অথবা, জাবারিয়াদের পরিচয় দাও। তাদের মুলনীতি আলোচনা কর।
অথবা, জাবারিয়া পরিচয় উল্লেখপূর্বক তাদের মুলনীতি আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর পুরানো সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব কলহ, হিংসা বিদ্বেষ প্রভৃতি বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মুসলমানগণ কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে নিজেরাই বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন দল-উপদল বা সম্প্রদায় সৃষ্টি হয়। এ সম্প্রদায়ের মধ্যে জাবারিয়া সম্প্রদায় অন্যতম।
জাবারিয়া সম্প্রদায়ঃ আরবি ‘জবর’ শব্দ থেকে জাবারিয়া শব্দটি এসেছে। এর অর্থ বাধ্যতা, অদৃষ্ট বা নিয়তি। এ সম্প্রদায়ের মতে, মানুষের ইচ্ছা বা কর্মের স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই। মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতায় অস্বীকৃতি এবং আল্লাহর স্বেচ্ছাচারে বিশ্বাস থেকেই জাবারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব। মানুষ সম্পূর্ণরূপে অদৃষ্ট বা নিয়তির অধীন। নিয়তি বা অদৃষ্টের কাছে মানুষ সম্পূর্ণরূপে অসহায়। আল্লাহ মানুষের অদৃষ্টে বা ভাগ্যে যা রাখেন তাই হয়। সৎ-অসৎ সমস্ত কাজই মানুষ আল্লাহর ইচ্ছাতেই করে। তাই জাবারিয়াদের মতে, মানুষকে তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী করা যায় না। মুসলিম দর্শনে এ সম্প্রদায় অদৃষ্টবাদী দার্শনিক সম্প্রদায় নামে পরিচিত। অদৃষ্টবাদী এ জাবারিয়া সম্প্রাদায়ের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন জাহান বিন সাফওয়ান (মৃত্যু ৭৪৫ খ্রি.)। এ মতবাদ উমাইয়া শাসন আমলে বেশ প্রসার লাভ করে। সাফওয়ানের মতে, আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তাই মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই।
জাবারিয়াদের মৌলিক বিশ্বাসঃ জাবারিয়াদের কিছু মৌলিক বিশ্বাস রয়েছে যা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা নেইঃ জাবারিয়াদের মতে, প্রত্যেক কাজ আল্লাহর কাছ থেকে আসে। মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী নয়। তাই মানুষের কোনো কাজ করার শক্তি নেই। এমনকি কাজ করার ইচ্ছা বা স্বাধীনতাও নেই।
২. আল্লাহর সার্বভৌমত্বঃ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এই মানুষ সম্পূর্ণরূপে মহান আল্লাহর সার্বভৌম শক্তির অধীন। মানুষের পুরস্কার ও শাস্তি আল্লাহর সার্বভৌম শক্তির অধীন। এখানে মানুষের কিছুই করার নেই।
৩. আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিতঃ জাবারিয়ারা আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার কথা বলে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতাকে রক্ষা করেছেন ঠিকই কিন্তু এতে করে তারা মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ক্ষুণ্ন করেছেন। তাদের মতে, জগতের প্রতিটি ঘটনা আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত নির্দেশে সংঘটিত হয়। সুরা আল ইমরানের ২৬নং আয়াতে ইরশাদ করেন, “তিনি যাকে ইচ্ছা সুপথে পরিচালনা করেন”। জাবারিয়াগন এ আয়াতের ভিত্তিতে তাদের মতবাদ প্রকাশ করে থাকেন।
৪. পুরস্কার বা শাস্তি আল্লাহর ইচ্ছাধীনঃ জাবারিয়াগণ বলেন, আল্লাহ যাকে খুশি মার্জনা করবেন এবং যাকে খুশি শাস্তি দিবেন। কারণ তিনি সর্বব্যাপারে যা খুশি তা করতে সমর্থ। কেননা পবিত্র কোরআন শরিফের সুরা আল বাকারার ২৮৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, তিনি (আল্লাহ) যাকে খুশি ক্ষমতা দান করেন এবং যাকে খুশি শাস্তি দান করেন। কারণ তিনি সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
৫. মানুষের কর্মের স্বাধীনতাঃ মানুষের কর্মের স্বাধীনতা সম্পর্কে জাবারিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে দুই ধরনের মতবাদ পরিলক্ষিত হয়। গোঁড়া জাবারিয়া দলের মতে, কোনো অর্থেই মানুষ কাজ করে না। অথবা, মানুষের কাজের শক্তি আছে বলা যায় না। ইচ্ছা শক্তি আছে কিন্তু সে শক্তি মানুষের কাজের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করে না।
৬. মানুষ জড়বস্তুর ন্যায়ঃ জাবারিয়াদের কট্টরপন্থিদের মতে, মানুষ ও জড়বস্তুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জড়বস্তুর মধ্যে আল্লাহ তায়ালা যেমন ক্রিয়া শক্তি সঞ্চার করেন, তেমনিভাবে তিনি মানুষের মধ্যেও ক্রিয়া সঞ্চার করেন।
৭. মিরাজ সম্পর্কে ধারণাঃ মিরাজ সম্পর্কে জাবারিয়াদের ধারণা হলো, জাগ্রত অবস্থায় ও সশরীরে মিরাজ সংঘটিত হয়নি। বরং ঘুমন্ত অবস্থায় স্বপ্নযোগে মিরাজ সংঘটিত হয়েছে। তাদের ধারণা, মানুষের পক্ষে অল্প সময়ের মধ্যে সশরীরে ও জাগ্রত অবস্থায় মহাশূন্য, সাত আসমান, জান্নাত, জাহান্নাম, আরশ প্রভৃতি ভ্রমণ করা সম্ভব নয়।
৮. জানাজার নামাজঃ জাবারিয়াদের মতে, জানাজার নামাজ ওয়াজিব বা আবশ্যক নয়। কারণ মৃত ব্যক্তির ইহলৌকিক কার্যকলাপ তার স্বেচ্ছাচারিতায় যেহেতু কোনো কাজ সম্পাদন হয়নি; যার দরুন তার মৃত্যুর পর নাজাত বা মুক্তির জন্য জানাজার নামাজ পড়া আবশ্যক নয়। আল্লাহর ইচ্ছানুসারে তাকে জান্নাত বা জাহান্নাম দেওয়া হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জাবারিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ইসলামের স্বাভাবিক জীবনধারায় এক চরমপন্থি চিন্তা চেতনা সঞ্চার করে। মানুষকে আল্লাহ বিবেক দান করেছেন এবং তার উপর কিছু কাজ ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নত করেছেন। জাবারিয়া সম্প্রদায় সেগুলোকে অস্বীকার করে ইচ্ছাধীন জীবনযাপনের পক্ষপাতী। তাই তাদেরকে আমরা সঠিক পথের অনুসারী বলতে পারি না।
Leave a comment