প্রশ্নঃ আইন বিজ্ঞানের মতবাদ বলিতে কি বুঝায়? আইন বিজ্ঞানের মতবাদ সংক্রান্ত ধারণার সাম্প্রতিক বিকাশের ব্যাখ্যা দাও। বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর।

উত্তরঃ আইনবিজ্ঞানের মতবাদঃ সাধারণ অর্থে আইনের উৎস, উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে মৌল তত্ত্বের ধারাবাহিক আলোচনা ও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা হচ্ছে আইনবিজ্ঞানের কাজ। কিন্তু এ কার্যে আইনবিশারদগণ ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেননি। তারা নিজ নিজ ধারণা ও মতাদর্শের দৃষ্টিতে এগুলি ব্যক্ত করেছেন। তাই সকলের গ্রহণযোগ্য এবং বিতর্কের ঊর্ধে কোন সংজ্ঞা প্রদান করা সম্ভবপর হয় নি। আইনবিজ্ঞানীদের প্রদত্ত মতামতগুলি শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে এবং এগুলিকেই আইনবিজ্ঞানের মতবাদ বলে। এই মতবাদগুলি প্রধানতঃ নিম্নোক্ত তিনটি শ্রেণীতে বিভক্তঃ 

(১) বিশ্লেষণমূলক মতবাদ (Analytical School) 

(২) ঐতিহাসিক মতবাদ (Historical School)

(৩) নৈতিক মতবাদ (Ethical School)

আইনবিজ্ঞানের মতবাদ সংক্রান্ত ধারণার সাম্প্রতিক বিকাশঃ উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে আইনগত তত্ত্বগুলো মূলত দর্শন, ধর্ম, নীতিবিদ্যা ও রাষ্ট্রনীতির উপজাত (By product) হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে। বড় বড় আইন চিন্তাবিদগণ প্রাথমিকভাবে দার্শনিক, ধর্মযাজক বা রাজনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আইনবিদগণ তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। 

V. D. Mahajan তার Jurisprudence & Legal Theory (5th Edition. p. 497) বইতে লিখেছেন, ‘The shift from the philosopher or Politician’s legal philosophy to lawyer’s legal philosophy has taken place in recent times.” কাজেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবর্তিত মতবাদ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। যদিও তুলনামূলক মতবাদটি সাম্প্রতিককালে বিকশিত হয়েছে তবুও সমাজতান্ত্রিক মতবাদটি বর্তমানে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। 

প্রখ্যাত মার্কিন আইনবিজ্ঞানী ডীন রস্কো পাউন্ড প্রবর্তিত সামাজিক প্রকৌশল মতবাদটি বর্তমানে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের বিভিন্নমুখী স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য। সমাজকে নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করে আইন। সমাজ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান অর্জন করে আইনবিদগণ যে আইন সৃষ্টি করবেন তাতে মানুষের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম সংঘাত এবং বেশি চাহিদা পূরণের একটা প্রয়াস থাকবে। মানুষের কোন কোন স্বাৰ্থ বা চাহিদাকে আইন রক্ষা করবে তা নির্ধারণ করে আইনবিজ্ঞানীরা আদালতকে বিচার প্রশাসনে সহায়তা করতে পারেন। 

মানুষের তিন ধরনের স্বার্থের বিষয় রস্কো পাউন্ড উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে, (১) ব্যক্তি স্বার্থ, (২) গণস্বার্থ ও (৩) সামাজিক স্বার্থ। সামাজিক জীব হিসেবে সংঘবদ্ধ সমাজের প্রয়োজন মেটাতে যথার্থ আইনের প্রয়োজন। ব্রিটিশ কমন ল’য়ের অনমোনিয়তার কারণে সামাজিক চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হলে সেখানে ইকুইটির উদ্ভব হয়। বিবেকের উপর ভিত্তি করে ইকুইটি আদালত বিচার প্রশাসন চালায়। সাম্প্রতিককালে মানবাধিকারের ধারণাটি দ্রুত বিকাশ লাভ করছে এবং মানুষ হিসেবে তার মর্যাদা ও চাহিদা মেটাতে আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। সামাজিক এ চাহিদা মেটাতে আইনবিদগণ সমাজ সম্পর্কে তাদের প্রকৌশলগত জ্ঞান প্রয়োগ করে যথার্থ আইন সৃষ্টির প্রয়াস চালাবেন এটাই সকলের প্রত্যাশা।

বিভিন্ন মতবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ আইনবিজ্ঞানের বিভিন্ন মতবাদগুলোর মধ্যে বিশ্লেষণমূলক মতবাদ, ঐতিহাসিক মতবাদ ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদগুলো সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপঃ 

(১) দেশের প্রচলিত আইনের বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে বিধায় মতবাদটিকে বিশ্লেষণমূলক মতবাদ বলা হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক মতবাদও আইনের অতীত অর্থাৎ বিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ করে থাকে। সামাজিক চাহিদা মেটাতে আইন কতটুকু ফলপ্রসূ সেটা নিয়ে বিশ্লেষণ করে সমাজতান্ত্রিক মতবাদ। তাই বলা যায় যে, বিশ্লেষণ পদ্ধতি বিশ্লেষণমূলক মতবাদের একক অধিকার নয়। অন্যান্য মতবাদেও এর ব্যাপক ব্যবহার হয়।

(২) বর্তমানে প্রচলিত আইনকে নিয়েই চিন্তাভাবনা করে বিশ্লেষণী মতবাদ। এই আইনের আদর্শ বা উদ্দেশ্য নিয়ে এই মতবাদ চিন্তাভাবনা করে না কিংবা এর ঐতিহাসিক পটভূমির দিকেও নজর দেয় না। বরং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু ঐতিহাসিক মতবাদের প্রবক্তরা প্রচলিত আইনের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং এর ধারাবাহিকতা ব্যাখ্যা করে সমাজে কিভাবে তা গৃহীত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে। পক্ষান্তরে, সমাজতান্ত্রিক মতবাদ সমাজের প্রয়োজনেই আইনকে দেখে থাকে । সামাজিক চাহিদা মেটাতে আইনের কার্যকারিতার উপরই এই মতবাদ বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

(৩) বিশ্লেষণমূলক মতবাদে রাষ্ট্রকেই আইনের মূল উৎস বলে গণ্য করা হয়। কেননা, রাষ্ট্রই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের জন্য কোনটি করণীয় এবং কোনটি বর্জনীয় তার নির্দেশ দিয়ে থাকে। কিন্তু ঐতিহাসিক ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদ কোনটাই রাষ্ট্রকে আইনের উৎস বলে মনে করে না। প্রথাকে ঐতিহাসিক মতবাদ আইনের অন্যতম উৎস বলে মনে করে কেননা প্রথার মাধ্যমেই যুগ যুগ ধরে মানুষের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পক্ষান্তরে সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক চাহিদা ও উপযোগিতাকে আইনের উৎস বলে গণ্য সমাজতান্ত্রিক মতবাদ। কেননা, আইনের কার্যকারিতার সঙ্গে আইনের উৎসের সম্পর্ক হচ্ছে অচ্ছেদ্য।

(৪) আজকাল সংসদ তথা রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করে তার কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষণী মতবাদ, কিন্তু এই আইনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সমাজে প্রয়োগ করে আদালত যা সমাজতান্ত্রিক মতবাদের উপজীব্য। কিন্তু সেই আইনের পটভূমি ও এর ধারাবাহিকতা সামাজিক প্রথা লংঘন করছে কিনা তা অনুসন্ধান করে ঐতিহাসিক মতবাদ। 

(৫) বিশ্লেষণপন্থীগণ শুধু পরিপক্ক আইনগত ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে, কিন্তু ঐতিহাসিকপন্থীগণ সমাজের পুরাতন আইনগত ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে বর্তমান আইনের সাথে এর সম্পর্ক স্থাপনে ব্রতী হন। পক্ষান্তরে, সমাজতান্ত্রিক মতাবলম্বীগণ সামাজিক চাহিদা পূরণে বর্তমান আইনের ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি দেন।

(৬) ঐতিহাসিকপন্থীগণ মনে করেন যে, “আইন তৈরি করা হয় না, এটা স্বাভাবিকভাবেই থাকে মানুষ শুধু এটা উদঘাটন করে মাত্র।” কিন্তু বিশ্লেষণ ও “মানুষের প্রয়োজনে আইনের সমাজতান্ত্রিকপন্থীগণের মতে সৃষ্টি হয়।

(৭) বিশ্লেষণী মতবাদে বলে রাষ্ট্র বা সার্বভৌম না থাকলে আইন থাকতে পারে না। কিন্তু ঐতিহাসিক মতবাদ। বিশ্বাস করে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রকাশের পূর্বেই আইনের অস্তিত্ব থাকে। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বলা হয় যে, “মানুষ সমাজবদ্ধ বাস করলেই সামাজিক শৃঙ্খলা, রক্ষার জন্য আইনের সৃষ্টি হয়।

(৮) আইন ও এর প্রয়োগকে আলাদা করে দেখে ঐতিহাসিকপন্থীগণ। কিন্তু প্রয়োগ দ্বারা আইন অস্তিত্বহীন বলে মনে করেন বিশ্লেষণী ও সমাজতান্ত্রিক মতবাদের প্ৰবক্তাগণ।

(৯) বিশ্লেষণী মতবাদে সংবিধি হচ্ছে একটা আদর্শ আইন। ঐতিহাসিক মতবাদে প্রথা এবং সমাজতান্ত্রিক মতবাদে নজীর হচ্ছে আদর্শ আইন।

(১০) ঐতিহাসিকপন্থীদের মতে, প্রথা হচ্ছে আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস। কিন্তু বিশ্লেষণীপন্থীগণ মনে করেন যে, একটা প্রথাকে আইনে রূপান্তরিত হতে হলে এর বৈধতা, সংসদের প্রণীত আইন দ্বারা অথবা বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে বিশ্বাসীগণ মনে করেন যে, যেহেতু সামাজিক মূল্যবোধ পরিবর্তনশীল সেহেতু কোন একটা প্রথাকে সমাজ গ্রহণ করছে না বর্জন করছে তার উপর নির্ভর করছে সেই প্রথা আইনে রূপান্তরিত হবে কিনা।

(১১) বিশ্লেষণ মতবাদে প্রচলিত আইনের ধ্যান- ধারণাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দেয়। ঐতিহাসিক মতবাদে ক্রম বিবর্তনের দৃষ্টিতে প্রথা ও চিরাচরিত কার্যাবলী পর্যালোচনা করে প্রচলিত আইনের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে। সমাজতান্ত্রিক মতবাদে এই আইন সমাজের কোন চাহিদা মেটাতে সক্ষম তা বিশ্লেষণ করে মাত্র।