প্রশ্নঃ মধ্যযুগের প্রণয় উপাখ্যানধারার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বিবৃত কর৷

অথবা, বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের ধারা আলোচনা কর। 

অথবা, মধ্যযুগে রচিত বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ কর। 

অথবা, মধ্যযুগের ধর্ম শাসিত সাহিত্যধারায় মানবিক আবেদন সৃষ্টিতে রোমান্সমূলক প্রণয়োপাখ্যানসমূহের ভূমিকা পর্যালোচনা কর। 

অথবা, মধ্যযুগে মুসলিম কবিদের রচিত রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান কাব্যধারার মূল্যায়ন কর। 

অথবা, মধ্যযুগের মুসলমান রচিত সাহিত্য নতুন ভাব, চিন্তা, রস ও আত্মবিশ্বাসের এক অপূর্ব নিদর্শন। ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর প্রণয়োপাখ্যানগুলোর পরিচয় দান প্রসঙ্গে এই মন্তব্যের হেতু নির্ণয় কর। 

অথবা, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতাদের পরিচয় দাও এবং প্রধান প্রণয়োপাখ্যানগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্দেশ কর।

অথবা, রোমান্স কাব্যধারার মাধ্যমে মধ্যযুগের সাহিত্য কীভাবে মানবিক উপাদান সমৃদ্ধ হয় তার পরিচয় দাও। 

উত্তরঃ মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের যে ধারায় মুসলমান কবি কর্তৃক প্রেম-সৌন্দর্য, মানবহৃদয়বৃত্তি, চিত্তবিলাস ও মানস সম্ভোগের লীলা প্রকাশিত হয়েছে, সেই অনন্য ধারাই রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। হিন্দু কবিগণের আখ্যানমূলক কাব্যে লৌকিক জীবনের ছায়াপাত থাকলেও তাতে দেবদেবীর মাহাত্ম্য ও পূজারীতি প্রাধান্য পেয়েছে। সেখানে অধিকাংশ মানব চরিত্র দেব-চরিত্র দ্বারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। চাঁদ সওদাগরের মত ব্যক্তিত্বও দেবতার প্রভাব এড়াতে পারে নি। মুসলমান কবির রোমান্স কাব্যে ধর্মের কথা নেই বললেই চলে। উপাখ্যানগুলোতে ইসলামের গৌরব ও মাহাত্ম্য প্রচার করলেও কোথাও দেবত্ব আরোপিত হয় নি— মানব-চরিত্রের কথাই বলা হয়েছে।

প্রণয়োপাখ্যানে পৌরাণিক ঐতিহাসিক লৌকিক রাজ-রাজড়ার কাহিনী থাকলেও সেখানে প্রধান আবেদন মানবপ্রেম। এগুলোতে ধর্ম নেই, জীবন আছে। সুখদুঃখ, বিরহ-মিলনপূর্ণ মানবজীবনের কথা লৌকিক ও অলৌকিক উপাদানের সাথে মিশ্রিত হয়ে আনন্দরসের নতুন ভুবন রচনা করেছে। কাব্যগুলোর বিষয়বস্তু মৌলিক নয়। ইরানের ও ভারতের সূফি কবিগণ আধ্যাত্মিক মার্গের এই তত্ত্বের ভিত্তিতে রোমান্স কাব্য রচনা করেন। তারা রূপক হিসেবে মানবপ্রেম কাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুফিদের ঐশী প্রেমচেতনার কারণে সামন্ত প্রেমের শারীরিকতার স্থলে নর-নারীর শ্বাশত প্রেম এল, প্রেমের পাত্রী নারী স্বীকৃতি পেল। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংগ্রাম সাধনা দিয়ে প্রেমিকাকে পাওয়া তথা প্রেমের আদর্শই রোমান্সের ঘটনা ও কাহিনীর নিয়ন্ত্রক শক্তি।

বাংলার মুসলমান কবিরা ভারত ও পারস্যের সুফি কবিদের কাব্যের অনুবাদ করে এ ধারাটি গড়ে তুলেছেন। মধ্যযুগের অনুবাদ শাখা ভাবে ও ভাষায় বাংলা সাহিত্যের যে সমৃদ্ধি সাধন করেছে, উপাখ্যানগুলো এ অনুবাদের পর্যায়ভুক্ত। তবে উপাখ্যান অনুবাদগুলো মূলত ভাবানুবাদ, এগুলোতে অনুবাদকের মৌলিকত্বের ছাপ রয়েছে। বিদেশি গল্পের অস্থিতে বাংলার রক্তমাংস সংযোজন করায় তা মৌলিকতা পেয়েছে।

বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের পরিধি মধ্যযুগ ধরেই। মধ্যযুগের বাংলা রচনার নিদর্শন চৌদ্দ শতক থেকে। পনের শতকের গোড়াতে ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যের মাধ্যমে এ ধারার প্রথম দ্বার উন্মোচিত হয়। অতঃপর আঠার শতক পর্যন্ত এ ধারার রচনা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে দোভাষী পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে এ ধারার প্রভাব থাকলেও তা ঔজ্জ্বল্য পায় নি। রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের উল্লেখযোগ্য কবি ও কাব্য নিদর্শন নিম্নরূপ-

কাব্য 

কবি

কাল

ইউসুফ-জোলেখা

শাহ মুহম্মদ সগীর 

পনের শতক 

লাইলী-মজনু 

দৌলত উজির বাহরাম খান 

ষোল শতক

বিদ্যাসুন্দর,হানিফা-কয়রাপরী

সাবিরিদ খান

ষোল শতক

সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান

দোনাগাজী চৌধুরী

ষোল শতক

মধুমালতী

মুহম্মদ কবীর

ষোল শতক

সতীময়না লোরচন্দ্রানী 

দৌলত কাজী

সতের শতক

চন্দ্রাবতী

কোরেশী মাগন ঠাকুর 

সতের শতক

পদ্মাবতী

আলাওল

সতের শতক

গুলে-বকাওলী 

নওয়াজিস খান

সতের শতক

রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের উপাদানঃ

প্রেমঃ ভারতের ও পারস্যের সুফি কবি লৌকিক প্রেমকাব্যকে লোকোত্তর সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিকতার জগতে নিয়ে গেছেন। বাঙালি কবি অনুবাদকালে তাদেরই অধ্যাত্ম প্রেমকাব্যকে যথাসম্ভব লৌকিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন।

সৌন্দর্যঃ এ কাব্যে নর-নারীর অঙ্গরূপ ও অঙ্গসজ্জার বর্ণনা রোমান্টিক কবিদের সৌন্দর্য সাধনার প্রধান অংশ ব্যয় হয়। বাকি অংশ ব্যয় হয় বারমাসীর ঋতু বর্ণনায়– প্রাকৃতিক রূপচিত্র অঙ্কনে। তাছাড়া জীবন ও জগৎ থেকে উপমা, রূপক, প্রতীকের ব্যবহারেও সৌন্দর্যপিপাসু কবিমানসের পরিচয় কাব্যদেহে ছড়িয়ে আছে।

যুদ্ধ ও অভিযাত্রাঃ রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের কেন্দ্রীয় বিষয় প্রেম। প্রেমের উৎস নায়ক/নায়িকার অসামান্য রূপ ও গুণ। রূপের পরিচয় দেহ লাবণ্যে ও প্রসাধনে কলায় এবং গুণের পরিচয় বিদ্যায় ও শৌর্যবীর্যে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ নায়ক সামন্ত পতি৷ শ্রেণীস্বার্থে তাকে অন্যান্য বিদ্যার সাথে যুদ্ধবিদ্যা, অশ্ব চালনা, অস্ত্র চালনা ইত্যাদি শিখতে হয় । স্বপ্নে বা লোকমুখে দয়িতের কথা শুনে তার সন্ধানে অভিযাত্রা করে।

অলৌকিকতাঃ প্রত্যেক কাব্যেই কিছু অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত, অবাস্তব ঘটনা বা বিষয় আছে। লৌকিক জ্ঞানে তার কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা যায় না, কিন্তু এ অলৌকিকতা মানবিকতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মুসলমান কবিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান। এই শ্রেণীর কাব্য মধ্যযুগের সাহিত্যে বিশিষ্ট স্থান জুড়ে আছে। মানব- মানবীর প্রেমকাহিনী রূপায়িত হওয়ায় যেমন সাহিত্যে বাস্তববোধের সূত্রপাত ঘটেছে, তেমনি সাহিত্যধারায় ব্যতিক্রমের সৃষ্টি হয়েছে।

অলৌকিক রূপকথার প্রভাবে এসব কাব্যের চরিত্রে অস্বাভাবিকতা, ঘটনায় অবাস্তবতা আছে। মানব চেতনার মর্মস্পন্দন, মুক্তিবিলাস, স্বচ্ছন্দগতি ও মর্মলীলা আছে বলেই এগুলো একান্তভাবে মানবকাব্য নয়, রোমান্টিক কাব্য।

বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানগুলোর একটা অংশ আরাকান রাজসভার কবিদের সৃষ্ট। তাদের বিস্ময়কর কবি প্রতিভা স্বতন্ত্র মর্যাদায় গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান রাজসভার বাইরেও এ ধারার চর্চা হয়েছে।

ইউসুফ-জোলেখাঃ বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি শাহ মুহম্মদ সগীর গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩–১৪০৯ খ্রিঃ) ইউসুফ-জোলেখা রচনা করেন। এ কাব্যে সুপ্রাচীন প্রণয়কাহিনী উপজীব্য করা হয়েছে। ফেরদৌসী এ নামে রোমান্স রচনা করেছিলেন, মুহম্মদ সগীরের কাব্যের সঙ্গে সে কাব্যের কোন মিল নেই। কবি দেশি ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে চাইলেও তা মানবীয় প্রেমকাহিনী হিসেবেই রূপলাভ করেছে। তবে ফেরদৌসীর মত সগীরের কাব্যেও ইউসুফ-জোলেখা ভাবুক-ভাবিনী অর্থাৎ আত্মা ও পরমাত্মা। তবে সগীরের কৃতিত্ব যে অবলীলাক্রমে গল্প লিখেছেন। কাব্যে কবিপ্রতিভার মৌলিকতার নিদর্শন রয়েছে। ইবিন আমিন ও বিধুপ্রভার প্রণয় সগীরের নিজস্ব। কাব্যটিতে বিদেশি আবহ নেই বললেই চলে। বাংলার আবহই এ কাব্যের প্রাণ। নগীর ব্যতীত ইউসুফ-জোলেখা কাব্যের অন্যান্য রচয়িতা – আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোপান সফাতউল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকীর মুহম্মদ।

পাইলী-মজনুঃ দৌলত উজির বাহরাম খানের এ কাব্যটি বাংলা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান ধারায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কবি চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদের অধিবাসী, দৌলত উজির তাঁর পিতার অর্জিত উপাধি। বিভিন্ন গবেষকের মতভেদে কাব্যটি ১৫৬০–১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা।

কাব্যটি ফারসি কবি জামীর লাইলী-মজনু কাব্যের ভাবানুবাদ, বিশ্বখ্যাত লাইলী-মজনুর প্রেমকাহিনী। কিন্তু এ কাব্যের কাহিনীর উৎস আরবীয় লোকগাথা। কাহিনী অনুকরণ করলেও কবিত্বশক্তি প্রকাশে যথেষ্ট সার্থকতা পরিলক্ষিত হয়। ড. আহমদ শরীফের ভাষায় এ কাব্যের পাঁচটি বৈশিষ্ট্য একে অক্ষয় করেছে—

১. সার্থক ট্র্যাজেডি, ২. অশ্লীলতামুক্ত, ৩. মানবিকতা, ৪. লোকশ্রুত কাহিনীর স্বাধীন অনুকৃতি, ৫. অলৌকিকতামুক্ত প্রায় বাস্তব। তাছাড়া ভাষার সরলতা, রূপ বর্ণনা, উপমা, রূপক, অলঙ্কার ইত্যাদিতে লৌকিক জগতের কাছাকাছি নেমে এসেছেন। কাব্য ও কবিত্বের সকল গুণে বাহরাম খান মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের কবিকুল শ্রেষ্ঠ।

বিদ্যাসুন্দর ও সাবিরিদ খান চট্টগ্রামের অধিবাসী। ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য রচনায় কবি প্রচলিত কাহিনী অবলম্বন করেছেন। মানবীয় রস এ কাব্যে স্থান পেয়েছে। ভাষা ও উপমা অলঙ্কারের সংযত ব্যবহারে আর পদলালিত্য ও ছন্দ-সৌন্দর্যে গোটা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে সাবিরিদ খানের বিদ্যাসুন্দরের দ্বিতীয় জুড়ি নেই।

হানিফা-কয়রাপরী : কবির অন্যতম এ কাব্যটি জঙ্গনামা জাতীয় যুদ্ধকাব্য হলেও প্রেমকাহিনীর জন্য তা রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের পর্যায়ভুক্ত। কাব্যটি খণ্ডিত আকারে পাওয়া গেছে বলে কাব্যটির নাম নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। হযরত আলীর পুত্র হানিফা কাহিনীর নায়ক, জয়গুনের সঙ্গে হানিফার পরিণয়— যুদ্ধ, ইসলাম ধর্মে দীক্ষা ইত্যাদি ছাড়াও হানিকার সাথে কয়রাপরীর প্রণয় কাহিনী এ কাব্যে বর্ণিত। কাব্যটিতে যুদ্ধ থাকলেও প্রণয় কাহিনী বিসর্পিল গতিতে অগ্রসর হয়ে রোমান্সের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে এ কাব্যে আর্টের স্বাদ নেই, কবি এখানে কথকের ভূমিকায়। সকল ঘটনাকে অনিবার্য সম্পর্ক বাঁধতে পারে নি। ভাষা দুর্বল, স্থূল।

সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামালঃ দোনাগাজী চৌধুরী, আলাওল, ইব্রাহিম ও মালে মাহমুদ এ প্রেমকাহিনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন। আলাওলের কাব্যই সমধিক পরিচিত। দোনাগাজীর পাণ্ডুলিপিটি খণ্ডিত, তিনি ষোড়শ শতকের কবি। এ কাব্যের আদি উৎস আরব্য উপন্যাস বা (আলেফ লায়লা)। ফারসি কাব্য অবলম্বনে দোনাগাজী এ কাব্য রচনা করেন। পরীরাজকন্যা বদিউজ্জামালের ছবি দেখে রাজপুত্র সয়ফুল তার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তাদের বিয়ে হয়। রূপকথাধর্মী অলৌকিক ঘটনা ও চরিত্রে কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কবি মূল কাহিনীর প্রতি অন্ধ অনুকরণ করেন নি। তবে কাব্যে যথেষ্ট অশ্লীলতা রয়েছে।

মধুমালতীঃ মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী ছাড়া অন্য কোন পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় না। ‘মধুমালতী’র পাণ্ডুলিপিটি চট্টগ্রামে পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের কিছু আঞ্চলিক শব্দও এতে রয়েছে। তবে কাব্যটি ১৫৮৮ সালে রচিত বলে গবেষকদের ধারণা। মধুমালতীর কাহিনীর উৎস ভারতীয় উপাখ্যান। তবে সংস্কৃতে এ নামে কোন কাব্য নেই। হিন্দি ও ফারসিতে এ নামে বেশ কিছু কাব্য পাওয়া যায়। হিন্দি কবি মনঝনের অনুকরণে মুহম্মদ কবীর তার কাব্য রচনা করেছেন।

কাব্যে বাস্তব অবাস্তব উভয় শ্রেণীর কাহিনী স্থান পেয়েছে। কঙ্গিরা রাজ্যের রাজা সূর্যভানের পুত্র মনোহর মহারসরাজ্যের রাজকন্যা মধুমালতীর প্রতি পরীজাদীদের ষড়যন্ত্রে প্ৰণয়াসক্ত হয়। ক্ষণিক মিলনের পরে তাদের বিচ্ছেদ হয় । দীর্ঘ বিরহের পর তাদের মিলন হয়। কাব্যে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। কবি প্রেমচিত্র অঙ্কনে সার্থক। রূপ -ও প্রেমের বর্ণনায় কবির সংযমবোধ মধ্যযুগে দুর্লভ, সৌন্দর্য বর্ণনায় কবি ঋদ্ধ। কবির নিজস্বতা স্পষ্ট, অন্ধ অনুকরণ নয় এর নিজস্ব শক্তিতে কাহিনী সমৃদ্ধ। ভাষা, উপমা, রূপক ললিত মধুর। এ কাহিনী অবলম্বনে সৈয়দ হামজা, মুহম্মদ চুহর, শুকুর মাহমুদ, গোপীনাথ দাস প্রমুখ কাব্য রচনা করলেও তাদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ নয়।

গুলে-বকাওলীঃ বাংলায় গদ্যে ও পদ্যে এ কাহিনী পরিবেশিত হয়েছে এবং বিংশ শতাব্দীতেও সাহিত্য রূপ লাভ করায় এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা প্রমাণিত। বাংলা, হিন্দি, ফারসি, উর্দু ইত্যাদি ভাষায় এ কাব্য রচিত।

গুলে-বকাওলীর রচয়িতা হিসেবে নওয়াজিস খান খ্যাতিমান। তিনি চট্টগ্রামের লোক। চট্টগ্রামের জমিদারের নির্দেশে তিনি এ কাব্য রচনা করেন।

ইজ্জতুল্লাহ নামে জনৈক বাঙালি লেখক ফারসি ভাষায় এ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি হিন্দি থেকে ভাষান্তরিত। গদ্যে রচিত এ গ্রন্থের কাহিনী নওয়াজিস খান কাব্যে রূপ দিয়েছিলেন। কাব্যের কাহিনী প্রেমমূলক। রাজপুত্র তাজুলমুলুক পিতার অন্ধত্ব দূর করতে পরীরাজকন্যা বকাওলীর বাগানে ফুলের সন্ধানে যায়। বাধা অতিক্রম করে ফুল সংগ্রহ করে এবং নিদ্রিত বকাওলীর সাথে অঙ্গুরীয় বিনিময় করে প্রেমপত্র লিখে দেশে ফেরে। বকাওলী বহু কষ্টে তাজুলের সঙ্গে মিলনে সক্ষম হয়। এর সঙ্গে উপকাহিনী, অলৌকিকতা মিশেছে। কাহিনীর সাবলীলতা ও রূপ বর্ণনায় কবির দক্ষতা রয়েছে। মোহাম্মদ মকীমের ‘গুলে- বকাওলী’-ও শিল্পসফল।

সতীময়না লোরচন্দ্রানীঃ এ কাব্যে প্রেমচিত্রের বর্ণনায় দৌলত কাজী উচ্চ রুচির পরিচয় দিতে পারেন নি। লোরচন্দ্রানীর দেহ সম্ভোগের চিত্রটি সম্পূর্ণ অশ্লীল। কাব্যের কাহিনী পরিকল্পনায় কাজী দৌলতের অভিনবত্ব নেই, কিন্তু স্বতন্ত্রতা রয়েছে। কাহিনীটিকে বাস্তবতা ও মানবিকতার ভিত্তি দেওয়ার জন্য তিনি পারতপক্ষে রূপকথার রোমান্স এবং অলৌকিকতার অংশ বর্জন করেছেন। কিন্তু নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। 

চন্দ্রাবতীঃ কোরেশী মাগনের ভণিতায় চন্দ্রাবতী কাব্যের মাত্র একখানা পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। পাণ্ডুলিপিখানি আদ্যন্ত খণ্ডিত। এ কাব্যের প্রাচীন উৎস জানা যায় না। এটি কবির নিজস্ব সংগ্রহ হতে পারে। দেশীয় রূপকথা কবির প্রধান অবলম্বন ছিল। কাহিনীতে বিদেশি গল্পের উপকরণও রয়েছে। চন্দ্র সেনের পুত্র বীরভান, সরন্দ্বীপের রাজকন্যা চন্দ্রাবতী বীরভানের চিত্ররূপ দেখে প্রণয়তাপিতা হয়। বীরভান চন্দ্রাবতীর ছবি দেখে মোহিত হল। কাহিনীতে ঘটনা বৈচিত্র্য আছে কিন্তু অভিনবত্ব নেই। নানা শাখা যুক্ত হয়ে কাহিনীর গতি শিথিল হয়েছে। অলৌকিকত্বের আধিক্য মানবিকতাকে ক্ষুণ্ন করেছে। দীপ্তিহীন বর্ণনায় কবির পাণ্ডিত্য ছিল কিন্তু শিল্পত্ব ছিল না।

পদ্মাবতীঃ আলাওলের পদ্মাবতী এ শাখার অনবদ্য শিল্পকর্ম। হিন্দি কবি জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ থেকে কাহিনী গ্রহণ করলেও এ কাব্যে আলাওলের স্বকীয়তা ও বিশেষত্ব পরিলক্ষিত হয়। কাহিনী চরিত্র পরিবেশ— সকল ক্ষেত্রেই কবির নিজস্বতা ছিল। সিংহল দ্বীপের রাজা গন্ধর্ব সেনের কন্যা পদ্মাবতী চিতোরের রাজা চিত্রসেনের পুত্র রত্নসেনের প্রণয় কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। কাহিনী গতানুগতিক হলেও রূপ বর্ণনা, ভাষার সাবলীলতা, পাণ্ডিত্য কবির কাব্যকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছে।

উপসংহারঃ উপসংহারে বলা যায় যে, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যানের ধারা বিশেষ মাত্রা সংযোজন করেছে। উপাখ্যানের কাহিনী দেশি-বিদেশি যাই হোক কবির শিল্পবোধ, মানবতা এ ধারাকে অভূতপূর্ব স্বাদ ও মর্যাদা দিয়েছে।