প্রশ্নঃ সাধারণজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞের অর্থ আলোচনা কর। 

সাধারণজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞের অর্থ (Generalist and Specialist): মানুষ তার নিজের কর্মক্ষেত্রে বিশ্বসভ্যতা ও বহুমুখী উন্নয়নের কারণে একেকজন বিশেষজ্ঞে পরিণত হচ্ছে। বর্তমান সভ্যতার দ্রুতগতির পরিবর্তনশীলতার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে মানুষ এমন সব বিষয়ে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হচ্ছে, যা সম্পর্কে সে কিছুই জানত না। তাই অ্যাপলেবি (Appleby)-এর ভাষায়, “পৃথিবীতে প্রত্যেকেই স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অনুসারে এক একজন বিশেষজ্ঞ।”

পাশাপাশি এ কথা বলা যায় যে, বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ বিষয়ে যেমন মানুষের জ্ঞান এবং বুদ্ধি বেড়েছে, তেমনি সাধারণ অজ্ঞতাও বেড়ে গেছে। সাধারণ কাজের জন্য যে সকল প্রশাসক অন্যান্য প্রশাসকদের তুলনায় বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন তারাই হলেন সাধারণজ্ঞ। অ্যাপলেবি (Appleby)-র মতে, “সাধারণজ্ঞ বলতে যা বুঝায় ইতিহাসের বর্তমান পর্যায়ে এমন কারও অস্তিত্ব নেই।” যদিও সত্যিকার সাধারণজ্ঞ বলতে কেউ নেই, তথাপি এমন লোক রয়েছেন এবং থাকবেন, যারা তাদের অধিকাংশ সমকালীনদের তুলনায় সাধারণজ্ঞ বলে বিবেচিত হবেন। তারা গতিশীল সমাজে সমন্বয়সাধনকারী এবং ক্রমবর্ধমান জটিলতার মধ্যে তারসাম্য রক্ষা করেন।

সাধারণজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞের প্রকৃতি (Nature of Generalist and Specialist): প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সংযুক্ত দপ্তরগুলো সকল দিক দিয়েই সচিবালয়ের অধস্তন। সচিবালয়ের মন্ত্রণালয়ের প্রধানগণ হচ্ছেন সাধারণজ্ঞ প্রশাসক এবং সংযুক্ত দপ্তরগুলোর প্রধানগণ হচ্ছেন টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ। এরূপ বিশেষজ্ঞগণকে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের স্থায়ী সচিবের মধ্যে সে মন্ত্রীর যোগাযোগ করতে হয়। তাদের কাজ হচ্ছে প্রশাসনিক নীতি প্রণয়নে সাধারণজ্ঞ সচিবগণকে টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত পরামর্শ দান করা, কিন্তু তারা নিজেরা সচিবালয়ের মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কাজ করে এরূপ নীতি প্রণয়ন করতে পারেন না। কোন টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞকে সরকারের কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কাজ করার যোগ্য বলে গণ্য করা হয় না এবং বিশেষজ্ঞগণ সাধারণজ্ঞের নিয়ন্ত্রণে থেকে যেতে বাধ্য হয়।

টেকনিক্যাল বা প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞগণ, যেমনঃ প্রকৌশলী, ডাক্তার ইত্যাদি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের যথাযোগ্য স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রায়ই দাবি করে থাকেন। তারা সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে তাদের নিযুক্তি নিষিদ্ধ করার নীতিরও তীব্র বিরোধিতা করেন। তারা অভিযোগ করেন যে, প্রশাসনিক নীতি প্রণয়নে তাদেরকে প্রধান ভূমিকা পালনের সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে এ ব্যাপারে গৌণ ভূমিকাই পালন করার ক্ষমতা দেয়া হয়, তাদের বেতনের হারও কম হয় এবং সাধারণজ্ঞ প্রশাসকগণের তুলনায় তারা স্থায়ীভাবে নিম্ন পদমর্যাদাই লাভ করেন৷

তাদের বক্তব্য এই যে, বর্তমান প্রযুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানের যুগে দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন করতে যে বিশেষ টেকনিক্যাল দক্ষতা ও জটিলতা সম্পর্কে অবহিত থাকা আবশ্যক। তা সম্পর্কে কোন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সাধারণজ্ঞ প্রশাসনিক প্রধান সাধারণত উৎসাহী বা যথাযথভাবে অবহিত নন। ফলে সাধারণজ্ঞ প্রধানের নিকট অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রেরণ কালে বিশেষজ্ঞগণ এদের টেকনিক্যাল দিকগুলো সম্পর্কে তাকে জ্ঞান ও পরামর্শ প্রদান করতে গিয়ে তাদের যথেষ্ট সময় ও কর্মশক্তি ব্যয় করে থাকেন। তাছাড়া, যখন কোন প্রশাসনিক প্রধান বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যান এবং তার স্থলে অপর একজন সাধারণজ্ঞ পদ গ্রহণ করেন, তখন বিশেষজ্ঞগণকে সে জ্ঞান এবং পরামর্শের পুনরুল্লেখ করতে হয়।

এমতাবস্থায় প্রযুক্তিগত বা টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞগণের প্রশাসনিক প্রধান হওয়ার সুযোগ না থাকায় তারা সাধারণজ্ঞগণের অধঃস্তন থেকে যা, যার ফলে তাদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়। বিশেষজ্ঞগণ সাধারণজ্ঞগণের ন্যায় সম-মর্যাদা লাভের জোর দাবি জানায় । তারা মন্ত্রিগণকে যে পরামর্শ দান করেন, তা তাদের পেশাগত, বিশেষ ও টেকনিক্যাল জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উপরই প্রতিষ্ঠিত এবং এ পরামর্শ সম্পর্কে মন্তব্য বা সমালোচনা করার যোগ্যতা কোন সাধারণজ্ঞ প্রশাসকেরই নেই। টেকনিক্যাল দপ্তরগুলোর প্রধানগণ মনে করেন যে, তাদের এবং মন্ত্রিগণের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের বা সম্পর্কের পথে কোন বাধা থাকা উচিত নয়।

প্রশাসকদের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Administrators): বর্তমানে এটি স্বীকৃত যে, প্রশাসনে সাধারণজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ এ দুই শ্রেণীই বিরাজ করছেন এবং দুই-শ্রেণীর ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসনের জনৈক লেখক সুইনি স্টিফেন (Sweeney Stephen ) প্রশাসকদেরকে তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন।

(ক) কার্যভিত্তিক বিশেষজ্ঞ (Functional Specialist): এরা প্রকৌশল, আইন, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি কলাকৌশলগত বা প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে কার্য সম্পাদন করেন।

(খ) প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ (Administrative Specialist): এরা প্রশাসনের একটি বিশেষ দিক বা অংশের বিশেষ পদ্ধতিগত বিষয়ে নিয়মিত কার্য সম্পাদন করেন। যেমন প্ৰশাসনিক রীতিনীতি বিষয়, বাজেট হিসাব এবং পরিকল্পনা সংক্রান্ত৷

(গ) প্রশাসনিক সাধারণজ্ঞ (Administrative Generalist): এরা প্রশাসনিক নীতিনির্ধারণে ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গ। নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন কার্যে এরা হলেন রাজনৈতিক অফিসার বা মন্ত্রিদের পরামর্শদাতা। এঁদের ভূমিকা অনেকাংশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনাসম্পন্ন। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক কর্মচারীকে সুসংগঠিত এবং নির্দিষ্ট কর্মপথে পরিচালিত করেন।

প্রশাসনের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে সাধারণজ্ঞ ভূমিকা বাড়তেই থাকে। অ্যাপলেবি (Appleby) এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, কোন কর্মচারী যতই উপরের দিকে উঠতে থাকবেন ততই তার আগেকার বিশেষ অভিজ্ঞতাগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে কতিপয় উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পেশাদার ব্যক্তি যারা প্রশাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন এটা তাদেরই অভিজ্ঞতার কথা।