প্রশ্নঃ বিকেন্দ্রীকরণ (Decentralization) কি? বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্য ও বিকেন্দ্রীকরণের পদ্ধতিসমূহ বর্ণনা কর।  


ভূমিকাঃ সুষ্ঠু প্রশাসনিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষমতার অবস্থান এবং হস্তান্তর দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতা এককেন্দ্রিক বা বিকেন্দ্রিক উভয়ই হতে পারে। এ উভয়কেন্দ্রিক ক্ষমতা দ্বারা প্রশাসন দক্ষভাবে পরিচালিত হয়। তাই বলা যায়, প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এতদুভয়ই বহু প্রচলিত কথা। প্রশাসনের ইতিহাসের সূচনালগ্নে শুধু কেন্দ্রীয় শাসনই প্রচলিত ছিল। কিন্তু যুগের পরিবর্তনে বৃহৎ রাষ্ট্রের ধারণার পাশাপাশি এর প্রশাসন যন্ত্রও ব্যাপকতা লাভ করে আর তখনই দেখা দেয় বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা। তাছাড়া সুষ্ঠু ও মজবুত শাসনের স্বার্থে তা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। এমনকি শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসনেই নয় পরবর্তীকালে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও বৃহৎ যৌথ কারবারসমূহে প্রশাসন ও তার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। আর বর্তমানে প্রশাসন ও তার কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ লোক প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের অন্যতম।

বিকেন্দ্রীকরণের সংজ্ঞা (Definition of Decentralization): প্রশাসনিক বিজ্ঞানীগণ বিকেন্দ্রীকরণের উপর পর্যাপ্ত গবেষণা ও চর্চা অব্যাহত রেখেছেন। তারই ফলশ্রুতিতে তারা বিকেন্দ্রীকরণের যে সকল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন তাতে বিভিন্ন দিকের প্রতি লক্ষ্য করা যায়। নিচে বিকেন্দ্রীকরণের সংজ্ঞা আলোচনা করা হলোঃ

(ক) সাধারণ সংজ্ঞাঃ সাধারণভাবে প্রশাসনিক সংস্থার কার্যাদি ও দায়িত্বসমূহ তার কেন্দ্রে বা কেন্দ্রীয় সংস্থার উপর ন্যস্ত না থেকে বিভিন্ন অধস্তন সংস্থাসমূহ বা কেন্দ্ৰসমূহে অথবা স্থানীয় বা আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের উপর হস্তান্তর করা হলে এমন প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণকৃত প্রশাসন বলা হয়ে থাকে। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কিছু ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে থাকে এবং বাকি সমুদয় ক্ষমতা কেন্দ্রের বাইরের উপকেন্দ্রগুলোর হস্তে ন্যস্ত হয়।

(খ) প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ প্রশাসন বিষয়ে বিজ্ঞ পণ্ডিতমহল প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের যে সকল সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, তার মধ্যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিচে উপস্থাপন করা হলোঃ

অধ্যাপক ত্যালেন (Prof. Allen) বলেন, “কেন্দ্র হতে প্রয়োগ করা সম্ভব এমন কর্তৃত্ব ব্যতীত আর সকল কর্তৃত্বের সর্বনিম্ন স্তরে ভারার্পণের নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণ বলা হয়।

এল ডি. হোয়াইট (L. D. White) বিকেন্দ্রীকরণের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “The process of decentralization denotes the transfer of authority, legislative, judiciary, or administrative from a higher level of government to a lower.” অর্থাৎ ‘বিকেন্দ্রীকরণ বলতে বুঝায় আইন, বিচার বিভাগীয় এবং প্রশাসনিক কর্তৃত্ব সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থেকে নিম্ন পর্যায়ে স্থানান্তর।

মাওউড (Mowhood) বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে এভাবে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, “Decentralization as a structure of government where bodies are created at the local level separated by law from the national center in which local representatives are given formal power to decide on a range of public matter.” অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে কেন্দ্রের কাজের বিভিন্ন দিক যেমনঃ পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি হস্তান্তর; কিন্তু এ হস্তান্তর প্রক্রিয়াশ অবশ্যই একটি আইনগত ভিত্তি থাকতে হবে।

অধ্যাপক ডুয়েট ওয়াল্ডো (Dwight Waldo)-এর অভিমত হলো, “Decentralization denotes a tendency where administration and responsibility are delegated from the central authority to regional and local units to suit the particular local conditions.” অর্থাৎ বিকেন্দ্রীকরণ এমন এক প্রবণতা নির্দেশ করে যেখানে প্রশাসন ও দায়িত্ব কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হতে আঞ্চলিক ও স্থানীয় সংস্থাসমূহ নির্দিষ্ট স্থানীয় অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে হস্তান্তর করা হয়।

অধ্যাপক ফেয়ল (Prof. Fayol) বিকেন্দ্রীকরণের এক সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞায়নে বলেছেন যে, “অধীনস্থ কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের গুরুত্ব করাই বিকেন্দ্রীকরণের উদ্দেশ্য।”

বিকেন্দ্রীকরণের বৈশিষ্ট্যসমূহ (Characteristics of Decentralization): 

আধুনিক প্রশাসনে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের হস্তান্তর বা স্থানান্তরের মধ্যে কতিপয় বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপঃ

১। বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় জাতীয়করণকৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে প্রত্যন্তের সংগঠনের কাছে বিভাজন করে অর্পণ করা হয়। ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এ ক্ষমতার বণ্টন বা বিভাজন কর্ম সম্পাদন করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায় স্থানীয় নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে এবং সীমিত আঞ্চলিক আনুগত্য থেকে জাতীয় আনুগত্যবোধ জাগ্রত হয়। অর্থাৎ সীমিত গণ্ডির স্থানীয় জনগণ ব্যাপক জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়।

২। বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত, আঞ্চলিক সংগঠন বা সংস্থাগুলো গ্রহণ করে।

৩। বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে স্থানীয় সংগঠনগুলো দায়িত্বশীল একক হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ পায়। ফলে স্থানীয় জনগণের চাহিদা, রুচি ও প্রয়োজন অনুসারে নতুন প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে স্থানীয় সংস্থাসমূহ।

৪। রাষ্ট্রের বহুমুখী কাজের ব্যাপকতার ফলে জনগণের সুবিধামত সেবা প্রদান করা কেন্দ্ৰীয় প্রশাসনের পক্ষে বর্তমান সময়ে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পক্ষে দেশের দূর দূরান্তে কর্মরত অধস্তন কর্মচারীদের তদারক বা নিয়ন্ত্রণ করাও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্থানীয় সংস্থাকে দায়িত্বের সাথে সংগতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।

৫। স্থানীয় সংগঠনগুলোর বিকাশের সাথে সাথে এগুলোর স্বনির্ভর হওয়া ও বিভিন্ন কাজের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে সুষ্ঠু ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে।

বিকেন্দ্রীকরণের পদ্ধতি (Process of Decentralization):

প্রশাসন বিজ্ঞানীগণ প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের দুটি পদ্ধতির উল্লেখ করেছেন। যথাঃ (১) অঞ্চলভিত্তিক প্রশাসনের অফিসসমূহে সরকারি ক্ষমতা ও কার্যাবলির বিকেন্দ্রীকরণ এবং (২) অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় সরকারের নিকট ক্ষমতা ও কার্যাবলির হস্তান্তরকরণ। এ উভয় পদ্ধতিই পরস্পর পৃথক ও স্বতন্ত্র। নিচে পদ্ধতি দু’টি আলোচনা করা হলোঃ

১। অঞ্চলভিত্তিক প্রশাসনঃ কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার আঞ্চলিক ও স্থানীয় সংস্থাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে। কেন্দ্র থেকে আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মচারী প্রেরিত হয় এবং এরা কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ সম্পাদন করেন। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব কাজ সুষ্ঠুভাবে পালন করার নিমিত্ত পর্যাপ্ত কর্তৃত্ব এবং দায়িত্ব পেয়ে থাকেন। তবে একথা ঠিক যে, কেন্দ্রীয় সরকার বা যে মন্ত্রণালয় কর্তৃক তাঁদের উপর যে ক্ষমতা অর্পিত হয়েছে তা কোনভাবেই চূড়ান্ত নয়৷

২। অঙ্গরাজ্য এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের উপর ক্ষমতা প্রদানঃ আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত অঙ্গরাজ্য এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট নির্দিষ্ট কার্য সম্পন্ন করার দায়িত্ব অর্পণই এর আওতাভুক্ত। তবে এরূপ ক্ষেত্রে আইন বা সংবিধান দ্বারা দায়িত্বের সীমারেখা নির্ধারিত করা থাকে। তবে এরূপ দায়িত্ব যে সবসময়ই স্পষ্টভাবে উল্লিখিত থাকবে তা নয়; অনেক সময় এটি অস্পষ্ট থাকতে পারে।

প্রাদেশিক বা রাষ্ট্রীয় আইন পরিষদই এক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখে। এখানে কেন্দ্ৰীয় সরকার কর্তৃক ক্ষমতা হস্তান্তর সাময়িক নয়; বরং কাজ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের এটি প্রকৃত রূপ। 

প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থা এতদুভয়ই হতে পারে। রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ বলতে সরকার কর্তৃক নতুন প্রশাসনিক স্তর স্থাপনকে বুঝান হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বেলায় স্বায়ত্তশাসিত অঙ্গরাজ্য গঠন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠান যেমনঃ জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ইত্যাদি রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শেষকথাঃ পরিশেষে উল্লেখ্য, সরকারি প্রশাসনের দক্ষতা ও কার্যকরীকরণের স্বার্থে যতটা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। তাছাড়া রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা, সমঝোতা, অংশীদারিত্ব প্রভৃতি উন্নয়নের স্বার্থেই অতি জরুরি আবশ্যক বিকেন্দ্রীকরণের।