অথবা, মুসলিম চিন্তার ইতিহাসে কারা মুরজিয়া হিসেবে পরিচিত? তাদের মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দাও।

অথবা, মুরজিয়াদের পরিচয় দাও। মুরজিয়া সম্প্রদায়ের মতবাদগুলো আলোচনা কর।

অথবা, মুরজিয়াদের পরিচিতি উল্লেখপূর্বক তাদের মতবাদ লিখ৷

ভূমিকাঃ ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে মুসলমানদের মধ্যে প্রভেদের সৃষ্টি হয়েছে। কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বিষয় যা সম্পর্কে মানুষের রয়েছে অস্পষ্ট জ্ঞান, তার উপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মত ও পাল্টা মত। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মুসলিম চিন্তাবিদগণ ধর্মীয় নীতিসমূহ ও প্রজ্ঞার নির্দেশাবলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু মতবিরোধকে কেন্দ্র করে দার্শনিক আলোচনা থেমে থাকেনি। এর ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে মুরজিয়া, জাবারিয়া, কাদারিয়া, মুতাজিলা প্রভৃতি সম্প্রদায়ের।

মুরজিয়া ‘সম্প্রদায়’: উমাইয়া শাসন আমলে খারিজি ও শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব। এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আবদুল্লাহ বিন আমর নামে একজন সহনশীল ধর্মতত্ত্ববিদ। মুরজিয়া চিন্তাবিদদের অন্যতম সমর্থক ছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ)। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ফিকর-এ আকবর’ এ মুরজিয়া মতবাদের সমর্থনে বক্তব্য রাখেন। মুরজিয়াদের মূলনীতি ছিল সহনশীলতা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটলেও পরবর্তীতে এটা একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীতে পর্যবসিত হয়। ‘মুরজিয়া’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘মুরজা’ শব্দ থেকে। আর ‘মুরজা’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘আরজা’ থেকে। এর অর্থ স্বাগত বা মুলতুবি। তাই শাব্দিক অর্থে মুরজিয়া সম্প্রদায় বলতে এমন সব চিন্তাবিদকে বুঝায়, যাদের অনুসারিগণ মনে করেন যে, হাশরের দিনে আল্লাহর দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে পাপী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত কোনো রায় দেওয়া স্থগিত রাখতে হবে। এ যুক্তিতে মুরজিয়াগণ অভিমত ব্যক্ত করেন যে, উমাইয়া শাসকগণ যদি কোনো পাপ করে থাকেন তাহলে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই তাঁদের বিচার করবেন। তাই উমাইয়াদের কাফের বলা ঠিক নয়। সুতরাং, উমাইয়া শাসকদের শাসনের বৈধতা প্রমাণের জন্যই মুরজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব।

মুরজিয়াদের মূলনীতিসমূহঃ মুরজিয়া সম্প্রদায়ের সময় যেসব মূলনীতি আবির্ভূত হয়েছিল নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ 

১. আল্লাহর ও তার রসুলের প্রতি ইমানঃ কোনো মুসলিম আল্লাহ ও তার রসুলের প্রতি ইমান আনার পর সে যতই গুনাহই করুক না কেন তাকে কাফের বলা যাবে না। কারণ শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালাই তাদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

২. সকল মাজহাবের মুসলমান একই সমাজের অন্তর্গতঃ সকল সম্প্রদায় বা মাজহাবের মুসলমান একই সমাজের অন্তর্গত। একজন মুসলিম অপর মুসলিমের সাথে সংঘর্ষ থেকে বিরত থাকবে।

৩. খোলাফায়ে রাশেদিনের বৈধতাঃ মুরজিয়াগণ খোলাফায়ে রাশেদিনের সকল খলিফাকে স্বীকার করেন। তাদের মতে খোলাফায়ে রাশেদিনের সকল খলিফাই উন্নত চরিত্রের অধিকারী ও সদাশয় ছিলেন। ফলে তারা খোলাফায়ে রাশেদিনকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের কাজ কর্ম ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে একত্মতা ঘোষণা করেন।

৪. উমাইয়া শাসনকে স্বীকৃতি প্রদানঃ মুরজিয়াদের মতে, উমাইয়া শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া মুসলমানদের কর্তব্য। তবে কেউ অমান্য করলেও তাকে কাফের বলা যাবে না উমাইয়াদের গুনাহের বিচার কিয়ামত পর্যন্ত স্থগিত থাকবে।

৫. পাপের মাধ্যমে ইমানের ক্ষতি হয় নাঃ কোনো কোনো চরমপন্থি মুরজিয়া এমনও করে যে, বিশ্বাস অন্তরের ব্যাপার। এতে মৌখিক স্বীকৃতি ও বাহ্যিক অনুষ্ঠান অপরিহার্য নয়। তাদের মতে, ইমান থাকলে পাপ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

৬. কবিরা গুনাহঃ তাদের মতে কবিরা গুনাহ যদি শিরকের পর্যায়ভুক্ত না হয় তবে কোনো মুসলমান চিরদিন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে না। সার্চ দিন কবিরা গুনাহ তওবার কারণে মাফ হয়ে যেতে পারে।

৭. আল্লাহর মোহাব্বতের উপর গুরুত্বারোপঃ মুরজিয়ারা আল্লাহর ভয়ভীতির পরিবর্তে আল্লাহর মোহাব্বতের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করেন। তাদের মতে, আল্লাহ ভীতি মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসাই তার কাছে টেনে আনে।

৮. পাপ মোচনঃ মুরজিয়াদের মতে, তাওবা দ্বারা এবং পাপ কার্য পুনরায় না করার প্রতিশ্রুতি দ্বারা মুমিন তার পাপ মোচন করতে পারেন।

৯. চরমপন্থা পরিবর্জনঃ মুরজিয়া সম্প্রদায় সর্বদা চরম পন্থা পরিবর্জন করেছে। চরম অদৃষ্টবাদের প্রভাবাধীন মানুষকে আশ্বাস প্রদান করেছে।

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, মুরজিয়াগণ উমাইয়া শাসনের প্রতিক্রিয়ায় সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেও অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁরা ধর্মীয় সম্প্রদায়ে রূপান্তরিত হয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় মূলনীতি প্রকাশ করে।