্রয় না নিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। স্ত্রীর এই তালাকের ক্ষমতাকেই তালাক-ই-তৌফিজ/talaq al-tafwid or tafwid al-talaq বলে।
৩। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের সম্মতির মাধ্যমে (By mutual consent) তালাক
১. খুলা (Khula/Khoola or Khul)
২. মোবারাত (Mubara)
১. খুলা (Khula/Khoola or Khul) মাধ্যমে বিচ্ছেদ
খুলা (Khula) হলো এক প্রকার তালাক যা স্ত্রীর অনুরোধে সংঘটিত হয়। স্বামী ও স্ত্রীর আলোচনা সাপেক্ষে নিজেদের সমঝোতার মাধ্যমে স্ত্রী স্বামীকে কোন প্রতিদান প্রদান করে বা দিতে সম্মত হয় (সাধারণত দেনমোহর বা অন্য কোন মূল্যবান সম্পত্তি) এবং সেই প্রস্তাব স্বামী গ্রহণ করে যে বিবাহ বিচ্ছেদ হয় তাকে ‘খুলা’ বিচ্ছেদ বলে। যদি স্বামী স্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী তালাক দিতে অস্বীকার করে অর্থাৎ খুল অস্বীকার করে, ততে স্ত্রী আদালতে খুল মঞ্জুরের জন্য আবেদন করতে পারে এবং আদালত সন্তুষ্ট হলে তা মঞ্জুর করতে পারেন। এটাকে বিচারিক খুল(Judicial Khul) বলে। আর স্ত্রী যদি তার প্রস্তাবিত প্রতিদান প্রদান না করে তবুও বিবাহ-বিচ্ছেদ অবৈধ হবে না, কিন্তু স্বামী এর জন্য স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবেন। খুলা (Khula) তালাকের ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ইদ্দতকালীন ও গর্ভস্থ সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
Moonshee Buzul-Marriage-Raheem v. Luteefut-Oon-Nissa (PC), 1861 মামলায় দেখা গেছে যে, খুলা তালাক সেই মুহুর্ত থেকে সম্পূর্ণ হয় যখন স্বামী স্ত্রীকে প্রত্যাখ্যান করে। এমন কোন সময় নেই যে সময়ে এই ধরনের তালাক প্রত্যাখ্যান করা যায়।
২. মোবারাত (Mubarat) মাধ্যমে বিচ্ছেদ
খুলার মতো মোবারাতও এক ধরণের চুক্তি-ভিত্তিক বিবাহ-বিচ্ছেদ। যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ই একে অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন এবং তাঁরা পরস্পর চুক্তি/সম্মতির মাধ্যমে বিচ্ছেদ ঘটান তখন তাকে মুবারত বলে। এক কথায় স্বামী স্ত্রী উভয়ের পারস্পারিক সম্মতিতে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তই মোবারাত (Mubarat)। তবে যেহেতু পারস্পরিক সম্মতিতে তালাক কার্যকর হয়, সেজন্যে এই ক্ষেত্রে প্রতিদান অপরিহার্য নয়। Sayeeda Khanam v. Muhammad Sami, PLD 1952 Lah মামলায় মোবারাত (Mubarat) মাধ্যমে বিচ্ছেদের অন্যতম দিক নির্দেশনা রয়েছে।
খুলা, বিচারিক খুলা এবং Faskh এর ক্ষেত্রে স্ত্রী কোন তালাক উচ্চারণ করে না বরং এই ক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের উদ্যোগ গ্রহণ করে যেটা স্বামী বা আদালত মঞ্জুর করতে পারে।
বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ-বিচ্ছেদ (Dissolution by judicial process)
১। লিয়ান/লিয়্যান/লিয়েন (Lian) বা অভিযোগ
সাধারনত স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর ব্যভিচারের অভিযোগকে(charge of adultery) লিয়ান বলা যেতে পারে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে যদি কোন স্বামী তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের(Fornication/Adultery) অভিযোগ আনেন যা সেই স্ত্রী অস্বীকার করে এবং যা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি, তবে সেই স্ত্রী উক্ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার জন্য মামলা দায়েরের সুযোগ রয়েছে এবং এই মতবাদটি লিয়ান নামে পরিচিত। তবে এ মামলায় আদালত কর্তৃক বিবাহবিচ্ছেদের ডিক্রি জারি না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ চলতে থাকে। [Khatijabi v Umar Sahib AIR 1928 Bom 285]
লিয়ানের জন্য তিনটি পূর্বশর্ত রয়েছে
(Three prerequisites for Lian)
• দম্পতির বিবাহ সক্রিয় অবস্থায় থাক্তে হবে।
• বিবাহের প্রয়োজনীয় শর্তসমূহ পালনপূর্বক বিবাহ চুক্তি অবশ্যই বৈধ হতে হবে।
• স্বামীকে অবশ্যই সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ হতে হবে।
যাহোক, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর অসতীত্বের ওপর এরূপ বদনাম অবশ্যই মুক্ত ও স্বাধীন মনে করতে হবে এবং কোন অবস্থায়ই ভয়, অন্যায় প্রভাব, রাগ, দম্পতির মধ্যে ঝগড়ার কারণে আবেগের তাড়নায় কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারানো অবস্থায় তা করা যাবে না। স্ত্রী ইচ্ছা করলে বিষয়টি আপোষ করতে পারে এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের দাবী পরিত্যাগ করতে পারে। এটা সম্পূর্ণরূপে স্ত্রীর ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
২। ফাস্ক (Faskh)
স্ত্রীর আবেদনের ভিত্তিতে বিচারক বা কাজী কর্তৃক বিবাহ বাতিল ঘোষণা করাকে ফাস্ক বলা হয়। স্ত্রী তার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে হলে তাকে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের ২ ধারায় বর্ণিত যে কোন একটি বা একাধিক কারণ প্রমাণ সাপেক্ষে পারিবারিক আদালতের ডিক্রী দ্বারা বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটাতে হবে। উপরোক্ত আইনে স্ত্রী কর্তৃক আদালতের মাধ্যমে তালাক লাভের জন্য নিম্নলিখিত কারণগুলো স্বীকৃত হয়েছে—
১. চার বছর যাবৎ স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে;
২.দুই বছর যাবৎ স্ত্রীর খোরপোষ দিতে স্বামী ব্যর্থ হলে;
৩. স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে;
৪. স্বামীর সাত বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ড হলে;
৫. কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামী তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে;
৬. স্বামী বিবাহের সময় পুরুষত্বহীন(Impotence or inability to consummate) থাকলে এবং তা মোকদ্দমা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে;
৭. স্বামী দুই বছর যাবৎ পাগল(Mental illness) থাকলে বা কুষ্ঠ ব্যাধিগ্রস্ত বা মারাত্নক যৌনব্যাধিতে আক্রান্ত থাকলে;
৮. নাবালিকা অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ হয়ে থাকলে সাবালকত্ব লাভের পর (১৮ বছর পূর্ণ) স্ত্রী বিবাহ অস্বীকার করলে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হলে এরূপ মোকদ্দমা করা যাবে না।।
৯.নিম্নলিখিত যে কোন অর্থে স্ত্রীর ওপর স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করে থাকলে, যেমন-
ক. অভ্যাসগতভাবে তাকে মারধর করে অথবা আচরণের নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে সংসার-জীবনকে দুর্বিষহ করে তুললে, অথবা
খ. কুখ্যাত স্ত্রীলোকদের সঙ্গে স্বামী মেলামেশা করলে কিংবা বদনামের সঙ্গে জীবনযাপন করলে, অথবা
গ. নৈতিকতাবিহীন জীবন-যাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করার চেষ্টা করলে, অথবা
ঘ. স্ত্রীর সম্পত্তি হস্তান্তর করে দিলে কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির ওপর বৈধ অধিকার প্রয়োগ থেকে নিবারণ করলে, অথবা,
ঙ. স্ত্রীকে তার ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিলে, অথবা
চ. স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকলে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সমান ব্যবহার না করলে।
১০. মুসলিম আইনে বৈধ বলে স্বীকৃত অন্য যে কোন সঙ্গত কারণের উপরও স্ত্রী তালাক চেয়ে মোকদ্দমা করতে পারেন।
উপরের যে কোন এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণে দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিবাহ-বিচ্ছেদ পেতে পারে। আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রী দেয়ার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশটিকে তালাক সংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবেন এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবেন সেদিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্ত হবে।
Leave a comment